তালেবানদের সঙ্গে মার্কিনীরা স্বাক্ষর করল পরাজয়ের দলিল

আনিস আলমগীর
আনিস আলমগীর আনিস আলমগীর , সাংবাদিক ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৯:১৭ এএম, ০৫ মার্চ ২০২০

ভারত বিজয়ের পর ব্রিটিশরা আফগানিস্তানের দখল নিতে বহু চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছিল চূড়ান্তভাবে। গত শতাব্দির আশির দশকে সোভিয়েত রাশিয়াও পারেনি আফগানিস্তান দখলে রাখতে। এমন একটি দৃষ্টান্ত চোখের সামনে থাকার পরও আমেরিকা ২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে আল-কায়েদার সন্ত্রাসী হামলার পর আফগানিস্তান আক্রমণ করে বসে। কারণ তখন কাবুলে ক্ষমতায় ছিল তালেবান নেতা মোল্লা ওমরের সরকার। তারাই ওসামা বিন লাদেন ও তার সংগঠন আল-কায়েদাকে সর্বাত্মকভাবে সহায়তা করে যাচ্ছিল।

মোল্লা ওমরের সহযোগিতা ছাড়া আল-কায়েদার বাড়বাড়ন্ত অবস্থানে গিয়ে পৌঁছা সম্ভব ছিল না। ওসামা বিন লাদেন তখন আফগানিস্তানেই থাকতেন। বিশ্বের বহু দেশে আল-কায়েদা ছড়িয়ে পড়েছিল। তার হামলার মুখ্য টার্গেট ছিল আমেরিকান স্থাপনা ও দূতাবাস। তখন বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর রাশিয়া তখন স্বস্তিকর অবস্থায় নেই। সোভিয়েতের অবর্তমানে আমেরিকার জন্য আল-কায়দাই হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল সারা বিশ্বে এবং তারা দেশে দেশে মার্কিন দূতাবাস আক্রমণ শুরু করেছিল।

২০০১ সালে আফগান আক্রমণের মধ্য দিয়ে আমেরিকা ‘ওয়ার অন টেরর’ সূচনা করেছিল। দীর্ঘ ১৯ বছর যুদ্ধে যুদ্ধে ব্যস্ত ছিল মার্কিনীরা। অবশেষে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর মার্কিনীরা ১৪ মাসের মধ্যে পর্যায়ক্রমে সৈন্য প্রত্যাহার করে আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার অঙ্গীকারাবদ্ধ হল তালেবানদের সঙ্গে।

আমেরিকা ২০০১ সালে মোল্লা ওমরের সরকারের বিরুদ্ধে যেই যুদ্ধ শুরু করেছিল, ২৯ ফেব্রুয়ারি কাতারের দোহায় তালেবানদের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করে তা থেকে বিরত হবার এবং আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে দৃশ্যত হার মেনেছে। এখন পর্যন্ত তালেবানকে দেখে মনে হচ্ছে না যে তারা আমেরিকা বা আফগান সরকারকে কোনো ছাড় দেবে এবং চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়টিকে তারা নিজেদের বিজয় হিসেবে দেখছে। তালেবানদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও বৈধতাও এর মাধ্যমে পরিষ্কার হয়ে গেছে। চুক্তির সময় দোহায় তালেবানদের মধ্যে যে উচ্ছ্বাস দেখা গেছে তাতে বোঝা গেছে চুক্তির শর্তগুলোকেও তারা নিজেদের লক্ষ্য অর্জনের সুযোগ মনে করছে।
চুক্তিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, আফগানিস্তান এবং তালেবান কর্মকর্তা- কোনো পক্ষই 'শান্তিচুক্তি' আখ্যায়িত করেনি এখনো। তবে চুক্তি স্বাক্ষরের আগে থেকে এক ধরনের যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ায় দেশটির জনগণের মধ্যে এই নিয়ে কিছুটা হলেও সতর্ক আশাবাদ দেখা যাচ্ছে।

আফগানদের মত স্বাধীনচেতা জাতি বিশ্বে বিরল। তারা সব সময় যুদ্ধ করেছে তাদের চেয়ে বেশি শক্তি সম্পন্ন শক্তির সঙ্গে। এই নিয়ে কখনো আফগানরা বিব্রতবোধ করেনি। আফগানিস্তানে সোভিয়েতের দখলদারিত্বের সময় থেকে এই চুক্তি সম্পাদন পর্যন্ত কত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার পরিমাণ নির্ণয় করা কঠিন। তবে আমরা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো থেকে প্রাণহানীর যে ধারণা পাই তাতে দেখা যায়, এই সময়ের মধ্যে ৯ শতাংশ সাধারণ আফগান প্রাণ হারিয়েছে। সোভিয়েতের আর্থিক ক্ষতির কোনো বিবরণী বাইরে আসেনি তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গত ১৯ বছরের যুদ্ধে দুই ট্রিলিয়ন ডলার হারিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৩০০ সৈন্য নিহত হয়েছে, আহতদের সংখ্যা ২১ হাজার আর আফগান সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর ৫৮ হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছে।

