‘রাখে আল্লাহ মারে কে’

প্রভাষ আমিন
প্রভাষ আমিন প্রভাষ আমিন , হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ
প্রকাশিত: ০৯:৫৬ এএম, ২৩ মার্চ ২০২০

বিশ্ব এক মহাবিপর্যয়ের মুখোমুখি। বিশ্বের ১৮৮টি দেশ এখন করোনা আতঙ্কে কাঁপছে। যে হারে ছড়াচ্ছে করোনাভাইরাস, তাতে শিগগিরই গোটা বিশ্বকে তা গ্রাস করে নেবে। ইতোমধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লাখ, মৃত্যু ছাড়িয়েছে ১৪ হাজার। করোনা কোনো সীমানা মানে না। বাংলাদেশ হাতে অনেক বেশি সময় পেয়েছিল, কিন্তু করোনা থেকে নিজেদের পুরোপুরি মুক্ত রাখতে পারেনি। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহান শহরে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। আর প্রথম মৃত্যুর খবর আসে ১১ জানুয়ারি। বাংলাদেশে প্রথম সংক্রমণের খবর আসে ৮ মার্চ, আর প্রথম মৃত্যুর খবর আসে ১৮ মার্চ। তার মানে মাঝখানে বাংলাদেশ নিজেদের প্রস্তুত করার জন্য প্রায় আড়াই মাস সময় পেয়েছিল। কিন্তু এই অতি মূল্যবান আড়াই মাস সময়ে বাংলাদেশ যথাযথ প্রস্তুতি নিয়েছে বলে দৃশ্যমান প্রমাণ মেলেনি। প্রথম দায়িত্ব ছিল দেশের প্রবেশ পথগুলোতে নিশ্ছিদ্র মনিটরিং নিশ্চিত করা। কিন্তু এ ব্যাপারে প্রথমদিকে অনেক খামখেয়ালির খবর এসেছে। বিমানবন্দর বা স্থলবন্দরে শুধু তাপমাত্রা মাপা হয়। শুরুর দিকে সেই থার্মাল স্ক্যানারও পর্যাপ্ত ছিল না। আর শুধু তাপমাত্রা মেপেই করোনা শনাক্ত সম্ভব নয়। এমনও হতে পারে যখন দেশে ফিরলেন, তখন বিমানবন্দরে আপনার শরীরে জ্বর নেই। কিন্তু জ্বর না থাকলেও আপনি হয়তো করোনা নিয়েই ঢুকেছেন দেশে।

গত ১০ ফেব্রুয়ারি ‘ভয় করোনা, সতর্ক থাকো’ শিরোনামে এই কলামে লিখেছিলাম, ‘বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত করোনার রোগী পাওয়া যায়নি। তবে ঝুঁকিটা অনেক বেশি। যেভাবে দেশের সব প্রবেশমুখে স্কিনিং করা হচ্ছে, বাংলাদেশে করোনা না ঢুকতে পারুক। কিন্তু এরই মধ্যে স্কিনিংয়ের সিরিয়াসনেস নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। আমরা চাই, সব ফেলে এখন বিমানবন্দর এবং সব স্থলবন্দরে কঠোর নজরদারি করা হোক, যাতে করোনাভাইরাস নিয়ে কেউ বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে। বাংলাদেশে এলে করোনা আরও অনেক ভয়াবহ হবে। কারণ বাংলাদেশ ঘনবসতির দেশ।
চীনের মতো আমরা নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে রাখতে পারব না। আর যেহেতু ছড়িয়ে পড়ার পর কিছু করার থাকে না, তাই যাতে না ছড়ায় সে চেষ্টা করাই ভালো।’

