নারী দিবস ও নজরুল
সম্পা দাস
৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবস। ১৯৭৫ সালে ৮ মার্চ জাতিসংঘ এই দিনটিকে ‘বিশ্ব নারী দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এই দিনটিকে নারীদের জন্য নির্দিষ্ট দিন হিসেবে স্বীকৃতির পেছনেও রয়েছে নারীর এক দীর্ঘ বঞ্চনা ও নিপীড়নের ইতিহাস। এ দিবসেই প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা, নারীর যোগ্যতাকে স্বীকৃতি দেওয়া, সকল বিষয়ে নারীর মত প্রকাশের স্বাধীনতা, পুরুষশাষিত সমাজে নারীর প্রতি গতানুগতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনসহ জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে নারী-পুরুষের যৌথ অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ। কাজী নজরুল ইসলাম নারী জীবনের এ বঞ্চনা ও বাস্তবতা ‘নারী দিবস’ ঘোষণার বেশ কয়েক দশক পূর্বেই নিজের অস্তিত্ব চেতনায়, অনুভবে ধারণ করেছিলেন এবং নারী জাগরণ ও সাম্যের লক্ষ্যে সৃষ্টি করেছেন কালজয়ী সব কবিতা ও গান। ‘সাম্যের গান গাই,/ আমার চক্ষে পুরুষ রমণী কোন ভেদাভেদ নাই।/ বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’। (নারী, সাম্যবাদী)।
একবিংশ শতাব্দীতে সমাজ বস্তুগত অগ্রগতিতে অনেক দূর এগিয়ে গেলেও মনুষ্যসমাজ মূল্যবোধের তীব্র সংকটে ভুগছে। প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হচ্ছে নানাবিধ মনস্তাত্ত্বিক সমস্যাসহ অন্যান্য জটিল সামাজিক সমস্যা। ‘নুসরাত’রা পাচ্ছে না তাদের জীবনের নিরাপত্তা, অনেক ক্ষেত্রে লক্ষণীয়- বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্রীরাও পাচ্ছে না তাদের জীবনের বেঁচে থাকার স্বাধীনতা ও নিশ্চয়তা। মূল্যবোধের সংকট প্রশমনের জন্য এবং সমাজ প্রগতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দরকার সত্যিকার জীবনবোধ সৃষ্টি ও তার বিকাশ। নারী অধিকার প্রশ্নেও নারী জাগরণের জন্য সম্ভবত নজরুলের মতো এতো সাহসী শব্দচরণ কোন কবি বা দার্শনিক উচ্চারণ করতে পারেন নি। তাঁর উল্লেখযোগ্য কালজয়ী সৃষ্টি ‘বিদ্রোহী’, ‘বারাঙ্গনা’, ‘নারী’ এই কবিতাগুলো এক-একটি মিথ বা মহাকাব্যও বলা যায়।
কাজী নজরুল ইসলাম বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী। সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় তাঁর সৃষ্টিকর্ম থাকলেও নজরুল প্রতিভার পূর্ণ স্ফূরণ ঘটে তার সংগীতে। তাঁর প্রকাশিত গানের সংখ্যা প্রায় চার হাজার। শুধু সংখ্যাগত আধিক্যই নয় তাঁর গানের বাণী, সুর ও আবহ শ্রোতাকে এক অদ্বৈত ভাবলোকে পৌঁছে দেয়। নজরুল প্রেমের কবি, গানের কবি হিসেবে অধিকতর পরিচিত হলেও তাঁর সৃষ্টিশীলতা কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল মানবতাবোধ বা মানুষের অধিকার অর্জন। পৃথিবীতে যাতে চিরকালের জন্য নির্যাতন শেষ হয়ে যায়, শোষণ নিঃশেষিত হয়, নিপীড়ন চিরকালের জন্য নিরুদ্দেশ হয়, উৎপীড়নের চিহ্ন যেন না থাকে সেই প্রতিজ্ঞাই ছিল তাঁর লেখনীতে- ‘মহা-বিদ্রোহী রণক্লান্ত/আমি-সেইদিন হব শান্ত’।
