মুক্তি পাচ্ছেন খালেদা জিয়া?
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কি সহসা মুক্তি পাচ্ছেন? মুক্তি পেলে কীভাবে? জামিনে, না প্যারোলে? এ ব্যাপারে বিএনপি এবং সরকারের অবস্থান এখনও ভিন্ন। বিএনপি চায় তার জামিন। বেগম জিয়া নিজে মনে করেন, জামিন পাওয়া তার ‘হক'। সরকার সেটা মনে করে না। খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তির আবেদন করলে সরকার নমনীয়তা দেখাতে পারে বলে মনে হচ্ছে। পরিবারের পক্ষ থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বেগম জিয়ার বিদেশ যাওয়ার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এজন্য আদালতে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য আগেদন করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ নিয়ে কথা বলেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে। এটা একটি অগ্রগতি। তবে বেগম জিয়ার মুক্তির প্রশ্নে সরকার এবং বিএনপির মধ্যে একটি মনস্তাত্ত্বিক বাধা কাজ করছে বলে মনে হয়। কোনো পক্ষই এক্ষেত্রে হার মানতে চায় না। খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়ে বিএনপিকে ‘উল্লাস' করতে দেবে না সরকার। কিন্তু বিএনপি তাদের নেত্রীকে কারামুক্ত করে কিছুটা রাজনৈতিক সুবিধা পেতে চায়।
দুটি দুর্নীতি মামলায় ১৭ বছরের দণ্ড নিয়ে কারাগারে আছেন বিএনপি চেয়ারপাসন খালেদা জিয়া। তার জেলজীবনের দুই বছর পূর্ণ হয়েছে গত ৮ ফেব্রুয়ারি। দুই বছরে তার মুক্তির বিষয়টি একাধিকবার আলোচনায় এসেছে। কিন্তু বেগম জিয়ার কারামুক্তি ঘটেনি। সরকারের সঙ্গে কোনো সমঝোতা না হলে খালেদা জিয়ার মুক্তিলাভ সম্ভব নয়- এটা এখন সবাই বোঝেন। আন্দোলন কিংবা আইনি প্রক্রিয়ায় দলীয় প্রধানকে যে এখনই বাইরে আনা যাচ্ছে না এটাও নিশ্চয়ই বিএনপি বুঝতে পারছে। তবে কোন উপায়ে তাকে মুক্ত করা যাবে, তা নিয়ে বিএনপিতে মতপার্থক্য আছে। তবে এখন সম্ভবত বিএনপি যেকোনো উপায়ে তাদের নেত্রীকে মুক্ত করতে চায়। আন্দোলন কিংবা আইনি প্রক্রিয়ায় তিনি মুক্ত হলে বিএনপির লাভ হতো। বলতে পারতো, সরকার তাকে আটকে রাখতে পারলো না। সরকার এই সুযোগ বিএনপিকে দিতে চায় না বলেই সরকার চায় বেগম জিয়া প্যারোলে মুক্তির আবেদন করুন। এটা করলে বেগম জিয়ার চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়া সহজ হতে পারে। বিএনপির সামনে এখন সরকারি শর্ত না মানার বিকল্প নেই বলেই মবে হচ্ছে।
বেগম জিয়ার দুটি দুর্নীতি মামলার রায় হওয়ার আগে বিএনপি যতো হম্বিতম্বি করেছিলো, রায় হওয়ার পর আর সেটা দেখা যায়নি। বিএনপি প্রথম ভেবেছিলো, আর যাই হোক তাদের নেত্রীকে সাজা দিয়ে কারাগারে নেয়া হবে না। খালেদা জিয়াকে জেলে নিলে দেশে বিরাট আন্দোলন হবে বলেও বিএনপি ধারণা করেছিলো। বিএনপির কোনো ধারণাই সঠিক হয়নি। খালেদা জিয়া দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। নিম্ন আদালত যে শাস্তি দিয়েছেন, উচ্চ আদালত তা বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাকে জেল খাটতে হচ্ছে। তার মুক্তির দাবিতে বড়ো কোনো আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। বিএনপির সিনিয়র আইনজীবীরা মনে করছেন, আইনি প্রক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার মুক্তি সম্ভব নয়। তাকে মুক্ত করতে হবে গণআন্দোলনের মাধ্যমে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে দেশে কি আদৌ কোনো আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব? বিএনপির অন্ধ সমর্থকরাও সম্ভবত দেশে আশু কোনো আন্দোলন গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখেন না, আশাও করেন না। মুখে বড় বড় কথা বলেন। হেন করেঙ্গা, তেন করেঙ্গা বলেন কিন্তু তাতে মানুষের মধ্যে কোনো ভাবান্তর হয় না। বিএনপির বিভিন্ন কমিটিতে যাদের নাম আছে তারাও সবাই দলীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন না, উপস্থিত থাকেন না। গ্রেপ্তার আতঙ্ক বিএনপিকে কাবু করে রেখেছে।
