মির্জা ফখরুলের বোধোদয় ও বিএনপি
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বোধোদয় হয়েছে। ছয় বছর পার হয়ে যাওয়ার পর মুখ খুলেছেন। ‘নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার : বর্তমান প্রেক্ষাপট’ এ বিষয় নিয়ে গত শুক্রবার প্রেসক্লাবে একটা গোলটেবিল বৈঠক হচ্ছিল। বিষয় দেখেই বুঝা যায়, সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে সরকারকে অভিযোগে জর্জরিত করে রাজনৈতিক লাভ বের করতেই গোলটেবিল বৈঠক আয়োজিত হয়েছিল। কিন্তু হিতে বিপরীত হলো। আলোচকরা উল্টো অভিযুক্ত করল বিএনপি নেতাদের। আন্দোলনে রাস্তায় নামা হচ্ছে না কেন? চাপটা বোধকরি প্রচণ্ড ছিল; তাই বের হয়ে গেছে পেটের কথা। ‘আমাদের ভুলত্রুটি হয়েছে’ স্বীকার করে তিনি বলেছেন, ‘দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও এর বর্ষপূর্তি ঘিরে ধারাবাহিক অবরোধ-আন্দোলনে বিএনপির যে ক্ষতি হয়েছে, তা পুষিয়ে উঠতে এখনো বেগ পেতে হচ্ছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে এখন হঠাৎ করে আর হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে নিশ্চিহ্ন হতে চাই না।’
একটু খেয়াল করলেই স্মরণে আসবে যে, পরপর দুবার বিএনপি হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বিএনপি নিশ্চিহ্ন হওয়ার দিকে যাচ্ছে, ভুলত্রুটি করে বিএনপি নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছে প্রভৃতি কথা ইতোপূর্বে এই কলামেও লেখা হয়েছে। কিন্তু বিএনপি এতদিন তা স্বীকার করেনি। এবারে মহাসচিব ফখরুল তা স্বীকার করলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপির অন্য নেতারা বিশেষত প্রবাসী তারেক রহমান কিংবা জেল থেকে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া কি স্বীকার করবেন হঠকারিতার জন্যই বিএনপি শনিরদশার মধ্যে পড়েছে? প্রবাদ বলে, কান টানলে মাথা আসে। বিএনপি যদি ওই দুই সময়ের ভুলত্রুটি ও হঠকারী কাজের কথা স্বীকার করে, তবে তাদের এটাও স্বীকার করতে হবে, কেবল দলের জন্য ক্ষতিকর নয়; হরতাল-অববোধ-অগ্নিসংযোগ, নাশকতামূলক কাজ, নিরীহ মানুষ-পুলিশ মারা প্রভৃতি দেশের জন্য চরম ক্ষতিকর কাজ দলটি করেছে।
প্রসঙ্গত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে তা প্রতিরোধের ডাক দেয় দলটি। আন্দোলনের নামে ক্যাডার-সন্ত্রাসীদের রাস্তায় নামায়। কিন্তু নির্বাচন বানচাল করে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বিনষ্ট করতে ব্যর্থ হয়। ওই নির্বাচনের বর্ষপূর্তি ২০১৫ সাল ঘিরে সরকার পতনের ডাক দিয়ে যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে টানা তিন মাস একইভাবে রাস্তায় নামানো হয় ক্যাডার-সন্ত্রাসীদের। এটা কার না জানা যে, ওই দুই সময়ে প্রবাসে বসে তারেক জিয়া টেলিফোনে সব কন্ট্রোল করতেন, আন্দোলনের কর্মসূচি ও ক্যাডার নামানো বিষয়ে নির্দেশ দিতেন। সেই নির্দেশ গোপন স্থান থেকে পত্রিকায় প্রচার করা হতো আর রাস্তায় নামানো হতো ক্যাডার-সন্ত্রাসীদের। প্রশ্নটা হলো, যিনি প্রবাসে বসে আরামে থেকে নির্দেশ দিয়ে বালখিল্যতা দেখালেন, অপরিণামদর্শিতা দেখিয়ে দেশ-মানুষের ক্ষতি করলেন, হঠকারিতা করে দলের সর্বনাশ তথা নেতাকর্মীদের মামলার মধ্যে নিপতিত করলেন, তাকেই ফখরুল সাহেবরা প্রমোশন দিয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের পদে বসালেন। রাজনীতির ভাষায় হঠকারিতাকে বলা হয় ‘শিশুরোগ’।
