বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর নেপথ্যের কথা

ফারহানা মোবিন
ফারহানা মোবিন ফারহানা মোবিন , লেখক এবং চিকিৎসক
প্রকাশিত: ১০:১১ এএম, ১৮ মার্চ ২০২০

যুগে যুগে কিছু মানুষ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন যে মানুষগুলো তাদের কর্মগুণে বেঁচে থাকা অবস্থায়ই হয়ে ওঠেছেন কিংবদন্তী। এমনই কিছু বিশাল বটবৃক্ষ হলেন বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বীর নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, মমতাময়ী জগত বিখ্যাত নারী মাদার তেরেসা, অমর বিপ্লবী নেতা চে গুয়েভারা, আমেরিকার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন প্রমুখ। যুগে যুগে পৃথিবীতে এই মানুষগুলোর কর্মগুণ, নেতৃত্ব, মানুষকে ভালো কাজে অনুপ্রাণিত করেছে। এই মানুষগুলোর জীবন যাপন পদ্ধতি, তাঁদের আদর্শ আমাদের জন্য হয়ে উঠেছে আলোর মশাল।

আমাদের বাংলাদেশের জন্য এমনই একজন আলোর মশাল হলেন জাতির জনক বীর নেতা, সংগঠক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যে মানুষটি পৃথিবীতে জন্ম না নিলে পৃথিবীর ইতিহাসে লাল সবুজ এর পতাকার জন্ম হতোনা। আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের দাস হয়েই থাকতাম। আমরা কোনও দিন মাথা উঁচু করে সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতামনা। আমাদের বীর নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তিনি জন্ম গ্রহণ করেন ১৯২০ সালে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিভাগে লেখাপড়া করেন।

১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম নেতা তিনি। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে ১৯৭০ সালের জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনে তাঁর রাজনৈতিক দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে নির্বাচিত হয়। এই অর্জন ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রের জন্মের জন্য অন্যতম মাইলফলক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একজন কিংবদন্তী নেতা, একজন বড় মাপের সংগঠক, একজন সুবক্তা। লেখালেখিতেও তিনি ছিলেন ভীষণ পারদর্শী। তাঁর লেখা বই “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” শুধু মাত্র বই নয় জাতির দিক নির্দেশনার এক জীবন্ত দলিল।

২০০৪ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য সন্তান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তাঁর পিতার লেখা চারটি খাতা এসে পৌঁছে। খাতাগুলোর পৃষ্ঠা জুড়ে সময়ের বিবর্তন অক্ষরগুলো প্রায়ই অস্পষ্ট, লালচে হয়ে যাওয়া পাতা। পিতার প্রিয় সন্তান মাননীয় শেখ হাসিনা মুহূর্তেই তাঁর পিতার হাতের লেখাগুলো চিনে ফেললেন। খাতা চারটা হাতে নিয়ে বাঁধভাঙ্গা কান্না আবেগ তাকে আচ্ছন্ন করে ফেললো। ছোট বোন শেখ রেহানাকে খাতাগুলো দেখালেন। পাহাড় সম শোক, পরিবারকে হারানের ব্যথা অশ্রুধারা হয়ে ঝরতে থাকলো দুই বোনের চোখ দিয়ে। খাতা চারটি ছিল বঙ্গবন্ধুর লেখা আত্মজীবনী।

১৯৬৭ সালের মাঝের দিকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বন্দী থাকাকালীন সময়ে তাঁর লেখা তিনি লিখে শেষ করতে পারেননি। লেখাগুলো শুধু মাত্র লেখা নয় সেসব ছিল একজন মহীরুহের প্রবল দেশ প্রেম, মানবপ্রেম আর চেতনার আলোয় আলোকিত এক প্রামাণ্য চিত্র। যে প্রামাণ্য চিত্র লেখা হয়েছে প্রবল দেশপ্রেম, মানব প্রেম, দেশের মানুষকে পশ্চিম পাকিস্তানীদের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করার জন্য শপথ, খাতা চারটির পাতাগুলো ছিল একেবারেই জরাজীর্ণ। একটু আঘাত লাগলেই ছিড়ে যাবে এমন করুণ অবস্থা।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট (হত্যার উদ্দেশ্যে) বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের এক সমাবেশে চালানো হয় গ্রেনেড হামলা, হামলায় আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভী রহমান সহ মোট চব্বিশজন মারা যান। সৌভাগ্যবশত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেঁচে যান। তিনি চোখের সামনে চব্বিশজন মানুষকে হারানের শোকে কাতর হয়ে পড়েন। দুঃখ কষ্টের সাগরে তিনি যখন ভাসছিলেন ঠিক তখনই এই চারটা খাতা উনার হাতে এসে পৌঁছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এক ফুফাতো ভই সেই চারটা খাতা উনাকে দেয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আরেক ফুফাতো ভাই হলেন শেখ ফজলুল হক মনি। তিনি ছিলেন বাংলার বাণীর সম্পাদক। উনার অফিসের টেবিলের ড্রয়ার থেকে পাওয়া গিয়েছিল সেই চারটা খাতা। ধারণা করা হয় বঙ্গবন্ধু হয়তো লেখাগুলো টাইপ করতে দিয়েছিলেন বই প্রকাশের জন্য।

