ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছেড়ে ব্রিটেন যেন আমেরিকার কাছে জিম্মি না হয়

আনিস আলমগীর
আনিস আলমগীর আনিস আলমগীর , সাংবাদিক ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৯:২৫ এএম, ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০

৩১ জানুয়ারি ২০২০ ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করেছে। শত শত বছর ব্যাপী ব্রিটেন ছিল বিশ্বের বৃহত্তম সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। একটা প্রবাদ ছিল- ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না। এখন কিন্তু সেই অবস্থা আর নেই। আমেরিকা, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো বড়-বড় উপনিবেশ তার হাতছাড়া হয়ে গেছে। এখন মহারাজার দেউড়ি ঘরে পড়ে থাকা হাতল ভাঙ্গা সিংহাসন মার্কা চেয়ারের মত তার অবস্থা। ব্যবসা-বাণিজ্যের আয়ের উপর নির্ভর করে চলতে হয়।

গত কয়েক দশক ধরে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য করে ব্রিটেন নিজের অবস্থা ঠিক রেখেছিল। কিন্তু বৃটেনের মানুষ তাদের নওয়াবিয়ানা অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেনি বলে শেষ পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করল। ইউনিয়নের সনদের শর্ত অনুযায়ী ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মানুষ সদস্যভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে অবাধে বিচরণ, বসতির সুযোগ ছিল এবং সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে পূর্ব ইউরোপের কিছু লোক ব্রিটেনে এসে বসতি শুরু করেছিল।

বৃটেনের সাধারণ মানুষের অভিযোগ হল, তারা পূর্ব ইউরোপের লোকগুলোর সঙ্গে একসঙ্গে বসবাস করতে পারছে না এবং এই লোকগুলো তাদের সমাজের জীবনমানের ভারসাম্য বিনষ্ট করে ফেলছে। এই অজুহাতকে বিবেচনায় এনে রক্ষণশীল দলের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন গণভোটের আয়োজন করলেন। ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কি থাকবে না এই নিয়ে ছিল গণভোট। গণভোটে ‘না থাকার’ সিদ্ধান্ত সামান্য ভোটের ব্যবধানে গৃহীত হয়েছিল।

প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন যেহেতু ইউনিয়নে থাকার পক্ষের লোক ছিলেন তাই তিনি গণভোটের সময় ইউনিয়নে থাকার পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছিলেন। থাকার পক্ষে গণভোট না জেতায় তিনি পদত্যাগ করে চলে যান। তার দলের থেরেসা মে প্রধানমন্ত্রী হন। থেরেসা মে ইউনিয়ন ত্যাগ করতে ব্রাসেলসের সঙ্গে সম্পাদনের জন্য যে চুক্তি করতো হতো তার খসড়া তৈরি করেছিলেন। কিন্তু সেটি বারবার পার্লামেন্ট কর্তৃক পরিত্যক্ত হওয়ার পর তিনিও পদত্যাগ করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী হন বরিস জনসন। তিনিও পার্লামেন্টের অনুমোদন আদায়ে ব্যর্থ হন। অন্তবর্তীকালীন সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে রক্ষণশীল দল পুনরায় ক্ষমতাসীন হয় এবং বরিস জনসন আবারও প্রধানমন্ত্রী হন। বরিস জনসন পূর্ব থেকেই ইউনিয়ন ত্যাগ করার পক্ষের লোক। নির্বাচনে জিতে তিনি ইউনিয়ন ত্যাগ করার সবকিছু চূড়ান্ত করে ৩১ শে জানুয়ারি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করেন।

ইউনিয়ন ত্যাগ করার পর এখন মূলত দুইটি সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে ব্রিটেন। ১. স্কটল্যান্ড বলছে ব্রিটেন ইউনিয়ন ত্যাগ করলে তারা বৃটেন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন হয়ে যাবে এবং এরই মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা স্বাধীনতার বিষয়ে পুনরায় গণভোট করবে। এখন স্কটল্যান্ডে জাতীয়তাবাদীরা ক্ষমতায়। তারা যদি গণভোটে জিতে যায় তবে স্কটল্যান্ড ব্রিটেন ত্যাগ করবে। মূলত- ওয়েলস, ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড এবং উত্তর আয়ারল্যান্ড নিয়ে যুক্তরাজ্য গঠিত। স্কটল্যান্ড ছুটে গেলে যুক্তরাজ্যের বিরাট অঙ্গহানি হবে আর উত্তর আয়ারল্যান্ডকেও হয়তো তখন যুক্তরাজ্যে রাখা সম্ভব হবে না। আবার বিখ্যাত স্কটিশ হুইস্কির কোটি কোটি টাকার ব্যবসা থেকে বঞ্চিত হবে ব্রিটেন। স্কটল্যান্ড শুধু হুইস্কির ব্যবসার আয় থেকে চলতে পারে।

২. যুক্তরাজ্যের বাণিজ্যের বিরাট অংশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে হতো। ইউনিয়ন বহু ত্যাগ স্বীকার করে ব্রিটেনকে সঙ্গে রেখেছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়ন যখন একক মুদ্রা ইউরো চালু করে ব্রিটেন তখন তাদের মুদ্রা পাউন্ড বিলুপ্ত করতে রাজি ছিল না। তারা মনে করেছিল মুদ্রা ছাড়া স্বাধীনতা মুল্যহীন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের সেই সিদ্ধান্তও মেনে নিয়েছিল।