উল্লেখিত বক্তৃতায় মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘আমাদের ভুলত্রুটি হয়েছে, সেই ভুলত্রুটি নিয়ে আমরা কিন্তু সরে দাঁড়াইনি।’ কিন্তু যে ব্যক্তি দেশ থেকেই সরে গিয়ে দলকে শিশুরোগাক্রান্ত করল, তাকেই পুরস্কৃত করা হলো। তার অঙ্গুলি হেলনেই সব কাজ চলছে।
বাস্তবে বিএনপিকে যদি ক্ষতি পুষিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে হয়, তবে প্রথমে ওই দুই সময়ের হঠকারী কৌশলের উৎস কোথায় তা খুঁজে বের করতে হবে। এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রদান করলে জামায়াতে ইসলামী আন্দোলনের নামে সহিংসতা, চোরাগোপ্তা আক্রমণ ও নাশকতার পথ নেয়। ১ মার্চ অর্থাৎ ৪ দিনের মধ্যেই জামায়াতের ক্যাডার-সন্ত্রাসীদের সহিংসতায় ৪০ জন নিরীহ মানুষ ও পুলিশ নিহত হয়। প্রসঙ্গত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলে বিএনপি-জামায়াত জোট নেত্রী খালেদা জিয়া প্রথম দিকে ধরি মাছ না ছুঁই পানি তথা মাঝামাঝি অবস্থান গ্রহণ করেন।
কিন্তু জামায়াত সহিংসতা শুরু করলে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার আশায় খালেদা জিয়া বিচার ও রায়ের ব্যাপারে সরকারকে অভিযুক্ত করে ৫ মার্চ ২০১৩ দেশব্যাপী হরতালের ডাক দিয়ে বলেন, ‘দেশে বর্বর গণহত্যা চলছে।… এটা আমাদের কল্পনার বাইরে যে একটি সরকার তার নিজের দেশের মানুষের ওপর গণহত্যা চালাতে পারে। গণহত্যার বিরুদ্ধে আমরা দাঁড়িয়ে ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন করেছিলাম। একটি স্বাধীন দেশের সরকার গণহত্যা চালাবে তা মেনে নেয়া যায় না।’
ওই বক্তৃতায় ’৭১-এর গণহত্যা প্রসঙ্গ টানা হয়েছিল গৃহযুদ্ধের ইঙ্গিত দিতে। আর যিনি ছিলেন পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর ক্যান্টনমেন্টে, তার মুখে ‘দেশ স্বাধীন করেছিলাম’ কথাটা তখন মানুষের মধ্যে দারুণ ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল। সেই থেকেই শুরু হয় বিএনপি-জামায়াত জোটের আন্দোলনের নামে সহিংস বালখিল্যতা, যা ২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন বয়কট করে চালানো হয়। ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোটের আগের দিন পর্যন্ত মারা যান ১২৩ জন মানুষ। ভোট নিয়ে এত মানুষের মৃত্যুর রেকর্ড ছিল এটা। উল্লেখিত ঘটনাপ্রবাহ থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, হঠকারিতার রাজনীতি শুরু করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় বানচাল করার জন্য জামায়াত নেমেছিল। বিএনপি তাতে যোগ দেয় এবং একই কৌশল নেয় নির্বাচন বানচাল ও সাংবিধানিক পথ রুদ্ধ করে অবৈধ সরকারকে ক্ষমতায় বসানের লক্ষ্যে। গৃহযুদ্ধ বাধানো যে এই জোটের লক্ষ্য ছিল তা সুস্পষ্ট। কেননা তখন পাকিস্তান পার্লামেন্ট থেকে গৃহযুদ্ধের উসকানি দেয়া হয়েছিল।