কিন্তু আমার লেখাটি কেউ পড়েছেন বলে মনে হয় না। গত আড়াই মাসে অন্তত ছয় লাখ লোক বাংলাদেশে ঢুকেছেন। আমরা কেউ কি জানি তারা কোথায় আছেন? এখন জেলায় জেলায় বাতি দিয়ে প্রবাসীদের খোঁজা হচ্ছে। তাদের কোয়ারেন্টাইনে বাধ্য করা হচ্ছে। কিন্তু ঢোকার সময় তাদের নাম-ঠিকানা লিখে রাখলেই সবাই একটা ডাটাবেজে থাকতে পারত। জেলাপর্যায়ে সহজেই বাইরে থেকে আসা মানুষদের নজরে রাখা যেত। প্রয়োজনে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা যেত। কিন্তু এই সময়ে বিদেশ থেকে আসা লোকজন ছড়িয়ে পড়েছেন সারাদেশে। ঘুরছেন, ফিরছেন, বেড়াচ্ছেন, বাজার করছেন, আড্ডা দিচ্ছেন, কেউ কেউ ঘটা করে বিয়েও করছেন। কেন করছেন, এই প্রশ্ন না করে প্রশ্ন করা উচিত, কেন করতে পারছেন? তারা তো কেউ গোপন পথে বাংলাদেশে আসেননি। বিমানবন্দরে কি তাদের যথাযথ স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়েছিল? তাদের কি বলা হয়েছিল, বাসায় গিয়ে কী করতে পারবে, কী করতে পারবে না। তাহলে তাদের দোষ দিয়ে লাভ কী?

এ কদম শুরুতে যদি অন্তত চীনের সাথে বিমান যোগাযোগ বন্ধ রাখা যেত, তাহলে ঝুঁকি অনেক কম থাকত। তা তো হয়ইনি বরং চীনে আটকেপড়াদের বিশেষ বিমানে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। পরে করোনা চীন থেকে একে একে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়েছে। আমরা যদি একে একে সংক্রমিত দেশের সাথে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করতে পারতাম, তাহলেও ঝুকি কমতে পারত। সেটা তো হয়ইনি বরং বিমান যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ঘোষণার পরও ইতালিসহ সংক্রমিত বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ফ্লাইট নামতে দেয়া হয়েছে। ইতালি থেকে আসা ১৪২ জনকে আশকোনার হজ ক্যাম্পে রাখার পর বিক্ষোভের মুখে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে। অথচ তাদের রাখার পরিবেশ উন্নত করা উচিত ছিল, ছেড়ে দেয়া নয়। আপনি যদি লম্বা জার্নি করে আসা মানুষদের গেটের বাইরে দাড় করিয়ে রেখে হজ ক্যাম্পে ঝাড়ু দেন, মানুষ তো ক্ষিপ্ত হবেই।

নিষ্ঠুর বাস্তবতা হলো, আড়াই মাসেও আমরা জীবাণুমুক্ত কোয়ারেন্টাইন ক্যাম্প নিশ্চিত করতে পারিনি। এখন সেনাবাহিনীর হাতে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এখন আমরা কিছুটা স্বস্তি পেতে পারি। তবে সেনাবাহিনীকে জায়গা দিতে হবে। উত্তরার দিয়াবাড়ীতে রাজউকের ফ্ল্যাট প্রকল্পে কোয়ারেন্টাইন ক্যাম্প করতে চাইলে সেখানকার বাসিন্দাদের বিক্ষোভের মুখে সেটা বাতিল করতে হয়েছে। সরকারকে কঠোর হতে হবে। কোনটা জনগণের জন্য, দেশের জন্য ভালো; ভেবেচিন্তে সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর দেশের জন্য ভালো হলে, কারও বিক্ষোভের মুখে পিছিয়ে আসা যাবে না।

