পাপিয়াদের গডফাদাররা কি থেকেই যাবে অদৃশ্যমান?

জব্বার হোসেন
জব্বার হোসেন জব্বার হোসেন , সাংবাদিক, কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৭:১৭ পিএম, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০

আমার পরিধি খুব ছোট, কাজের গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এমন নয় যে আমার অনেক বন্ধু আছে, তাদের সঙ্গে আড্ডা দেই, ঘুরতে যাই, বেড়াই। তবুও এই সীমিত পরিসরেই সেমিনার-বক্তৃতায় অনুষ্ঠানে শুরুতে-শেষে কিছু লোক আসে সেলফি তুলতে। বলে, আপনি লেখেন, বক্তৃতা করেন, উপস্থাপনা করেন- ‘একটা ছবি নিই আপনার সঙ্গে?’ মন্দ লাগে না, বলি নিশ্চয়ই কেন নয়। আসুন প্লিজ। নারী আসে, পুরুষ আসে। সেলফি তোলে। কেউ কেউ বলে, একটু হাত রাখবেন কাঁধে? একটু বিব্রত হই। তবু হাত রাখি কাঁধে। আমার মতো ক্ষুদ্র-তুচ্ছ সামান্য একজন মানুষ, তার সঙ্গে সেলফি তুলতে চাইছে; কেন বারণ করব তাকে?

এই যে, ‘ছবি তুলতে চাওয়া’ সেলফির দল। নারী-পুরুষ। তাদের কেউই আমার পরিচিত নয়। কাউকেই চিনি না। চেনা সম্ভবও নয়। জানি না তাদের ভালো-মন্দ, কী তাদের পরিচয়। আমার পক্ষে সম্ভবও নয়, তাদের ভালোভাবে জানা। আর চেনা মানুষকেই বা কতটুকু চেনা যায়!

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তোলপাড় বহিষ্কৃত যুব মহিলা লীগ নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়ার খবর আর ছবিতে। কার সঙ্গে তার ছবি নেই? খোদ মহামান্য রাষ্ট্রপতি, বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, মেয়র আতিকুল ইসলাম, সাবেক এমপি সাবিনা আক্তার তুহিন সবাই আছেন তার সঙ্গে। এই ‘তার সঙ্গে’র অর্থ কিন্তু তাদের পাপিয়ার সঙ্গে সখ্য কিংবা তারা পাপিয়ার অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত, সম্পৃক্ত এমন নয়। বরং সাম্প্রতিক রাজনীতিতে ‘সেলফি’ যে একটি অস্ত্র ও রোগে পরিণত হয়েছে সেটি উল্লেখযোগ্য। আর অনুপ্রবেশকারী, দূরাচারী, সুযোগসন্ধানীদের কাজই তো ওতপেতে থাকা সুযোগ নেয়ার জন্য, যাতে পরে নাম ভাঙানো যায় সুবিধামতো।

সবচেয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন সাবিনা আক্তার তুহিন, সাবেক এমপি। যুব মহিলা লীগের পিকনিকে পাপিয়া তার সঙ্গে বেশ কিছু ছবি তুলেছেন। হয়তো সে-ই এসে ছবি তুলেছে তুহিনের সঙ্গে। এখন আরেক দল সুযোগসন্ধানী কার কার সঙ্গে পাপিয়ার ছবি আছে তা ‘ইস্যু’ করতে চাইছে। সাবিনা আক্তার তুহিন তো ত্যাগী একজন রাজনীতিবিদ। যিনি জীবনকে তুচ্ছ করে বহুবার রাজপথে নেমেছেন দলের জন্য, কোনো অনুপ্রবেশকারী তো তিনি নন। ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি তুহিন। জেলা কমিটি দেয়ার কোনো এখতিয়ারও তার নেই। তাহলে শুধু একসঙ্গে ছবি থাকার কারণে সাবেক এমপি তুহিনকে নিয়ে এত বিষোদগার কেন?