খাতা চারটার মধ্যে ছিল বঙ্গবন্ধুর বংশ পরিচয় স্কুল-কলেজ, শিক্ষা জীবনের পাশাপাশি সামাজিক, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, দেশের জন্য চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দেশের অভাব, বিহার, কলকাতার দাঙ্গা, দেশভাগ, প্রাদেশিক মুসলীম ছাত্রলীগ ও মুসলীমলীগের রাজনীতি সহ বিভিন্ন বিষয়ের বর্ণনা। দেশ ভাগ হয়ে যাবার পর থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলার রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, দেশের মানুষের জীবনযাপনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ছিল খাতাগুলোর প্রতিটি লেখা জুড়ে। খাতার পাতাগুলো এতো নরম হয়ে গেছিল যে হাত দিলেই ছিড়ে যাবে, এমন একটা অবস্থা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, তার ছোট বোন শেখ রেহানা, সাংবাদিক বেবী মওদুদসহ আরো কয়েকজন পালাক্রমে লেখাগুলোকে খুব সাবধানে ফটোকপি করে বার বার পড়েছেন। কারণ অধিকাংশ লেখা ছিল ভীষণ ঝাপসা। কোথাও কোথাও লেখা ছিল একেবারেই অস্পষ্ট। ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে লেখা উদ্ধারের কাজ করতে হয়েছিল।

book

খাতাগুলোর লেখা পড়তে যেয়ে অগণিত বার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও শেখ রেহানা চোখের জলে ভাসতেন। শেখ রেহানা অসংখ্যবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছেন, হলদে পৃষ্ঠা গুলোতে হাত বুলিয়ে উপলব্ধি করার চেষ্টা করতেন পিতার আঙ্গুলের স্পর্শ। বড় বোন শেখ হাসিনা বরাবরের মতোই শেখ রেহানার ভরসার আশ্রয়স্থল হয়ে ছোট বোনকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। বাবার লেখা আত্মজীবনী পড়তে যেয়ে বার বার স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছেন। অদম্য ইচ্ছা পিতৃ প্রেম আর দেশের মানুষকে মহান এক নেতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার মহৎ ইচ্ছা থেকেই প্রকাশ পায় বঙ্গবন্ধুর লেখা। “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” বইটির পুরো লেখা জুড়ে প্রবল দেশপ্রেম। জেলখানায় বন্দী অবস্থায় থেকেও দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন, পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।

একজন মানুষ দেশের মানুষকে ভালোবেসে নিজের জীবনের জন্য কতোটা ঝুঁকি নিতে পারেন জেল নির্যাতন কতোটা সহ্য করেছেন, মানুষের কল্যাণে নিজেকে কিভাবে বিসর্জন দিয়েছেন, লেখাগুলো সেই প্রত্যয়ের কথাই বলে। বহুবিধ তথ্যের সমৃদ্ধ এই বইটিতে পাকিস্তান আন্দোলন ভাষা আন্দোলন বাঙালির স্বাধীনতা, অধিকারের আন্দোলন, এই দেশের মানুষকে ধ্বংস করে দেবার জন্য পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর বিভিন্ন ধরনের চক্রান্তের ঘটনার উল্লেখ রয়েছে এই বইয়ে। প্রধানমন্ত্রীর মতে, এই বই এর ঘটনাগুলোর সূত্রধরে অনেক অজানা ঘটনার গবেষণা করা সম্ভব। খাতাগুলোতে জেলারের সাক্ষর দেয়া অনুমোদনের পৃষ্ঠাগুলো অক্ষত ছিল। তারিখগুলো দেখে ঘটনার ব্যাখ্যা, বিস্তৃতি, লেখার সম্পাদনার কাজে সুবিধা হয়েছিল। লেখাগুলোর সম্পাদনা, সংশোধন এর কাজ করেছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও সাংবাদিক বেবী মওদুদ। এর পরে অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান, প্রধানমন্ত্রী এবং বেবী মওদুদ পান্ডুলিপির সম্পাদনা, প্রুফ দেখা, টিকা লেখা, স্ক্যান, ছবি নির্বাচনের কাজগুলো সম্পন্ন করেন। সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন শেখ রেহানা।

এই গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত লিখেছেন। ১৯৬৬-৬৯ সালে কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দী থাকাকালীন সময়ে একান্ত নিরিবিলিতে তিনি লিখেছেন জাতির জন্য অমূল্য এক ইতিহাস। আত্মজীবনী প্রকাশের ইচ্ছা থেকেই তিনি তার এই চারটা খাতার লেখাগুলো টাইপ করতে দিয়েছিলেন কিন্তু তিনি ঘাতকদের হাতে মারা যান। তাই বইটি আর প্রকাশ পায়নি। ভাগ্যের বিম্ময়কর খেলায় লেখাগুলো দীর্ঘ বছর পরে ২০০৪ সালে এসে পৌঁছে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যার হাতে।

সীমাহীন পরিশ্রম আর ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে অবশেষে মহামূল্য এই স্মৃতি কথাগুলো মুদ্রণে রূপ নেয়।“অসমাপ্ত আত্মজীবনী” নামে জাতির হাতে পৌঁছে যায় এক চেতনার ইতিহাস, এক মহান নেতার স্বপ্নগাথা। ‘‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী” শুধুমাত্র একটি বই নয়, এটি একটি জীবন্ত দলিল, সোনার অক্ষরে মুদ্রিত মহান এক দেশপ্রেমী নেতার জীবনদর্শন। বইটি দেশ গড়বার জন্য বিরল এক দিকনিদের্শনা।

এইচআর/জেআইএম

সীমাহীন পরিশ্রম আর ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে অবশেষে মহামূল্য এই স্মৃতি কথাগুলো মুদ্রণে রূপ নেয়। “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” নামে জাতির হাতে পৌঁছে যায় এক চেতনার ইতিহাস, এক মহান নেতার স্বপ্নগাথা। ‘‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী” শুধুমাত্র একটি বই নয়, এটি একটি জীবন্ত দলিল, সোনার অক্ষরে মুদ্রিত মহান এক দেশপ্রেমী নেতার জীবনদর্শন। বইটি দেশ গড়বার জন্য বিরল এক দিকনিদের্শনা।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।