তাই কেবল আন্দোলনে হঠকারী লাইন গ্রহণ করা বিষয়টি স্বীকার করলেই বিএনপি ক্ষতি পোষাতে পারবে না। যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের সঙ্গে জোট, রাজাকার-আলবদর নেতাদের বাড়িতে-গাড়িতে পতাকা তোলা ও বুকে জড়িয়ে ‘আত্মার আত্মীয়’ বলার কলঙ্কিত দুষ্কর্ম আর সেই সঙ্গে পাকিস্তান কানেকশনের কথাও বিএনপিকে স্বীকার করতে হবে। তবে কেবল এটুকু স্বীকার করলেই কি বিএনপি ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে! জামায়াতের সঙ্গে জোট করে সহিংসতা চালানো এবং এখন পর্যন্ত সঙ্গে রেখে দেশের রাজনীতি কলুষিত ও গণতন্ত্রের যে ক্ষতি করছে কিংবা পাকিস্তান কানেকশন ওই সহিংস আন্দোলনে যে ছিল তাও স্বীকার করতে হবে। সহজেই ধারণা করা যায়, জামায়াতকে দল করার লাইসেন্স দিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়ার নামানো যে ভুল হয়েছিল, তাও স্বীকার করতে হবে।
সেই সঙ্গে স্বাধীন দেশে পাকিস্তানের মতো হত্যা-ক্যু-পাল্টা ক্যু, অবৈধ ক্ষমতা দখল, হুকুমের ‘হ্যাঁ-না ভোট’সহ নির্বাচন ও রাবার স্ট্যাম্প পার্লামেন্ট গঠন, হাওয়া ভবনের লুটপাট প্রভৃতির কথা স্বীকার করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর হত্যা দিবসে জন্মদিনের কেক কাটার প্রতিটি অনুষ্ঠানে মির্জা ফখরুল তো ছিলেন উপস্থিত। এটা কী ছিল? হঠকারী কি? নাকি প্রতিহিংসামূলক? জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে অপমানিত করার কথাটা কি কখনো বিএনপি স্বীকার করবে?
বলাই বাহুল্য, একটা দোষ স্বীকার করছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল, তাই গোড়ার অর্থাৎ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ত্রুটিগুলো তিনি স্বীকার করুক। অন্য নেতাদের মুখ দিয়েও তা স্বীকার করানোর চেষ্টা করুক। নিজে যা মনে করেন সেটা দলের আত্মসমালোচনামূলক সিদ্ধান্ত হিসেবে নিতে সচেষ্ট থাকুন। যদি তিনি তা পারেন তবে দেশের সুস্থ রাজনীতির ধারা ফিরে আসার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। গণফোরামের ড. কামালদের সঙ্গে ঐক্যফ্রন্ট করার যৌক্তিকতা প্রমাণ হবে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, ত্রুটি স্বীকার করাটাই কি যথেষ্ট! ত্রুটিগুলো এমন ক্ষুদ্র নয় যে, পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মতো। সঠিক ও যথাযথ পদক্ষেপ ছাড়া ত্রুটি স্বীকার আসলে বাকোয়াজ ছাড়া আর কিছু নয়। কথা ও কাজের সম্মিলন হলো ত্রুটি থেকে বের হয়ে আসার উপায়। সর্বোপরি ত্রুটি স্বীকার করলে কিন্তু ক্ষমাও চাইতে হয়। রাজনীতিতে ক্ষমা চাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। বিগত নির্বাচনের আগে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিগত ১০ বছর ক্ষমতায় থাকার সময়ে ভুলত্রুটি হয়ে থাকলে তার জন্য ক্ষমা চেয়েছিলেন। ক্ষমা চাইলে কেউ ছোট হয় না। বরং পথ চলার অনুপ্রেরণা পান।
