আমি চাই ধর্ম বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু

প্রভাষ আমিন
প্রভাষ আমিন প্রভাষ আমিন , হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ
প্রকাশিত: ০৯:৪৪ এএম, ০২ মার্চ ২০২০

গণতন্ত্র নিয়ে প্রচলিত ধারণা হলো, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যেটা চাইবে, সেটাই হবে। এটাই যৌক্তিক মনে হয়। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠের এই গণতন্ত্র কখনো কখনো ন্যায্যতাকে পিষে দেয়। সংখ্যাগরিষ্ঠের গণতন্ত্র মানে কখনো কখনো গা জোয়ারিও। বেশি লোক যেটা বলবে, সেটা অন্যায্য হলেও মেনে নিতে হবে। আগে অনেকবার বলেছি, আবারও বলছি; আমি গণতন্ত্রের সংজ্ঞা শিখেছি বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘কেউ যদি ন্যায্য কথা বলে আমরা তা মেনে নেব, এমনকি তিনি যদি একজনও হন।’সংখ্যাগরিষ্ঠের মত অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তবে তারচেয়েও বড় কথা ন্যায্যতা। আর সংখ্যাগরিষ্ঠের গণতন্ত্রের একটা বড় ফাঁকি আছে। সংখ্যাগরিষ্ঠের রায় কিন্তু কোনো দলকে পাঁচ বছরের জন্য যা ইচ্ছা তাই করার স্বাধীনতা দেয় না, অন্তত দেয়া উচিত নয়। তারচেয়ে বড় কথা হলো, সংখ্যাগরিষ্ঠের রায় মানেই কিন্তু বেশিরভাগ মানুষের মত নয়। যেমন ভারতের ৩৭ ভাগ ভোটারের রায় নিয়ে পাঁচ বছরের জন্য ভারত শাসনের ক্ষমতা পেয়েছে বিজেপি। তার মানে ৬৩ ভাগ মানুষ কিন্তু এখনও তাদের বিপক্ষে।

বিজেপি কিন্তু ৬৩ ভাগ মানুষের মত উপেক্ষা করে যা ইচ্ছা তাই করছে। সংখ্যাগরিষ্ঠের রায় হয়তো, একটি দলকে পাঁচ বছরের জন্য দেশ শাসনের অধিকার দেয়, কিন্তু কোনোভাবেই একটি রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্র বদলে দেয়ার অধিকার দেয় না। নরেন্দ্র মোদী সরকার এখন যেভাবে গায়ের জোরে ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র পাল্টে দিয়ে ভারতে হিন্দুত্ববাদ কায়েমের চেষ্টা করছে, সে অধিকার কি ভারতের জনগণ তাদের দিয়েছে? এটা ঠিক, ধর্ম আর কট্টর জাতীয়তাবাদ রাজনীতিতে সফল হওয়ার সবচেয়ে সহজ তরিকা। বিশ্বে একসময় উদারনৈতিক আবহ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু গত কয়েকবছরে বিশ্বে আবার কট্টর জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মকে সামনে আনার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

বর্তমান বিশ্বে এই দুই ধারার নেতৃত্ব দিচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী আর ডোনাল্ড ট্রাম্প। কাকতালীয় হলো, দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা শুরু হয় তখন মোদী আর ট্রাম্প একসাথেই ছিলেন। ট্রাম্প জানেন কীভাবে, মার্কিনীদের জাত্যাভিমানকে উস্কে দিতে হয়। এটা করেই তিনি জিতে এসেছেন। সুশীল সমাজ যতই চিৎকার করুক, ট্রাম্প যতই পাগলামি করুক; আগামী নির্বাচনে তাকে ঠেকানো সহজ হবে না। মোদীর কাজটা আরো সহজ- ধর্মকে সামনে নিয়ে আসা এবং পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করা। ফর্মুলা মেনে গত নির্বাচনের আগে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলে মোদী বোঝাতে চেয়েছেন, ভারত শুধু তার হাতেই নিরাপদ। আর নির্বাচনের পর মাঠে নেমেছেন আসল এজেন্ডা বাস্তবায়নে।

এবার তার ব্রহ্মাস্ত্র- ধর্ম। ভারতের অর্থনীতি যখন খারাপের দিকে, নরেন্দ্র মোদী আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরেছেন ধর্মকে। সাম্পদ্রায়িকতা আর ঘৃণা সব মানুষের মধ্যেই কম বেশি আছে। ভালো নেতৃত্ব সেই সাম্প্রদায়িকতা আর ঘৃণাকে আড়াল করে মানুষের মধ্যে মানবিকতা জাগিয়ে তোলে। আর মোদীর মত নেতারা উস্কে দেয়। কারণ উস্কে দেয়াটা খুব সহজ। আমি নিশ্চিত, এই ফর্মুলায় এগুলে মোদীকে আগামী নির্বাচনেও ঠেকানো কঠিন হবে। কিন্তু বারবার হারতে হারতে বিরক্ত হয়ে ভালো নেতারাও যদি সাম্প্রদায়িকতা আর জাতীয়তাবাদে ঝুকে পড়ে; আসল বিপদটা আসবে তখন।