শুধু ছবি দিয়ে কি কারও সঙ্গে কারও সখ্য, প্রকৃত সম্পর্ক নির্ণয় করা যায়? আমি তো ব্যক্তিগতভাবে এমন অনেক স্বামী-স্ত্রীকে জানি যারা ঘণ্টায় ঘণ্টায় জড়াজড়ি, চুমাচুমির যুগল ছবি আপ করে কিন্তু ঘরের ভেতর চুলাচুলি, মারামারি, তুই-তোকারির তুলকালাম।

সমস্যা ছবিতে নয়। ছবি কোনো সমস্যাও নয়। সমস্যা অন্যখানে, রাজনৈতিক দূষণ বাড়ছে। কলুষ বাড়ছে। আগাছা বাড়ছে। আবর্জনা বাড়ছে। পাপিয়ারা বাড়ছে। পাপিয়া একা নয়, এমন পাপিয়া অসংখ্য চারপাশে। কেবল গ্রেফতার হলে, খবর হলেই জানার সুযোগ হয়, তা নয়তো নয়। পাপিয়া নিশ্চয়ই একদিনে ‘পাপিয়া’ হয়ে ওঠেনি, দলীয় সমর্থন-ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তবে দলের ভেতর থেকে কে বা কারা তাকে ‘সাপোর্ট’ দিত? কাদের ‘শেল্টার’ নিত সে, তা বিবেচ্য। তাকে জেলা কমিটিতে স্থান দিয়েছিল যারা, তারা কারা? তা ভাববার, অনুসন্ধানের বিষয়। কারা তারা, কোথায় তারা? অপরাধের সঙ্গে নারী বা পুরুষে কোনো সম্পর্ক নেই, অপরাধ অপরাধই।

প্রশ্ন জাগে পাপিয়াদের শক্তির উৎস কোথায়? অস্ত্র-মাদক, পতিতাবৃত্তি, টাকা পাচার সকল অপরাধমূলক ব্যবসাই ছিল তার। তবে তার ‘ক্লায়েন্ট’ ছিল কে বা কারা, তারা কোথায়? মেয়েদের সে বাধ্য করত বিভিন্ন প্রলোভন ও ভীতি প্রদর্শন করে। কিন্তু যেসব ‘পুরুষ’ এই সব বাধ্য তরুণীদের সঙ্গী হতো, মিলিত হতো, মৈথুন করত তারা তো আর বাধ্য নয়, অবলা নয়, বীরপুরুষ! কোথায় সেসব ‘পুরুষ’? যারা ওয়েস্টিনের ‘প্রেসিডেন্সিয়াল’ স্যুটে এসে থাকত, রগড় করত, রমন করত?

সমস্যা আরও আছে, পাপিয়াদের কারণেই শিক্ষিত, মার্জিত, ভদ্র পরিবারের মেয়েরা রাজনীতিতে আসতে চাইবে না। মনে করবে এখানে আসলে, ‘এইসব’ই হয়। পাপিয়া সবাই। অনুপ্রবেশকারী, সুবিধাবাদী, দুর্জন কেউ আর এখন বাইরে নেই। আওয়ামী লীগ নামক দলটির ভেতরে সবাই। যতদিন যাচ্ছে ‘জয় বাংলা’ আর ‘জিন্দাবাদ’ মিলেমিশে একাকার হচ্ছে। কোনো বাছবিচার নেই আওয়ামী লীগ সবাই।

এমনকি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের আদর্শে বিশ্বাসী সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মৌসুমী, পূর্ণিমা, বিজরী বরকতুল্লাহ, কেয়া, তারিনদের মতো সক্রিয়ভাবে জাসাস করা, যাদের হাওয়া ভবনে যোগাযোগ-যাতায়াত ছিল, তাদেরও এখন গণভবনে যাতায়াত নিয়মিত। জাসাসে সক্রিয় ছিলেন যে নাজিম শাহরিয়ার জয়, তিনিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক’দিন আগে ‘মা’ ডেকেছেন। ভুলে গেলে চলবে না ৭৫-এ কোনো বিরোধীদল ছিল না। ২০২০-এ খালেদা জিয়া আর তারেক রহমান ছাড়া সবাই আওয়ামী লীগার!

মনে রাখতে হবে, রাজনীতি যখন উপার্জনের উপায়, ভোগবাদিতার সুযোগ, অন্যায় করার ‘ওপেন সার্টিফিকেট’ বলে ভাবা হয়- তখনই সমস্যা। অন্যায় সেখানেই। উপড়ে ফেলতে হবে অসুস্থ চিন্তা, পঙ্কিল মানসিকতা আর বিকৃত ভোগবাদিতা। রাজনীতি হতে হবে মানুষের জন্য। মানুষের জীবনমানের পরিবর্তনের জন্য। তা না হলে এমন পাপিয়াদের জন্ম হতেই থাকবে। আর গডফাদাররা থেকে যাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে, অদৃশ্যমান।

লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।

এইচআর/বিএ/জেআইএম

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।