লাউ বাজারেও করোনাভাইরাস!
করোনার ছুঁতা টুথপেস্টেও। কুমিল্লার লতি, নরসিংদীর লাউ, সাভারের কুমড়ারও রক্ষা নেই। ভৈরবের শুঁটকি- গাজীপুরের মুলাও বাদ যাবে কেন? করোনার অজুহাত যে যেখান দিয়ে পারছেন দাঁড় করাচ্ছে। সফল হচ্ছে । আদায় করে ছাড়ছে বাড়তি দর ও সার্ভিস। করোনার সর্বনাশ এ সেক্টরের সিন্ডিকেটের জন্য পৌষমাস হয়ে দেখা দিয়েছে।
করোনাক্রান্ত চীন বিভিন্ন দেশের শিল্প-কারখানার কাঁচামাল, মেশিনারিজ পণ্য, ইলেক্ট্রনিক্স, খেলনা ও কাপড়সহ বিভিন্ন পণ্যের বড় উৎস হওয়ায় সংশ্লিষ্ট পণ্যের দাম বাড়বে- এমনটা মানতে বাধ্যগত অবস্থায় মানুষ। চীনের সঙ্গে দেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। বন্ধ হয়ে গেছে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিও। তারওপর দুর্বল এবং নিয়ন্ত্রণহীন বাজারব্যবস্থাপনা। এই সুযোগ ব্যবসায়ীরা নেবে, সেই প্রস্তুতি রয়েছে অনেকের। কিন্তু, তা এতো চরমপন্থায়? নিষ্ঠুরতায়? ঘাতক করোনার অজুহাতে যথেচ্ছা ব্যবসার ধুম চীনা পণ্য ছাড়িয়ে গেছে। চীনের সঙ্গে সামান্যতম সম্পর্ক নেই-এমন সব পণ্যের দামও আকাশছোঁয়া।
করোনার হানার পর থেকে চীন থেকে আমদানি করা সব পণ্যের দাম ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়েছে। বেশি বাড়ানো হয়েছে কাপড়, শিশুদের খেলনা, ইলেকট্রনিক্স-মেশিনারিজসহ অন্যান্য পণ্যের দাম। এ অবস্থা আর কিছুদিন থাকলে দামের পাগলাঘোড়ার দাবড়ানি দাবানো কঠিন হবে। সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলা সহজ হবে উদ্দেশ্যবাদীদের। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের কাছে এ কারসাজি ও সিন্ডিকেট সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কিছু তথ্য আছে। তার কিছু তারা জানিয়েছে বাণিজ্যমন্ত্রণালয়কে। বাজার, গুদাম, আড়তে কোনো পণ্যের ঘাটতি রয়েছে কি-না, থাকলে তা কোন পরিমানে- সেটা জানার ব্যবস্থা সরকারের রয়েছে। চাল, পিঁয়াজ, চিনি, ডাল, মসলাজাতীয় পণ্যের দাম বাড়ানোর হোতারা সরকারের অচেনা নয়।
সামনে রমজান মাস। রোদ-বৃষ্টি, শীত-গরম, বন্যা-খরায় নিত্যপণ্যের বাজারে আগুন ধরানোতে পারঙ্গদের কাছে রোজা-ঈদ একটি বিশেষ মৌসুম। আলামত বলছে, চক্রটি এবার রমজানের বেশি আগেই সেই হোমওয়ার্ক করে রেখেছে। এখনই বিষয়টি আমলে না নিলে এদের নিয়ন্ত্রণ কষ্টসাধ্য হবে। নানা উদ্বেগ-শঙ্কার মধ্যেও ভালো খবর হচ্ছে বাস্তবের নিষ্ঠুরতায় ভারতের ওপর পেঁয়াজের নির্ভরশীলতা কমিয়ে মিসর, তুরস্ক, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশের দিকে ঝুঁকেছে সরকার। রসুন, আদা, ডাল, তেল, বুট, ছোলা, চিনি, মসলাসহ আরো কিছু পণ্যের ব্যাপারেও দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। এ ক্ষেত্রে টিসিবিকে আরো কার্যকর, নিয়মিত বাজার মনিটর অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। মনে না রাখলেই নয়, নিত্যপণ্যের বাজারে অশনি সংকেত দিয়ে শুরু হয়েছে চলতি বছরটি। এ বছরটির গুরুত্ব আলাদা। নামেও ভিন্নতা । মুজিববর্ষ।
বছরের শুরুতেই বাজারে উত্তাপের জেরে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে কঠিন কথা। বলেছেন, আগুনের মধ্যে বাস করছেন তিনি। কথাটা তিনি পেঁয়াজের দামের জেরে বলে থাকলেও বাজারের আরো বেশ কিছু পণ্যেই আগুণের ঝলকানি। মাসখানেক ধরে দেশি নতুন পেঁয়াজ বাজারে এলেও আগুন দমেনি। পেঁয়াজের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থাকা অবস্থায়ই মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো চালের আক্রমণ। চালের মূল্যবৃদ্ধি মানূষকে তাড়িত বেশি করে। চলতি সপ্তাহে কেজিতে পাঁচ থেকে দশ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। অথচ সরকারি হিসাব বলছে, চালের দাম কমেছে। আড়তদার, মিল মালিক কিংবা খুচরো বিক্রেতা- সবাই একবাক্যে বলছেন এ সময়ে এভাবে চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। তা’হলে অকারণে বাড়ছে কেন? কেনই বা বাড়তির তথ্য অস্বীকারের অপচেষ্টা? গত বছর নভেম্বরের এই সময়েও চালের দাম হুট করে বেড়ে গিয়েছিলো। তারও আগে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরেও চাল নিয়ে এমন কাণ্ড হয়েছে।