প্রতিটি সমাজেরই বিরাট একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে নারী। সমাজ প্রগতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দরকার নারী-পুরুষের যৌথ প্রয়াস। নারী একাধারে মাতা, কন্যা, জায়া, বধূ, ভগ্নি- নারীর এ সকল পরিচয়, তার অন্তর্নিহিত শক্তিরূপ, তাকে নিজেকেই চিনতে হবে, জানতে হবে এবং জাগাতে হবে তার চেতনালোককে। নজরুল এই নারীর চেতনালোকের মুক্তির প্রয়াসে রচনা করেছেন নারী জাগরণীমূলক সংগীত ‘জাগো নারী জাগো বহ্নি-শিখা/জাগো স্বাহা সীমান্তে রক্ত-টিকা‖/ ...................জাগো মাতা, কন্যা, বধূ, জায়া, ভগ্নী/! পতিতোদ্বারিণী স্বর্গ-স্খলিত’। (নজরুল- সংগীত সংগ্রহ পৃ-১১২)।
নারী জাগরণের জন্য এমন সংগীত রচনা নজরুলের পূর্বে কোন গীতিকবি এভাবে রচনা করেননি। গানটি শোনার সাথে সাথেই সকল শ্রোতার মনে মুহূর্তেই জাগরণের এক চিত্রকল্প তৈরি হবে। এই গানটিতে রয়েছে নারীর সংকল্পবদ্ধতা, দৃঢ়চিত্ততা, অপরিমেয় শক্তির প্রকাশরূপ। ‘সারং রাগে’ এ গানটির সুরারূপ করেছেন নজরুল। এ রাগে বন্ধনমুক্তির প্রেরণা রয়েছে, সুরের ভাঁজে ভাঁজে রয়েছে এক অজানা ক্ষিপ্রতা, স্বর প্রক্ষেপণেও রয়েছে দৃঢ়তা। নারীর বহ্নিশীখায় বিকশিত হবার প্রেরণা রয়েছে এ গানটিতে। নজরুলের নারী জাগরণের অন্যান্য গানগুলোতে রয়েছে নারীর আত্মশক্তিতে বিকশিত হবার দুর্দান্ত প্রেরণা।
নারীর শক্তিরূপেরও মাহাত্ম্য গেয়েছেন নজরুল। তাঁর নারী চরিত্রগুলো প্রেমে যেমন কোমল পাশাপাশি যুদ্ধক্ষেত্রেও তেমনি বীর, সাহসী, দৃঢ়তায় অতুলনীয়া। এই নারী বহ্নিশীখা, ইতিহাসের গতিপথও বদলে দেয় এ সব নারীর অবদান। ঐতিহাসিক নারী চরিত্র ‘চাঁদ সুলতানা’র কৃতিত্ব নিয়ে ও নজরুল রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত গান- ‘চাঁদের কন্যা চাঁদ সুলতানা,/ চাঁদের চেয়েও জ্যোতি,/তুমি দেখাইলে মহিমান্বিতা নারী কি শক্তিমতী ‖/ শিখালে কাঁকন চুড়ি পরিয়ান নারী,/ধরিতে পারে সে উদ্ধত তরবারি’।
নারীর অধিকার আদায়ের জন্য ‘নারী’ কবিতার মধ্য দিয়ে নজরুল আহ্বান জানিয়েছেন- ‘আপনারে আজ প্রকাশের তব নাই সেই ব্যাকুলতা/ আজ তুমি ভিরু আড়ালে থাকিয়া নেপথ্যে কও কথা! / চোখে আজ চাহিতে পার না; হাতে রুলি, পায়ে মল,/ মাথার ঘোমটা ছিঁড়ে ফেল নারী, ভেঙে ফেল ও-শিকল’।
নারী সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নজরুল সোচ্চার ছিলেন তাঁর লেখনীতে। নারীর প্রতি বিচারবোধের জায়গাটিও শানিত করেছের তাঁর ‘বারাঙ্গনা’ কবিতায়। কবির দাবি, অসতী মাতার সন্তান যদি জারজ হয় তবে যারা অসৎ পিতা তাদের সন্তান ও জারজ হবে। তিনি লিখলেন ‘অসতী মাতার পুত্র সে যদি জারজ পুত্র হয়,/অসৎ পিতার সন্তানও তবে জারজ সুনিশ্চয়’। আজ নারী দিবসে আমাদের অঙ্গীকার হওয়া উচিত- নারী-পুরুষ হাতে হাত রেখে গড়বে আগামীর পৃথিবী ।
লেখক : শিক্ষক, নজরুল সংগীতশিল্পী ও নজরুল গবেষক।
এইচআর/পিআর