বিদ্যুতের লাফ পানির ফাল

মোস্তফা কামাল
মোস্তফা কামাল মোস্তফা কামাল , সাংবাদিক
প্রকাশিত: ০৯:৫৭ এএম, ০৪ মার্চ ২০২০

দামবৃদ্ধির করাত আদা, রসুন, চাল, ডাল, তেল, চিনি ছাড়িয়ে সেবাপণ্যেও। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পর একটুও তর সয়নি ওয়াসার। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কী যৌক্তিকতা?-এ প্রশ্নের কিনারার আগেই বাড়ানো হয়েছে পানির দাম। একদিনের মধ্যেই পানির দাম বাড়িয়ে দিয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম ওয়াসা। ছয় মাসের ব্যবধানে পানির দাম বাড়ানো হলো আরো ২৫ শতাংশ। এর আগে ঢাকা ওয়াসার পানির দাম বাড়ায় গত ১ সেপ্টেম্বর। টাকার অংকে সেটা ১০ শতাংশের মতো।

বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আগে বিইআরসি গণশুনানির আইওয়াস করলেও ওয়াসা তা-ও করেনি। এক বিজ্ঞপ্তিতেই পানির দাম বাড়ানোর কর্মসারা। সরকার বা তার প্রতিষ্ঠানগুলো বছরে বছরে তেলের দাম, গ্যাসের দাম, বিদ্যুতের দাম বাড়াতে পারে। যেখানে চোখ যায় সেখানেই ট্যাক্স বসাতে পারে। সব জিনিসের দাম বাড়াতে পারে। মানে গরিব আর নিম্ন-মধ্যবিত্তদের চিড়ে-চ্যাপ্টা করতে পারে। তবে ধনী লুটেরাদের ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া ধরতে পারে না।

লুটেরাদের কাছ থেকে টাকা উদ্ধার করা যায় না। পাচার হওয়া অর্থও ফেরত আনার খবর নেই। খেলাপিদের কাছ থেকে ঋণ উদ্ধারের লক্ষণও নেই। কিন্তু সাধারণ মানুষের পকেট কাটা যায় নিমিষেই। ভোক্তা অধিকার সংগঠনগুলোর দাবি, বিদ্যুৎ ও পানির দাম না বাড়িয়ে ওই দুটি খাতে চুরি- চামারিসহ দুর্নীতি ও অপচয় কমাতে পারলেও দাম বাড়ানো লাগে না। সরকারের সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর চুরি, দুর্নীতি, অপচয়, ব্যর্থতার দায় দিব্বি চাপিয়ে দেয়া যাচ্ছে জনগণের ওপর। বছর বছর পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসের দাম বাড়ানো নিয়ে সরকার পক্ষে যুক্তি বড় কড়া। বচন চমৎকার।

সরকারের স্পোকসম্যান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জনগণকে পানি ও বিদ্যুতের বাড়তি দাম মেনে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এতে মানুষের তেমন ক্ষতি হবে না বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। কী তামাশা বেচারা জনগণের সঙ্গে। তারা তো বছর বছর বাধ্যগতভাবে মেনে নিচ্ছেই। মানতে মানতে অভ্যাসও হয়ে গেছে মানুষের। সরকার সেটা বুঝেশুনেই বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির দাম বাড়ায়। যথারীতি আদায়ও হয়। প্রতিবার দাম বাড়ানোর পর একই কথা বলেছেন। প্রত্যেকবার কেবল জনগণকে মানিয়ে নিতে বলেন। দুয়েকটা বার নিজেরা কিন্তু মানিয়ে নেন না। পুরোটাই হচ্ছে একতরফা। বিদ্যুতের বাড়তি দাম মেনে নিতে বলা হয়। কিন্তু, দাম কমানোর দাবিটা একবারও কি মেনে নেন?

কোথাও এর প্রতিবাদ হয় না। সরকারের জন্য এটা বিশাল সুযোগ। এই সুযোগে দাম বাড়িয়ে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি সব কিছুকেই লাফ দেয়ানো যাচ্ছে। লাফ দেয়াতে গিয়ে ফাল দিয়ে জনগণের কাঁধে চাপছে সরকারের যতো দায়। ওবায়দুল কাদের বাড়তি দাম মেনে নেয়ার নসিয়ত করলেও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ দাম বাড়ার কথা অস্বীকারই করেছেন। বাংলা শিখিয়ে ছেড়েছেন জাতিকে। তিনি বলেছেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়নি, কেবল সমন্বয় করা হয়েছে। বাড়তি টাকার তরজমা হয়ে গেল ‘সমন্বয়’।