চাল এ সরকারের জন্য তুলনামূলক বেশি স্পর্শকাতর। ১০ টাকা কেজিতে চাল খাওয়ানো নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা তামাদি হয়নি এখনো। আবার সরকারি তথ্য-উপাত্তে খাদ্যে বিশেষ করে ধান উৎপাদনে গর্ব করার বিষয় রয়েছে। উল্টোদিকে চালসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম মনিটরিংয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সমন্বয়হীনতার পাশাপাশি বিস্তর হেরফের-ফাঁকজোক। একেক সংস্থা একেক তথ্য দিচ্ছে। বিভ্রান্ত করছে। এতে সরকারের খাদ্য নিরাপত্তাবিষয়ক পদক্ষেপগুলো পদে পদে মার খাচ্ছে। কৃষি-কৃষকের সঙ্গে তা সরকারকেও কম মার খাওয়াচ্ছে না।
সরকার বিদেশ থেকে বিমানে চড়িয়ে পেঁয়াজ এনেও বাজারে তেমন প্রভাব ফেলতে না পারার পেছনেও রয়েছে এদের সম্পৃক্ততা। রকেট গতিতে দাম বেড়ে ২৬০-৭০ টাকা কেজিতে ওঠা পেঁয়াজের দাম কমছে ঠেলাগাড়ির গতিতে। এরই মধ্যে দামের পাগলা ঘোড়া সওয়ার হয়েছে চাল, চিনি, ভোজ্যতেল, আটা-ময়দা, ডিম, এলাচ-মসলাসহ বেশ ক’টি নিত্যপণ্যের ওপর। এ তালিকায় চলে এসেছে মসুর ডাল, আলু, রসুন, শুকনা মরিচ, হলুদ, জিরা, গুঁড়া দুধসহ বেশ ক’টি নিত্যপণ্য।
বাদ পড়েনি শীতের সবজিও। এতে সীমিত আয়ের মানুষ নাস্তানাবুদ। নিম্নবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্তের কষ্টটা বেশি। পরিস্থিতির অনিবার্যতায় এ নিয়ে প্রতিবাদ নেই সত্য। কিন্তু ঘাটে-মাঠে কথার খই ফুটছে। অনেকেই বলছেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর নিয়ন্ত্রণে সরকার যেই মাত্রায় সফল, বাজার সিন্ডিকেটের ওপর ওই মাত্রায়ই ব্যর্থ। এই সিন্ডিকেট এগুচ্ছে একেবারে ফ্রিস্টাইলে। ডেমকেয়ারে। এরা ধরেই নিয়েছে, কোথাও থেকে বাধা আসবে না। প্রতিবাদে মানুষও রাস্তায় নামবে না।
পেঁয়াজের অস্থিরতার মধ্যেই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আদা-রসুনেরর দাম। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চীনা রসুন বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২২০ টাকা। দেশী নতুন রসুন পাওয়া যাচ্ছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা কেজিদরে। দেশী আদা ১৭০ থেকে ১৮০ টাকায় বিক্রি হলেও চীনা আদা বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়। কিছু ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির পেছনে কারণ অবশ্যই করোনা। কিন্তু, কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে করোনার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। কেরানিগঞ্জ-জিঞ্জিরায় তৈরি মালামালের দাম বাড়ানোর পেছনেও করোনাকে দাঁড় করানো হচ্ছে অজুহাত হিসেবে।
চীন থেকে আমদানিপণ্য না হলেও ঢাকার বাজারে একেকটি লাউ বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজিদরে বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি করলা। ভোগ্য পণ্যের মূল্যের এ অস্থিরতায় হিমসিম অবস্থা স্বল্পআয়ীদের। এক সপ্তাহের ব্যবধানে পাইকারিতে রসুনের দাম বেড়েছে কেজিতে ২০ থেকে ২৫ টাকা। খুচরা বাজারে বেড়েছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা। প্রশ্ন হচ্ছে, চীন থেকে আগে আনা রসুনগুলো গেল কই?
লেখক : সাংবাদিক-কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/এমকেএইচ