গালভরা বুলির চেয়ে বাসযোগ্য নগরী অধিক প্রত্যাশিত
ঢাকা মহানগরীকে বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন দুই সিটির মেয়র এবং কাউন্সিলর প্রার্থীরা। প্রচারণা চালাতে গিয়েই যারা নগরজীবনকে বাস অনুপযোগী করে তুলেছেন তারা জিতে এসে কি করবেন তা নিয়ে সংশয় প্রকাশের সুযোগ আছে। পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গেছে সমস্ত ঢাকা। অলিগলি কিছুই বাকি নেই। এই যে লাখ লাখ লেমিনেটিং পোস্টার ঝুলছে সর্বত্র, ভোট শেষে এগুলোর গতি কি হবে? এগুলো যত্রতত্র ছড়িয়েছিটিয়ে থাকবে, পরিবেশের জন্য এগুলো কত ক্ষতিকর হবে তা কি নির্বাচনে প্রার্থীরা একবার ভেবে দেখেছেন? আদালত লেমিনেটিং পোস্টার ব্যবহার না করার পরামর্শ দিলেও তা কেউ মানছেন না এই পোস্টারগুলো শহরকে অপরিচ্ছন্ন করছে, করবে। এগুলো সহজে নষ্ট না হওয়ায় পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হবে।
নির্বাচনী প্রচারে প্রার্থীরা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মাইক ব্যবহার করে যে পরিমাণ শব্দ দূষণ করছেন তা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। মানুষের কল্যাণ করার উপকার করার জন্য নির্বাচনে দাঁড়িয়েই তারা মানুষের কত অকল্যাণ ও অপকার করছেন, সেটা যদি তারা বুঝতেন! মাইকের শব্দে পরীক্ষার্থী, রোগী, বয়স্ক মানুষ, শিশুসহ অনেকেরই কান ঝালাপালা। নির্বাচনী প্রচারণার নামে উৎকট শব্দে মাইক ব্যবহার করে মানুষকে বিরক্ত করার কোনো মানে হয় না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। ভোটে দাঁড়ানো এবং ভোট দেওয়া– দুটোই মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। এই অধিকার চর্চা করতে গিয়ে কারো শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি করা নিঃসন্দেহে অনুচিত কাজ। নির্বাচনী প্রচারে শব্দ দূষণ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের কোনো মাথা ব্যথা নেই।
ভোট প্রার্থীরা, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি থেকে যারা মনোনয়ন পেয়েছেন, তারা ভোটারদের আকৃষ্ট করার জন্য নানা ধরনের অঙ্গীকার করছেন, প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। দুর্নীতিমুক্ত, বাসযোগ্য, সচল এবং সুশাসিত ঢাকা উপহার দেওয়ার কথা মেয়রপ্রার্থীরা বলছেন। স্বল্পমেয়াদী, দীর্ঘমেয়াদী কিছু পরিকল্পনার কথাও কেউ কেউ বলছেন। তবে এর কোনটা, কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, সে বিষয়ে তাদের কোনো সুষ্ঠু পরিকল্পনা তাদের আছে কিনা, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। ভোটের আগে ভোটভিক্ষুকরা যতটা জনবান্ধব বলে নিজেদের উপস্থাপন করে থাকেন, ভোটের পরে আর তা থাকে না।
গত মেয়র নির্বাচনে ঢাকা উত্তরে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন তাবিথ আওয়াল। তিনি আওয়ামী লীগ প্রার্থী আনিসুল হকের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। তারপর কি তিনি আর কোনো নাগরিক সমস্যা নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন? মানুষ কি তাকে কাছে পেয়েছে? যারা জনগণের প্রতিনিধি হতে চান, যারা নিজেদের জনকল্যাণে ব্রতী বলে মনে করেন, তাদের তো সব সময় মানুষের পাশেই থাকার কথা। ভোটের সময় জনবান্ধব, ভোট ফুরালে ফুট – এই যদি হয় নীতি তাহলে কি মানুষের আস্থা-বিশ্বাস অর্জন করা সহজ হয়?
ভোটের আগে প্রার্থীরা যেসব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, সেগুলো পূরণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব কিনা, সেটা তাদের ভাবনায় আছে বলে মনে হয় না। সিটি করপোরেশনের মেয়রদের ক্ষমতা খুব বেশি নেই। তবে আন্তরিকতা, সদিচ্ছা, ন্যায়বোধ এবং দৃঢ়তা থাকলে যেটুকু ক্ষমতা আছে, তার সবটুকুর সর্বোত্তম ব্যবহার করে নাগরিকদের কিছু সমস্যা লাঘব করা সম্ভব। আনিসুল হক এবং সাঈদ খোকন দুজনেই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে ঢাকা উত্তর এবং দক্ষিণের মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু দুজনের পারফরমেন্স কি এক রকম ছিল?