আফগানিস্তানে চার দশকের গৃহযুদ্ধের পর তালেবান আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি ভবিষ্যতে আফগানিস্তানে সব বিরোধের অবসান হবে কিনা- এটি এখন বিরাট প্রশ্ন। অল্প কিছুদিনের মধ্যে দেশটিতে শুরু হবে বসন্তকাল। আর এই সময়ে দেশটির আবহাওয়া উষ্ণ থাকে বলে সাধারণত 'সংঘাতের মৌসুম' লাগে। তখন বোঝা যাবে চুক্তির কী ফল দৃশ্যমান হচ্ছে।

তবে একটি বিষয় পরিষ্কার যে এই চুক্তির পর তালেবানদের সঙ্গে আফগান রাজনীতিক, বিশেষ করে সরকারের আলোচনার পথ উন্মুক্ত হয়েছে। আলোচনা হয়তো সহজ হবে না কারণ তালেবানদের ইসলামী রাষ্ট্র আর আধুনিক গণতান্ত্রিক আফগানিস্তান- এই দুই ধারণার মধ্যে সমন্বয় সহজ নয়।

তালেবানেরা ইসলাম ভিত্তিক শাসন চায়। গত আলোচনার সময় নারী স্বাধীনতার ব্যাপারে আমেরিকা তাদেরকে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল। কিন্তু তালেবানেরা চুক্তিতে অনুরূপ কোনো শর্ত না মানার কথাই বলেছে এবং শেষ পর্যন্ত সেই শর্ত বাদ দিয়েই এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। সুতরাং সরকারের সঙ্গে তালেবানদের সমঝোতা হয় কিনা তা নিয়ে ভয় রয়ে গেছে। কারণ কাবুল সরকার পশ্চিমাদের হাতের পুতুল। ইসলামের কথা শুনলে পশ্চিমাদের গাত্রদাহ হয় এবং শেষ পর্যন্ত ইসলাম নিয়ে মতবিরোধে হয়তোবা চুক্তি বানচাল হয়ে যেতে পারে।

এছাড়াও, সরকারের সঙ্গে আলোচনা শুরুর আগে তালেবানরা তাদের ৫০০০ কারাবন্দীর মুক্তি দাবি করেছে। কিন্তু আফগান সরকার তালেবানকে যুদ্ধবিরতিতে রাজি করানোর কাজে এই বন্দিদের কাজে লাগাতে চায়। মার্কিনীরা যদিও আশরাফ ঘানির সরকারকে সমর্থন করে তারপরও দেশটিতে সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে আশরাফ ঘানি ও তার প্রতিপক্ষ আবদুল্লাহ আবদুল্লাহর মধ্যে বিরোধ রয়েছে। সেটি নিয়ে রাজনৈতিক অচলাবস্থায় আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের সমন্বয়ে আলোচক দল তৈরি করাও একটি বড় বাধা হতে পারে।

যদিও যুক্তরাষ্ট্র ইঙ্গিত দিয়েছে যে, যদি নতুন চুক্তি অনুযায়ী তালেবানরা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে তাহলে যুক্তরাষ্ট্র এবং নেটো সহযোগীরা আফগানিস্তান থেকে আগামী ১৪ মাসের মধ্যে সব সৈন্য সরিয়ে নেবে কিন্তু যদি কোনো চুক্তি কার্যকর না হয়, তাহলে মার্কিন সেনারা দেশটিতে থাকবে, নাকি ১৪ মাস পর চলে যাবে- তা এখনো পরিষ্কার নয়।

আফগানিস্তানের শান্তি প্রক্রিয়ায় পাকিস্তানেরও একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে কারণ তালেবান সৃষ্টি হয়েছিল সোভিয়েত দখলদারিত্বের সময়। লক্ষ লক্ষ আফগান সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবেশী পাকিস্তানের সীমান্ত প্রদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। তারা উভয়ে জাতিতে পশতুন। আর আরবী ও পশতু ভাষায় তালেবান অর্থ হচ্ছে ছাত্র। তালেবান নেতা মোল্লা ওমর তাদের সন্তান, তার উত্থানও পাকিস্তানের শরণার্থী শিবির থেকে।

গত চার দশকে আফগানিস্তানে বহু সরকার ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি তালেবানরাও ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল। তারা সরকারে এসে নারীদের শিক্ষা নিষিদ্ধ করেছিল এবং সব মানুষের দৈনন্দিন জীবনে নানা শর্ত আরোপ করেছিল, যেমন টিভি দেখা যাবে না, পুরুষদের দাঁড়ি রাখতে হবে, নারীদের পর্দা করতে হবে, ইত্যাদি। তালেবানরাও সরকার পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছে। জহির শাহের পর কাবুল কেন্দ্রিক সরকার কখনো সম্পূর্ণ আফগানিস্তানের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।

কাবুল সরকার এবং তালেবানেরা যদি আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চায় তবে সমন্বিত একটা সংবিধান রচনা করতে হবে। তারা যদি আন্তরিকতার সঙ্গে শান্তি কামনা করে তাহলে সমঝোতা হওয়া খুব কঠিন হবে না। কামনা করি চুক্তি সফল হোক, আফগানিস্তানে শান্তি আসুক।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]

এইচআর/পিআর

কাবুল সরকার এবং তালেবানেরা যদি আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চায় তবে সমন্বিত একটা সংবিধান রচনা করতে হবে। তারা যদি আন্তরিকতার সঙ্গে শান্তি কামনা করে তাহলে সমঝোতা হওয়া খুব কঠিন হবে না। কামনা করি চুক্তি সফল হোক, আফগানিস্তানে শান্তি আসুক

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।