যেহেতু ছড়িয়ে পড়ার পর কিছু করার থাকে না, তাই যাতে না ছড়ায় সে চেষ্টা করাই ভালো। কিন্তু ভালো কাজটি সময়মতো আমরা করতে পারিনি। আমরা অতি মূল্যবান আড়াইটি মাস হেলায় নষ্ট করেছি। আমার ধারণা আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় করোনাভাইরাসের গুরুত্বটা বুঝতে পারেনি। তারা ‘রাখে আল্লাহ মারে কে’ স্টাইলে প্রস্তুতি নিয়েছে। আড়াই মাস সময় পাওয়ার পরও আমরা কাজের সময়ে দেখি ডাক্তারদের জন্য পর্যাপ্ত পোশাক নেই। করোনা শনাক্তের পর্যাপ্ত কিট নেই।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা বিস্তাররোধে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে করোনা শনাক্তের ওপর। তারা বলছে, করণীয় হলো- টেস্ট, টেস্ট এবং টেস্ট। টেস্ট করতে হবে, শনাক্ত হলে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে সবচেয়ে কঠিন হলো করোনা টেস্ট। গত আড়াই মাসে অন্তত ছয় লাখ লোক এলেও টেস্ট করা হয়েছে মাত্র কয়েকশ লোকের। তার মানে টেস্টের বাইরেও একটা বড় অংশ করোনা সংক্রমিত থাকার ঝুঁকি রয়েই গেছে। একমাত্র আইইডিসিআর ছাড়া আর কারও টেস্ট করার অনুমতি নেই। আর আইইডিসিআর বিদেশফেরত বা তাদের সংস্পর্শে আসা লোক ছাড়া কারও টেস্ট করছে না। অনেক লোক করোনা সংক্রমণের সব লক্ষণ নিয়েও টেস্ট করার সুযোগই পাচ্ছেন না। কম টেস্ট করা মানে, কম রোগী ধরা পড়া। এভাবে কি করোনার বিস্তার ঠেকানো যাবে। আগুন লাগলে আগে সবাইকে জানাতে হয়। আতঙ্কের ভয়ে লকিয়ে রাখার সুযোগ নেই। তাছাড়া আইইডিসিআরের হটলাইনে ফোন করে সেবা পাওয়া লোকের চেয়ে লাইন না পাওয়া লোকের সংখ্যা বাংলাদেশে বেশি। অথচ করোনার ঝুঁকিতে থাকা প্রতিটি লোককে আপনার আমলে নিতে হবে।

আমি জানি না, শুরুতে আমরা বিষয়টিকে সিরিয়াসলি নেইনি। সরকারও নেয়নি, আমরাও নেইনি। গত ১৬ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু আমাদের অনেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধকে ছুটি হিসেবে নিয়েছেন। ঈদের মতো গ্রামের বাড়ি চলে গেছেন। সমুদ্রসৈকতে উপচেপড়া ভিড়, বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে ঠাঁই নেই, চিড়িয়াখানায় লম্বা লাইন- শুনে বুঝি আমরা বীরের জাতি, করোনা আমাদের আতঙ্কিত করতে পারেনি। সরকারকে জোর করে সমুদ্রসৈকত খালি করতে হয়েছে। মৃত্যুর ঘোষণা আসার পর মানুষের মধ্যে কিছুটা ভয় ঢুকেছে। আতঙ্কের প্রথম ধাক্কায় আমরা যেটা করেছি, বাজার খালি করে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিয়েছি।

আগেও বলেছি, আবারও বলছি, আতঙ্কিত হওয়া যাবে না, সতর্ক থাকতে হবে, পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। আর মানুষকে সচেতন করতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারতেন যে ধর্মগুরুরা। কিন্তু তারা করছেন উল্টো কাজ। করোনায় প্রথম কাজ হলো, বিচ্ছিন্ন থাকা। কিন্তু বাংলাদেশে করোনা রোগী শনাক্তের পরও লক্ষ্মীপুরে করোনা থেকে মুক্তির দোয়ায় লাখো মানুষ সমবেত হয়েছিলেন। করোনার ভয়ে সৌদি আরবে মক্কা শরিফ ও মদিনার মসজিদে নববী ছাড়া আর সব মসজিদে নামাজ স্থগিত করা হয়েছে। ওমরাহ হজ স্থগিত করা হয়েছে। কাবা শরিফ জনশূন্য, এমন বিরল দৃশ্যও বিশ্বকে দেখতে হয়েছে। অনেক দেশে আজানেই নামাজ পড়তেও মসজিদে না আসার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে পুরো উল্টো। গত শুক্রবার বাসা থেকে অজু করে, নফল নামাজ পড়ে মসজিদে আসার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। এর প্রতিবাদে হবিগঞ্জে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। আসলেই আমাদের আল্লাহ ছাড়া কেউ রক্ষা করতে পারবে না।

বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীরা আর বাংলাদেশের হুজুররা করোনা নিয়ে যা যা বলছেন; তা নিয়ে আন্তর্জাতিক কমেডি হতে পারে। মন্ত্রীরা বলছেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধভাবে তারা করোনা মোকাবিলায় সফল হয়েছেন। আর হুজুররা বলছেন, করোনা হলো আল্লাহর সৈনিক। চীন যেহেতু উইঘুরে মুসলমানদের নির্যাতন করছে; তাই আল্লাহ তাদের শায়েস্তা করার জন্য তার সৈনিক হিসেবে করোনাকে পাঠিয়েছে। পরে যখন মুসলমানরাও করোনায় আক্রান্ত হলো, তখন বললেন, এরা খাঁটি মুসলমান নয়। পরে যখন সৌদি আরব, ইরানের মতো দেশে করোনা ছড়িয়ে পড়ল, এখন বলছে আল্লাহ মুসলমানদের ঈমান পরীক্ষা করছে। আরেক হুজুর বলছেন, করোনার সাথে নাকি তার তিন ঘণ্টা কথা হয়েছে। করোনা বলেছে, বাংলাদেশে অত বেশি ক্ষতি করবে না। আরেক হুজুর বলছেন, করোনা কিছুই না, ইসলামে কোনো সংক্রামক ব্যাধি নেই। প্রতিদিন এই হুজুররা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন। এই মুহূর্তে এদের তৎপরতা থামানো দরকার।

আস্তে আস্তে সংকুচিত হয়ে আসছে বাংলাদেশ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে আগেই। এখন একে একে চিড়িয়িাখানা, সিনেমা হল, বিনোদনকেন্দ্র, খেলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে গেছে। এবার ২৬ মার্চের সব কর্মসূচি বাতিল করা হয়েছে, স্থগিত হয়েছে এইচএসসি পরীক্ষা। রুটিন চিকিৎসাসেবাও কমিয়ে আনা হয়েছে। এই মুহূর্তে দরকার যতটা সম্ভব ঘরে থাকা। সতর্ক হওয়ার সময় অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে। আর দেরি করলে অনেক বড় মূল্য দিতে হবে। প্লিজ, অতি জরুরি কাজ না হলে ঘর থেকে বেরুবেন না। এমনকি জরুরি না হলে হাসপাতাল বা ডাক্তারের কাছেও যাবেন না।

প্রবাসীদের প্রতি অনুরোধ- আপনারা যদি বাংলাদেশকে ভালোবাসেন, যদি স্বজনদের ভালো চান; তাহলে এখন দেশে ফিরবেন না। আর যদি সাবধান হওয়ার আগেই ফিরে থাকেন, তবে অবশ্যই ঘরে থাকবেন। বিমানবন্দরে যথাযথ স্বাস্থ্য পরীক্ষা অনুসরণ করবেন। যদি মনে করেন, আপনাকে যথাযথ পরীক্ষা করা হয়নি, নিজে থেকে তাদের বলুন। কোনোভাবেই ফাঁকি মেরে বিমানবন্দর থেকে বেরোনোর চেষ্টা করবেন না। এই ফাঁকিটা কিন্তু আপনাকে, আপনার স্বজনদেরই ঝুঁকিতে ফেলবে। একটা কথা মনে রাখবেন, কোয়ারেন্টাইন কিন্তু শাস্তি নয়, এটা আপনার জন্যই করা।

প্লিজ অপ্রয়োজনে ঘর থেকে বেরুবেন না। সবাই ঘরে থাকুন। সাবধানে থাকুন, নিরাপদে থাকুন।

এইচআর/বিএ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।