পৃথিবী আরো বাসের অযোগ্য হবে। ট্রাম্প আর মোদীর মধ্যে আরো একটা বিষয়ে মিল আছে। দুজনই টুইট করে দেশ শাসন করতে চান। তারা ঘন ঘন টুইট করেন। কিন্তু দিল্লির ঘটনার তৃতীয় দিনে টুইটে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে দায়িত্ব সারেন মোদী। বুঝতে অসুবিধা হয় না, দিল্লিতে যা হয়েছে, তা মোদীর অপছন্দের নয়। চারদিনে দিল্লি পুলিশের কাছে ১৩ হাজার ২০০ ফোন গেছে। কিন্তু পুলিশ কিছুই করেনি। কারণ ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নাম অমিত শাহ!

আর ট্রাম্প বলে দিয়েছেন, এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এই ‘অভ্যন্তরীণ ব্যাপার’টা অন্যায়কে আড়াল করার এক বড় অস্ত্র। কিন্তু বুঝতে হবে, এটা কোনো সাধারণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নয়। ধর্মের বিবেচনায় কিছু উন্মত্ত মানুষ সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালিয়েছে। দিল্লির ঘটনায় ৪২ জন মারা গেছে। তাই বিষয়টি মোটেই ভারতের অভ্যন্তরিন বিষয় নয়। এটা মানবতার প্রশ্ন। আর মানবতাটা বিশ্বের। তাই বিশ্বের যেখানেই মানবতা বিপন্ন হবে, সেখানেই প্রতিবাদ হবে। আর এই প্রতিবাদ করার অধিকার শুধু নয়, দায়িত্ব বিশ্বের সবার। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যার ঘটনায় মামলা করে গাম্বিয়া। তেমনি দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রতিবাদ জানানোর অধিকার সবার আছে। প্রতিবাদ শুধু নয়, প্রতিরোধ গড়তে হবে, যাতে এ ধরনের ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি না ঘটতে না পারে।

আগামী ১৭ মার্চে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানের প্রধান বক্তা নরেন্দ্র মোদী। দিল্লির ঘটনার পর বাংলাদেশে প্রবল জনমত গড়ে উঠছে, নরেন্দ্র মোদীকে যেন বাংলাদেশে আসতে দেয়া না হয়। আমিও চাই, বুক ভর্তি ঘৃণা আর সাম্প্রদায়িকতার রক্তে রঞ্জিত হাত নিয়ে নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশে না আসুন। বঙ্গবন্ধুর মত একজন অসাম্প্রদায়িক নেতার জন্মশতবার্ষিকীতে নরেন্দ্র মোদীর মত কোনো সাম্প্রদায়িক নেতার উপস্থিতি বড্ড বেমানান। এতে বঙ্গবন্ধুকেই অপমান করা হয়। কিন্তু বাস্তবতাটাও বুঝি। আমরা যে আবেগে মোদীর আগমনের প্রতিবাদ করছি, সরকারের পক্ষে তার প্রকাশ ঘটানো সম্ভব নয়। রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক সাধারণ মানুষের আবেগে চলে না। চাইলেও এখন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে নরেন্দ্র মোদীকে আসতে না করা সম্ভব নয়।

নরেন্দ্র মোদী আসলে তাকে অনিচ্ছায় হলেও স্বাগত জানাতে হবে। আর সম্পর্কটা শেখ হাসিনা-নরেন্দ্র মোদী বা আওয়ামী লীগ-বিজেপির নয়। এটা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বিষয়। বঙ্গবন্ধুর বিপদের সময়, বাংলাদেশের প্রয়োজনের সময় ভারত আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। তাই বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকীতে ভারতের সর্বোচ্চ প্রতিনিধিত্ব থাকাটা এক ধরনের দায় শোধ, কৃতজ্ঞতার প্রকাশ। আমন্ত্রণটা ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে করা হয়েছে, ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদীকে নয়। আমি জানি এখন যদি কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকতো, আর গান্ধী পরিবারের কাউকে আমন্ত্রণ জানাতে পারতো; তাহলেই আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বেশি খুশি হতো। কিন্তু সবসময় সবকিছু আমাদের ইচ্ছামত হয় না। আমরা প্রতিবাদ করতে পারবো। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী যদি নিজে থেকে সফর বাতিল না করেন, তাহলে তার আসা ঠেকানোর আর কোনো উপায় নেই।