ইতোমধ্যে অভিজ্ঞ রাজনীতিক মির্জা ফখরুল এমন অনেক কাজ করেছেন, যা অভাবনীয় এবং এমনকি বিস্ময়কর। তিনি বিএনপিকে সংসদ নির্বাচন বয়কট থেকে সংসদ নির্বাচনের পথে এনেছেন, ড. কামাল বিশেষত সুলতান মোহাম্মদ মনসুরদের মতো বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাশীলদের সঙ্গে ঐক্যফ্রন্ট করেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু-অবাধ-নিরপেক্ষ করার জন্য নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিএনপিকে বৈঠকে শামিল করিয়েছেন প্রভৃতি। সর্বোপরি এই হালুয়া-রুটির দেশে হালুয়া-রুটি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত বিএনপি দলের সিদ্ধান্ত মান্য করে সংসদ সদস্যপদ ত্যাগ করেছেন। প্রসঙ্গত বলতেই হয়, বিএনপি যখন রাজনীতি-সংগঠন বিশেষত আন্দোলনে মাঠে না নামতে পারার কারণে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে তখনো তিনি দলকে সুকৌশলে ডিফেন্ড করে যাচ্ছেন। উল্লেখিত ওই গোলটেবিলের বক্তৃতায় অভিজ্ঞতা কথা তুলে ধরে তিনি বলেছেন, ‘আমরা যখন কোর্টে যাই সেটা আন্দোলনের অংশ, আমরা যখন আলোচনা করি সেটাও আন্দোলনের অংশ, আমরা যখন নির্বাচনে অংশ নেই সেটাও আন্দোলনেরই অংশ। আমরা এই আন্দোলনগুলোকে একসঙ্গে করে নিয়ে বড় একটা আন্দোলনের চেষ্টা করছি।’
সব মিলিয়ে তিনি যে সুকৌশলী ও আত্মত্যাগী এটা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সফল হতে পারবেন কি তিনি? গাড্ডায় পড়া দলকে কি টেনে ডাঙ্গায় তুলতে পারবেন? এ প্রসঙ্গে বলতেই হয় যে, তিনি যদি কথা ও কাজের সমন্বয় করে অগ্রসর হতে চান, তবে তাকে অনেক অভিযোগের মধ্যে পড়তে হবে। দলের মধ্যে জামায়াতপন্থি নেতারা তাকে সরকারের দালাল বলে গালি দেবে। বিএনপির পক্ষের জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি দানা বাঁধবে। এগিয়ে যাওয়ার পথ হবে বন্ধুর। কিন্তু চ্যালেঞ্জ জয় করা ভিন্ন কি কখনো রাজনীতির ‘আঁকা-বাঁকা পথ’ অতিক্রম করা কিংবা কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা যায়?
প্রসঙ্গত সিটি নির্বাচনের ভেতর দিয়ে আবারো একটা বিষয় সুস্পষ্ট হচ্ছে যে, বিএনপির মাথায় পচন ধরলেও লেজে এখনো শক্তি আছে, সমর্থন আছে। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া জেলে, বয়স তার হয়েছে। আর তারেক জিয়ার রাজনীতির বর্তমান-ভবিষ্যৎ রয়েছে অন্ধকারে। এই অবস্থায় নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসার সুযোগ রয়েছে মির্জা ফখরুল সাহেবের। যদি তিনি বিএনপিকে পর্বতপ্রমাণ ভুলত্রুটি থেকে, বালখিল্য অপরিণামদর্শী হঠকারী রাজনীতি থেকে বের করে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনতে পারেন, তবে তার নাম দেশের রাজনীতির ইতিহাসে অমোচনীয় কালিতে লিপিবদ্ধ থাকবে।
লেখক : রাজনীতিক ও কলাম লেখক।
এইচআর/জেআইএম