ব্রিটেনকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আশ্বস্ত করে রেখেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নে যদি ব্রিটেনের ব্যবসা হারানোর সংশয় দেখা দেয়, তবে আমেরিকা ব্রিটেনের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করে সেই ঘাটতি পুষিয়ে দেবে। ট্রাম্পের কথা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খুব হালকাভাবে গ্রহণ করা হয়। কারণ তিনি তার কমিটমেন্টের উপর স্থির থাকেন না। কিন্তু বরিস জনসন ট্রাম্পের কথায় মনে হয় খুবই আস্থাশীল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির মাতব্বরী ছিল বৃটেনের হাতে। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতেও মিত্রশক্তির নেতা ছিল ব্রিটেন। কিন্তু জাপান পার্ল হারবারে বোমা নিক্ষেপের পর আমেরিকা যখন যুদ্ধে জড়িয়ে যায় তখন মিত্রশক্তির নেতৃত্ব মার্কিনীদের হাতে চলে যায়। আবার বিশ্বযুদ্ধের পর মার্শাল প্ল্যানের মাধমে আমেরিকা ইউরোপকে ব্যাপক সাহায্য না করলে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে মাথা তুলে দাঁড়ানো অসম্ভব ছিল। এই সমস্ত কারণে ইউরোপের সঙ্গে আমেরিকার ব্যাপক ঐক্যমত সৃষ্টি হয়।

১৯৪৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আণবিক বোমার অধিকারী হলে আমেরিকা ইউরোপের রাষ্ট্রসমূহকে নিয়ে ন্যাটো জোট গঠন করে। ইউরোপকে নিয়ে আমেরিকার যত কায়কারবার তাতে ব্রিটেন আমেরিকার ধারক-বাহক হয়ে দাঁড়ায়। বৃটেনের ভূমিকা এমন খোলামেলা ছিল যে ব্রিটেনকে ইউরোপে আমেরিকার ছিটমহল বিবেচনা করতে লোকে দ্বিধা করত না। ফ্রান্সের জেনারেল শার্ল দ্য গল তো ব্রিটেনকে সহ্যই করতে পারত না।

যাহোক, ব্রিটেনের ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে গেছে। ইউরোপের বৃটেন, ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল- সব রাষ্ট্রেরই একসময় শক্তি ছিল এবং বহু উপনিবেশ ছিল। দুনিয়াটাকে পরিপূর্ণভাবে আবিষ্কার করে পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার ব্যাপারে ইউরোপের অবদান সবচেয়ে বেশি। এখন ইউরোপে রাষ্ট্রসমূহের পুরনো জৌলুস আর নেই। সবাই চেয়েছিল সব ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো ইউনিয়ন গঠন করে একত্রিত শক্তিতে বলীয়ান হতে। ব্রিটেন এখন তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।

সম্ভবত অবশিষ্ট ২৭ রাষ্ট্র পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হবেনা। পার্শ্ববর্তী রাশিয়াকে সবাই ভয় করে কারণ রাশিয়া বিশ্বের দ্বিতীয় সুপার পাওয়ার। ইউরোপের উচিত রাশিয়াকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন না রেখে তাদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করা। রাশিয়া আর সমাজতান্ত্রিক দেশ না। আমেরিকার উস্কানিতে কান না দিয়ে ইউরোপীয় বৃহত্তম ঐক্য সাধনে সবার আগ্রহ থাকা প্রয়োজন।

এখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন আর ব্রিটেন বাণিজ্য আলোচনা শুরু করেছে। বরিস জনসন অবাধ বাণিজ্যের পক্ষে আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলছে তাদের সঙ্গে বাণিজ্য করতে হলে ইউনিয়নের বিধি-বিধান মানতে হবে। বরিস জনসন বলেছেন সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে তারা বাণিজ্য করবে। তারা চায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন কানাডার সঙ্গে যেভাবে বাণিজ্য করছে সেভাবে বাণিজ্য করতে। বৃটেনের উচিত হবেনা আমেরিকার বাণিজ্যের আশ্বাসের উপর এককভাবে নির্ভর করা। ইউনিয়নের সঙ্গে বাণিজ্য অব্যাহত রাখতে বাড়াবাড়ির আশ্রয় না নেওয়া। অবশ্য বৃটেন যেখানে একটু মাথা নোয়াতে হয় সেভাবে নোয়াতে অভ্যস্ত। তার উপনিবেশিক নীতিতে আমরা এমন লক্ষণ বারবার দেখেছি।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]

এইচআর/জেআইএম

বৃটেনের উচিত হবেনা আমেরিকার বাণিজ্যের আশ্বাসের উপর এককভাবে নির্ভর করা। ইউনিয়নের সঙ্গে বাণিজ্য অব্যাহত রাখতে বাড়াবাড়ির আশ্রয় না নেওয়া। অবশ্য বৃটেন যেখানে একটু মাথা নোয়াতে হয় সেভাবে নোয়াতে অভ্যস্ত। তার উপনিবেশিক নীতিতে আমরা এমন লক্ষণ বারবার দেখেছি।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।