উত্তরের আনিসুল হক তার মেয়াদের অর্ধেক সময়ও দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। মৃত্যু তার পথরোধ করে দিয়েছে। কিন্তু ওই স্বল্প সময়েই তিনি তার আন্তরিকতার প্রমাণ দিতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি যে পারেন, পরিবর্তন করা যে তার বিশ্বাসের অংশ ছিল, সেটা তিনি দেখিয়েছেন। কিন্তু দক্ষিণের সাঈদ খোকন পুরো মেয়াদেও মানুষের কাছে ‘কাজের মানুষ' হিসেবে স্বীকৃতি পেলেন না। চোখে পড়ার মতো কিছু তিনি করতে পেরেছেন কি? এমন কি তিনি তো ঠিকমতো ‘মশাটাও মারতে পারলেন না'! ভোটের আগে সংবাদপত্রে ব্যয়বহুল বিজ্ঞাপন ছেপে তিনি যে সাফল্যের বয়ান দিয়েছেন, তাতেও তিনি প্রশংসিত না হয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছেন।
ভাষার মাসের প্রথম দিন ঢাকার দুই সিটির নির্বাচন। মেয়র এবং কাউন্সিলর প্রার্থীরা সর্বশক্তি দিয়ে প্রচারযুদ্ধে নেমেছেন। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি দুই দলই নিজেদের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারে নেমেছে। মেয়র প্রার্থী নিয়ে সমস্যা না থাকলেও কাউন্সিলর প্রার্থী নিয়ে বিপাকে আছে দুই দলই। বেশ কিছু ওয়ার্ডে দুই দলেরই ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী আছেন। দলের অফিসিয়াল প্রার্থীদের সামনে বিদ্রোহী প্রার্থীরা চ্যালেঞ্জ হয়েই আছেন। হুমকি দিয়েও বিদ্রোহীদের বসানো যায়নি। তবে কাউন্সিলর নিয়ে নয়, সবার মনোযোগই মেয়রের দিকে। কে হবেন নতুন নগরপিতা, সেটা দেখার অপেক্ষায় মানুষ। ঢাকাকে বাসযোগ্য করার কঠিন ও দুরূহ দায়িত্ব কার কাঁধে তুলে দেওয়া হবে? নির্বাচনী প্রচারণায় এগিয়ে আছে আওয়ামী লীগ। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মাঠে আছে বিএনপি। বিভিন্ন রকম অভিযোগ তুলে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত করার কাজে এগিয়ে আছে বিএনপি।
নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ একটি সুষ্ঠ নির্বাচন অনুষ্ঠান। উদ্যোগ, আয়োজন আড়ম্বরের কোনো কমতি নেই। টাকা-পয়সাও খরচ করছে প্রধান দুই দল। প্রচার-প্রচারণায় উৎসবের আমেজ থাকলেও ভোটারদের মধ্যে সেরকম উৎসাহ এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। সুষ্ঠু ভোট হওয়া নিয়ে এক ধরনের সংশয় অনেকের মধ্যেই আছে। বিএনপির ক্রমাগত নেতিবাচক প্রচারণা মানুষের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব বাড়াতে সহায়তা করছে। শেষ পর্যন্ত কি দাঁড়াবে তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। ফলাফল যাই হোক না কেন, নির্বাচনটি যে বিতর্কমুক্ত হবে না, সেটা বোধহয় বলা যায়।
পরাজিত পক্ষ ফলাফল মানতে চায় না। আবার যারা জয়ী হন তাদের জয়ের প্রক্রিয়াও সব সময় স্বচ্ছ হয় না। তবে নগরবাসী দুজন নতুন মেয়র এবং অনেক ওয়ার্ড কমিশনার পাবেন। তারা ঢাকার জনজীবন কিছুটা স্বস্তিদায়ক করে তুলতে উদ্যোগী হলে আমরা কৃতজ্ঞ থাকবো। ক্ষুধাতুর শিশুর কাছে যেমন ‘স্বরাজের' চেয়ে দুমুঠো ভাত বেশি কাম্য, তেমনি সমস্যাসঙ্কুল ঢাকাবাসীর কাছেও গালভরা সব বুলির চেয়ে বাসযোগ্য একটি নগরী অধিক প্রত্যাশিত।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
এইচআর/জেআইএম