মানুষের পকেট কাটতে চাতুরি অবাধেই চলে। এখন সেটার সঙ্গে যোগ হলো তামাশাও। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন-বিইআরসি গত বৃহস্পতিবার খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য ৫.৩ শতাংশ বাড়িয়েছে। এবার নিয়ে বর্তমান সরকারের টানা ১১ বছরে মোট আটবার খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য বাড়ল। ‘লাইফ লাইনে’ থাকা গ্রাহক, যাদের হতদরিদ্র ধরা হয়, এই সংখ্যা এখন এক কোটি ৩৮ লাখ। এই দরিদ্র শ্রেণি শূন্য থেকে ৫০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন। গ্রাহক ভ্যাট বাদে তারা এখন বিদ্যুৎ বিল দেয় ২০০ টাকা, নতুন দামে ভ্যাট বাদে বিদ্যুৎ বিল দিতে হবে ২১৭ টাকা ৫০ পয়সা।

বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্তের ফলে শুধু নিম্ন আয়ের মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, সেচ গ্রাহক, ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প গ্রাহকও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ক্ষতির মুখে পড়বে স্টিলশিল্প, সিমেন্টশিল্পসহ বৃহৎ শিল্প গ্রাহক। অন্যদিকে আবাসিক সংযোগে প্রতি এক হাজার লিটার পানির মূল্য ১১ টাকা ৫৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৪ টাকা ৪৬ পয়সা করেছে ঢাকা ওয়াসা। এ ছাড়া শিল্প ও বাণিজ্যিক সংযোগের ক্ষেত্রে এক হাজার লিটার পানির দাম ৩৭ টাকা চার পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪০ টাকা করা হয়েছে।

এই মুহূর্তে বিদ্যুতের মূল্য বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেয়ার ঘটনা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়া লাগে না। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে চাল, ডাল, তেল, রসুনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। বাসাভাড়া বেড়ে যাবে। শিল্পে উৎপাদিত সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। জামা-কাপড়, জুতাসহ খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দামও বেড়ে যাবে- এসব কে না বোঝে? শক্তি জগতের পরাক্রমশালী আইটেম বিদ্যুতের নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের কব্জায়। লিকুইড সোসাইটির অন্যতম সদস্য পানিকে কদরহীন করে রাখার দিনও বহু আগেই শেষ।

এক প্রবাদে পানির দাম বলতে বোঝানো হয় সস্তা দর। মামুলি ব্যাপার বোঝাতে গিয়ে বলা হয়, পানির মতো সোজা। আবার সবদিকে তাল মেলানো কাউকে তাচ্ছিল্য করতে গিয়ে বলা হয়, পানির রঙ। অবশ্য পানির শানে তারিফ করা একটা প্রবাদও আছে। পানিকে তোয়াজ করে বলা হয়, পানির অপর নাম জীবন। পানি নিয়ে প্রবাদ ও কথামালাগুলো একেবারে উল্টাসিধা-সাংঘর্ষিক। এর সুবাদে ঢাকার পানিও লাফায়। তা-ও হেঁটে হেঁটে বা দৌড়ে দৌড়ে নয়। রীতিমতো হাইজাম্প-লংজাম্প দিয়ে। পানি নিজে ফাল মেরে নিজের দাম হাকায়নি। তা হয়েছে ওয়াসার ইন্দনে।

পানি নিয়ে ওয়াসার অনেক কায়কারবার। আগে বছরে একবার তারা পানিকে শর্টজাম্প দেওয়াতো। এবার হাইজাম্প করিয়েছে। দরকার মনে করলে আরো দেওয়াবে। ঢাকাবাসী মাঝেমধ্যে ওয়াসা এবং ওয়াসার পানি নিয়ে আলতু-ফালতু কথা বলে। ওয়াসার পানিতে গন্ধ-ময়লা, অমুক-তমুক বলে অভিযোগ করে। এবার পানির দেমাগে এসব অভিযোগ ওয়াসার গায়েই লাগবে না। জাম্পে-জাম্পে পানির স্বাস্থ্য ভালো থাকবে। বিদ্যুতের ডিমান্ড জাম্পিং আরো হাই। তা বুঝেই পাইকারি, খুচরা ও সঞ্চালন- তিন ক্ষেত্রেই বিদ্যুতের দাম আরেক দফা বাড়িয়েছে সরকার।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/জেআইএম

এই মুহূর্তে বিদ্যুতের মূল্য বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেয়ার ঘটনা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়া লাগে না। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে চাল, ডাল, তেল, রসুনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। বাসাভাড়া বেড়ে যাবে। শিল্পে উৎপাদিত সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। জামা-কাপড়, জুতাসহ খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দামও বেড়ে যাবে- এসব কে না বোঝে? শক্তি জগতের পরাক্রমশালী আইটেম বিদ্যুতের নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের কব্জায়। লিকুইড সোসাইটির অন্যতম সদস্য পানিকে কদরহীন করে রাখার দিনও বহু আগেই শেষ।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।