বইমেলা ও বইয়ের পাঠক
ফেব্রুয়ারি এলে আমাদের ভাষার চেতনা একটু বেশি উদ্দীপিত হয়। অনেকে এটিকে তীর্যক চোখে দেখেন। কিন্তু ফেব্রুয়ারির সঙ্গে শুধু মাতৃভাষা নয়, বরং এর সঙ্গে যেহেতু আমাদের স্বাধীকারের প্রশ্নটিও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত এবং ভাষার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বইনির্ভরজ্ঞান—ফলে ফেব্রুয়ারি এলে আমরা মাতৃভাষার মর্যাদা নিয়ে যেমন সোচ্চার হই, তেমনি অমর একুশে গ্রন্থমেলাকে উপলক্ষ্য করে সামনে আসে মুদ্রিত বইয়ের বিক্রি ও পাঠকপ্রিয়তার প্রসঙ্গটিও। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইন্টারনেটভিত্তিক জ্ঞানচর্চার চ্যালেঞ্জ ও বিপত্তি; বিশেষ করে গুগলনির্ভর তথ্যের বিভ্রান্তি।
যে প্রশ্নটি বহুদিন ধরেই জনমনে রয়েছে এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে যে আলোচনাটি মূলধারার গণমাধ্যমেও বিবিধ তর্কের জন্ম দেয়, তা হলো—এই ইন্টারনেট সময়ে কে বই পড়ে, কতজন পড়ে এবং যারা পড়ে তারা আসলে কী পড়ে? অন্যদিকে একটা সময় পর্যন্ত জেলা পর্যায়ের সরকারি গণগ্রন্থাগার এবং পাড়া-মহল্লায় ক্লাবভিত্তিক ছোট গ্রন্থাগারকেন্দ্রিক যে জ্ঞানচর্চার অভ্যাস ছিল, সেটি কেন এখন অতীত হবার পথে? কেন সরকারি গণগ্রন্থাগারে শুধু চাকরিপ্রার্থীরা গিয়ে শুধু গাইডবই পড়ে? শেলফের অন্যান্য মমনশীল বইগুলোয় কেন ধুলোর আস্তরণ জমে যাচ্ছে?
ইন্টারনেট সারা পৃথিবীকে ছোট করে এনেছে। মানুষে মানুষে যোগাযোগ সহজ করেছে। কিন্তু এর বিপরীত হলো, ইন্টারনেট মানুষকে অস্থির করে তোলে এবং কোনো কিছুতেই সে ঠিকমতো কনসেনট্রেট (মনসংযোগ) করতে পারে না। কোনো একটি লেখাও সে ঠিকমতো শেষ করে না। সেটা ফেসবুকে হোক কিংবা বইয়ে। সে সবকিছু সংক্ষেপে চায়। দ্রুত শেষ করতে চায়। একটু সময় নিয়ে কিছু পড়তে চায় না। এমনকি কোনো ভিডিওর ডিউরেশন বেশি হলে সেটাও দেখতে চায় না। ইন্টারনেট মানুষকে মূলত ধর তক্তা মার পেরেকে উদ্বুদ্ধ করে।
প্রতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষদিন বাংলা একাডেমির তরফে পুরো মাসজুড়ে চলা অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত বইয়ের তালিকা এবং মোট বিক্রির যে পরিসংখ্যান দেয়া হয় তাতে দেখা যায়, আগের বছরের তুলনায় বইয়ের সংখ্যা এবং বিক্রিলব্ধ অর্থের পরিমাণ বেড়েছে। আপাতদৃষ্টিতে এটি আশার সংবাদ যে বইয়ের সংখ্যা ও বিক্রি দুটিই বাড়ছে। কিন্তু মুদ্রার অন্যপিঠ হলো, বইয়ের সংখ্যা ও বিক্রির এই তথ্যগুলো নিতান্তই পরিসংখ্যান। আপনি আপনার আশপাশে তাকালেই দেখবেন মানুষের মধ্যে বই পড়ার প্রবণতা কী ভয়াবহরকম কমেছে। বিশেষ করে ইন্টারনেটে যুক্ত মানুষ এখন আর একটানা অনেক সময় ধরে বই পড়ে না। বই পড়ার মধ্যেও সে বারবার মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে ফেসবুকে নতুন কিছু এলো কি না। তার পোস্টে নতুন কোনো কমেন্ট বা লাইক পড়লো কি না। ফলে ইন্টারনেটে প্রতি মানুষের এই অতি মনসংযোগ তাকে পৃথিবীর অন্যান্য জিনিস থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সান্তা ক্লারা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী জ্যাকোব আমেদি এক গবেষণায় (প্রতিচিন্তা, জানুয়ারি-মার্চ ২০১৮, পৃষ্ঠা ৬৪) দেখিয়েছেন, সামাজিক মাধ্যমগুলো যুবসমাজকে অতিরিক্ত মাত্রায় আত্মসচেতন, উদ্বিগ্ন এবং সবশেষে হতাশ করে ফেলে। সামাজিক মাধ্যমগুলো আমাদের পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা হরণ করছে এবং মানবিক, শারীরিক ও অনুভূতির সাহচর্যকে ভার্চুয়াল যোগাযোগ দ্বারা প্রতিস্থাপিত করছে। এই মাধ্যমগুলো আমাদের আত্মসংযম কেড়ে নিয়ে নিজেদের স্বাধীন চিন্তাশক্তিকে অকেজো করে দিয়েছে এবং সেইসব অবান্তর তথ্যের প্রতি আমাদের বিশ্বাসপ্রবণ করে তুলছে যা আমরা কোনো বাছবিচার ছাড়াই প্রতিনিয়ত গলাধঃকরণ করে চলেছি।