ভারতের জনপ্রিয় শিল্পী সুমন চট্টোপাধ্যায়, ইদানীং যিনি কবির সুমন নামে পরিচিত; দুই দশকেরও বেশি সময় আগে লিখেছিলেন, ‘আমি চাই বিজেপি নেতার সালমা খাতুন পুত্রবধূ, আমি চাই ধর্ম বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু’। কিন্তু সুমনের চাওয়ার সাথে এখন পাওয়ার আকাশ-পাতাল ব্যবধান। বিজেপি নেতা সালমা খাতুনকে পুত্রবধূ তো করবেনই না। বরং সালমা খাতুনদের পেলে পুড়িয়ে মারছেন। মানুষকে মানুষ হিসেবে বোঝার ধারণাটাও নেই বিজেপির পান্ডাদের। দেখে তো আমরা মানুষই চিনি। ধর্ম চিনতে হলে, আমাদের আরো কষ্ট করতে হয়। একাত্তরে বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদাররা পোশাক খুলে মানুষের ধর্ম পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করেছে। এবার দিল্লিতেও তার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। কিন্তু বোকা বিজেপি জানেই না, মানুষই সবার ওপরে, ধর্ম দিয়ে তাকে খাটো করা যায় না। এই বোকাদের জন্য লালন সাই গেয়ে গেছেন, ‘সুন্নত দিলে হয় মুসলমান, নারী জাতির কী হয় বিধান, ব্রাক্ষণ চিনি পৈতে প্রমাণ, বামনি চিনি কিসেরে’।

বিজেপির ধর্মান্ধ পান্ডারা দাঙ্গা লাগিয়ে ৪২ জনকে হত্যা করেছে বটে, তবে দিল্লিতেও কিন্তু মানবতারই জয় হয়েছে। সাধারণ মানুষের কিন্তু ধর্ম নিয়ে মাথাব্যথা নেই। বছরের পর বছর পাশাপাশি থাকা মানুষগুলো প্রতিবেশীকে মানুষ হিসেবেই বিবেচনা করেছে, জীবন দিয়ে আগলে রেখেছে। অন্তঃসত্ত্বা মুসলমান নারীকে হাসপাতালে নিতে জীবনের ঝুঁকি নেয় হিন্দু যুবক। ছয় মুসলমানকে আগুন থেকে বাঁচিয়ে নিজেই এখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে এক হিন্দু যুবক। হিন্দু মন্দির পাহাড়া দেয় মুসলমানরা। শুক্রবার দেখলাম মুসলমানরা জুমার নামাজ পড়ছে। আর হিন্দু প্রতিবেশীরা মানববন্ধন করে তাদের রক্ষা করছে। এই ছবিগুলো দেখলে এত বেদনায়ও মন ভালো হয়ে যায়। ঘৃণার আগুনে দিল্লি পুড়েছে বটে। কিন্তু তাতে মানবতা পুড়ে যায়নি। বরং মানবতার পতাকা আরো উঁচুতে উড়ছে। একদিন নিশ্চয়ই মহাত্মা গান্ধীর অহিংস ভারতে সাম্প্রদায়িকতাকে প্রত্যাখ্যান করবে মানুষ। বিজেপি নেতারা হয়তো সালমা খাতুনদের পুত্রবধূ করবেন না। কিন্তু একদিন নিশ্চয়ই সুমনের চাওয়া পূরণ হবে; ধর্ম বলতে মানুষ শুধু মানুষই বুঝবে।

Provas-Amin-1

এইচআর/পিআর

সাধারণ মানুষের কিন্তু ধর্ম নিয়ে মাথাব্যথা নেই। বছরের পর বছর পাশাপাশি থাকা মানুষগুলো প্রতিবেশীকে মানুষ হিসেবেই বিবেচনা করেছে, জীবন দিয়ে আগলে রেখেছে। অন্তঃসত্ত্বা মুসলমান নারীকে হাসপাতালে নিতে জীবনের ঝুঁকি নেয় হিন্দু যুবক। ছয় মুসলমানকে আগুন থেকে বাঁচিয়ে নিজেই এখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে এক হিন্দু যুবক। হিন্দু মন্দির পাহাড়া দেয় মুসলমানরা। শুক্রবার দেখলাম মুসলমানরা জুমার নামাজ পড়ছে। আর হিন্দু প্রতিবেশীরা মানববন্ধন করে তাদের রক্ষা করছে। এই ছবিগুলো দেখলে এত বেদনায়ও মন ভালো হয়ে যায়। ঘৃণার আগুনে দিল্লি পুড়েছে বটে। কিন্তু তাতে মানবতা পুড়ে যায়নি। বরং মানবতার পতাকা আরো উঁচুতে উড়ছে। একদিন নিশ্চয়ই মহাত্মা গান্ধীর অহিংস ভারতে সাম্প্রদায়িকতাকে প্রত্যাখ্যান করবে মানুষ। বিজেপি নেতারা হয়তো সালমা খাতুনদের পুত্রবধূ করবেন না। কিন্তু একদিন নিশ্চয়ই সুমনের চাওয়া পূরণ হবে; ধর্ম বলতে মানুষ শুধু মানুষই বুঝবে

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।