বিএনপি একটি চরম দুঃসময় পার করছে। কীভাবে তারা অগ্রসর হলে দল গোছাতে পারবে, কোন কৌশল অবলম্বন করলে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন তারা পাবে, সেটা বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব নির্ধারণ করতে পারছেন না। বেগম জিয়া কারাগারে যেতে পারেন, তার অনুপস্থিতে দল কীভাবে চলবে, সে বিষয়গুলো তারা আগে থেকে ভেবে রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি। ‘সরকার কিছুই করতে পারবে না'- এই রকম একটি মনোভাব বিএনপির মধ্যে প্রবল থাকায় তারা কিছুই করতে পারলো না, করতে পারছে না। দিন যতো যাচ্ছে, বিএনপির সমস্যা ততো বাড়ছে। জনপ্রিয়তা নিয়ে এক ধরনের মোহগ্রস্ততা বিএনপির আছে। বিএনপি নেতৃত্ব পরিবর্তিত বাস্তবতা উপলব্ধিতে নিতে পারেননি। দেশজুড়ে বিএনপির সমর্থক-শুভাকাঙ্ক্ষী থাকলেও, তাদের মাঠে নামার মতো কর্মী কম। সে জন্যই বিএনপিকে কেউ আন্দোলনের দল বলে মনে করেন না। এই দল আন্দোলন করে গত এক দশকে সরকারের ওপর কার্যকর চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি। বরং সন্ত্রাস-সহিংসতা করে মানুষকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলেছে।
নানা কারণে বিএনপি দিন দিন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরাসরি কোনো যোগাযোগ এই দলের নেই। তারা আওয়ামী লীগ সরকারের সব কাজের সমালোচনা-বিরোধিতা করে। সরকার কোনো ভালো কাজ করেনি বা করে না বলে প্রচার করে। বিএনপির এই ঢালাও সরকারবিরোধিতা মানুষ পছন্দ করে না। সরকারের কিছু ভালো কাজের সরাসরি উপকারভোগী মানুষের সংখ্যা যে কয়েক কোটি– এটা বিএনপি বুঝতে চায় না। সরকারের কোন নীতি বা পদক্ষেপ সাধারণ মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে সেটা নির্দিষ্ট না করে ঢালাও সমালোচনা করার পুরনো পথে হেঁটেছে বিএনপি। সরকারের কোন কাজের বিরোধিতা করলে মানুষের সমর্থন পাওয়া যাবে– বিএনপি তা বোঝার চেষ্টা করেনি।
তাছাড়া বিএনপি ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগের চেয়ে ভালোভাবে দেশ চালাবে – এটাও মানুষ বিশ্বাস করে না। ঘুষ-দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি-দলীয়করণ ইত্যাদি নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ-অসন্তোষ আছে কিন্তু মানুষ আবার এটাও মনে করে না যে, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে এসব অনিয়ম-অনাচারের অবসান ঘটবে। আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে মানুষ যতোদিন বিএনপির কথা না ভাববে ততোদিন বিএনপিকে অপেক্ষায় থাকতে হবে।
খালেদা জিয়া দুই বছর ধরে কারাগারে আছেন। তাকেও আত্মজিজ্ঞাসার সম্মুখীন হতে হবে। কেন তার দল মানুষকে কাছে টানতে পারছে না, বিএনপির কোন নীতি-কৌশল মানুষ পছন্দ করছে না, কোথায় কোথায় পরিবর্তন আনতে হবে, সেসব তাকে বুঝতে হবে। বিএনপি যেভাবে চলছে সেভাবে চলে আর কিছু অর্জন করতে পারবে না। বৃত্ত ভাঙার সাহস দেখাতে হবে। পুরনো পথ নয়, মানুষকে রাজনীতির নতুন পথ দেখাতে হবে। তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ। তিনি আর দেশের রাজনীতির প্রধান ভূমিকায় ফিরতে পারবেন না– এই বাস্তবতা মেনে নিয়েই তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জামিন না পেলে তিনি মুক্তি পাওয়ার অন্য পথ গ্রহণ করবেন না– এই জেদ নিয়ে বসে থাকলে সুফল পাবেন না।
প্যারোলে মুক্তির পক্ষে মত দিয়ে তিনি তার পরিবার এবং দলকে স্বস্তি দিতে পারেন। সরকার বা আওয়ামী লীগ এখন সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। তাই সরকার খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছে– এমন কথা বলার সুযোগ বিএনপিকে দিতে চাইবে না সরকার। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে,বেগম জিয়া প্যারোলে মুক্তির আবেদন করলে সেটা বিবেচনা করা হবে। বেগম জিয়ার পরিবার যেকোনো উপায়ে তাকে মুক্ত করার পক্ষে। বিএনপির কট্টরপন্থীরাও এখন নরম বলেই শোনা যায়। তাহলে সমস্যা কোথায়? সমস্যা বোধহয় এটাই যে, প্যারোলে মুক্তি নিলে বিএনপি এই ইস্যুতে কোনো রাজনৈতিক ‘বেনিফিট' পাবে না। বেগম জিয়ার মুক্তির বিষয়টিকে বিএনপি ‘মানবিক' দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার কথা বলছে। তাহলে বিএনপিকেও এক্ষেত্রে রাজনৈতিক লাভ খোঁজা বাদ দিতে হবে। প্যারোলের আবেদন করলে এ দফায় বেগম জিয়ার মুক্তি আর বিলম্বিত না হওয়ারই কথা। এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে বেগম জিয়াকে, তার দলকে।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
এইচআর/জেআইএম