এরকম একটি কঠিন বাস্তবতার ভেতরে লাখ লাখ মুদ্রিত বই নিয়ে প্রতি বছর বাংলা একাডেমি এবং তৎসংলগ্ন ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মাসব্যাপী যে অমর একুশে গ্রন্থমেলা হয় এবং প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের পদচারণায় যে এই পুরো এলাকাটি মুখর হয়ে ওঠে, এটিও আশার সংবাদ। এ মুহূর্তে ওই এলাকায় মেট্রো রেলের কাজ চলছে। ফলে শাহবাগ থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত পুরো রাস্তাটি অর্ধেকেরও বেশি বন্ধ। দুপাশের সরু পথ ধরেই প্রতিদিনি হাজার হাজার মানুষ বইমেলা যাচ্ছেন। অনেকক্ষণ বইমেলার গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছি, যারাই বের হচ্ছেন অধিকাংশের হাতেই ছোট বড় মাঝারি ব্যাগ।
মানে সবাই কিছু না কিছু বই কিনছেন। অনেকে নিতান্ত ঘোরাফেরা বা সময় কাটানোর জন্যই যাচ্ছেন। কিন্তু ঘোরাঘুরি বা সময় কাটানোর জন্যও যদি কেউ বইমেলায় যান, সেটিও মন্দ নয়। বরং এই মেলাটি প্রতি বছরই লেখক-পাঠক-প্রকাশক এবং গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে যে দেখাসাক্ষাৎ ও কুশল বিনিময়ের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়, তারও একটি সামাজিক গুরুত্ব রয়েছে। যে মহানগরীতে নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া এখন মানুষে মানুষে দেখা হয় না বললেই চলে, সেখানে এই বইকে কেন্দ্র করে যদি একটা বড় ধরনের সামাজিক মেলবন্ধনের সুযোগ সৃষ্টি হয়, ক্ষতি কী? সবাই যে বই কিনবেন বা পড়বেন, এমন নয়। বরং অনেকেই যাবেন শুধুমাত্র সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য।
আবার অনেকেই বই কিনবেন। যারা কিনবেন সবাই যে সব বই পড়ে ফেলবেন, তাও নয়। বরং আপনার বাসায়ও এমন অসংখ্য বই আছে যা কেনার পরে আপনি এখনও পড়েননি বা পড়া শুরু করলেও শেষ করেননি। কিন্তু তারপরও বইয়ের মতো একটা পবিত্র জিনিসকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর যে লাখ লাখ মানুষের একটা নির্ভেজাল সমাবেশ হয়; ব্যবসার লাভ-ক্ষতির বাইরেও যে কোটি টাকার বই বিক্রি হয়; লেখার মান যাই হোক, অনেক নতুন লেখক যে তৈরি হয়—সেটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বই নিয়ে আলোচনা শুরু হলে দ্রুত সেটি সিরিয়াস তর্কে রূপ নেয় এবং প্রতি বছর বইমেলায় যে হাজার হাজার নতুন বই প্রকাশিত হয় তার অধিকাংশই মানসম্পন্ন নয় সে কথাও বলা হয়। কিন্তু কোন বইটি মানসম্পন্ন আর কোনটি মানহীন, তার মানদণ্ড কে ঠিক করবে? আপনি যে বইটি পড়ে আনন্দ পাচ্ছেন, আরেকজনের কাছে সেটি হয়তো ছাইপাশ।
আবার আপনার পছন্দের লেখকের কোনো বইয়ের একটি পৃষ্ঠায়ও হয়তো আরেকজন পড়েননি। ফলে অমুক লেখক কী লিখেছেন, সেই খুবই আপেক্ষিক তর্ক। কারণ একটি সমাজ ও রাষ্ট্রে যেমন হাজার রকমের মানুষ থাকেন, তাদের রুচি-অভ্যাস-চিন্তাও হাজার রকম। ফলে একজন লেখককে সবাই পড়বেন, এমনটি ভাববার কারণ নেই। আবার একজন লেখক ‘সস্তা’ প্রেমের উপন্যাস লিখলেন বলে আপনি নাক সিঁটকাবেন, তারও সুযোগ নেই। কারণ ওই কথিত সস্তা প্রেমের উপন্যাসেরও পাঠক রয়েছে।
ফলে কে কী পড়ছেন, তার চেয়ে বড় এখন কতজন পড়ছেন? বলাই হয়, কারো হাতে একটি স্মার্টফোন আর তাতে ইন্টারনেট সংযুক্ত থাকার মানেই হলো তিনি একটি অ্যাটম বোমা নিয়ে ঘুরছেন। অর্থাৎ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে যেকেউ যেকোনো কিছু লিখে দিলেই কেল্লাফতে। অনেক সময় ফেসবুকের একটি স্ট্যাটাস অ্যাটম বোমার চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে। ফলে ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়ার এই অ্যাটম বোমার সময়েও আমার যে মুদ্রিত বই নিয়ে কথা বলছি বা হাজার হাজার মানুষে যে বইমেলায় যাচ্ছে; পয়লা ফাল্গুন আর ভালোবাসা দিবসে সব বয়সী মানুষ যে রঙিন পোশাক পরে আর তরুণীরা মাথায় ফুল গুঁজে বইমেলা চত্বরে ঘুরছে-ফিরছে—সেটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।
এইচআর/পিআর