এক বছরে সরকারের জনপ্রিয়তা বেড়েছে?
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার গঠনের পর এক বছর পূর্ণ হয়েছে ৭ জানুয়ারি। পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত সরকারের এক বছর খুব বড় সময় নয়। সরকার বছরওয়ারী কোনো লক্ষ্য বা কর্মপরিকল্পনাও জাতির সামনে পেশ করেনি। সরকার গঠনের পর নতুন সরকারের জন্য দেশের মানুষও কিছুটা ‘হানিমুন পিরিয়ড' বরাদ্দ করে থাকে। তারপর শুরু হয় সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাব-নিকাশ। আমার ধারণা, এক বছর পর সরকারের কাজকর্মের প্রতি মানুষের নজরদারি বাড়বে। অবশ্য সরকারের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে পরিচালিত এক জরিপে বলা হয়েছে, গত এক বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের জনপ্রিয়তা বেড়েছে এবং বিরোধী দলের জনপ্রিয়তা কমেছে। বিরোধী দলের হরতাল-অবরোধ না থাকায় রাজনৈতিক অঙ্গনে শান্তি বজায় রয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটা অবশ্যই একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বর্তমান সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। এর কারণও আছে। প্রথমত, এই সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার চেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী দেশে আর কেউ নেই। প্রথমত তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। পিতার অসমাপ্ত স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব তার কাঁধে। তিনি সৎ, পরিশ্রমী, অভিজ্ঞ, দূরদর্শী এবং কুশলী। তিনি বর্তমান বিশ্বে একজন সমাদৃত এবং প্রশংসিত রাষ্ট্রনায়ক। দ্বিতীয়ত, এই সরকারের একটি ধারাবাহিকতা আছে। বাংলাদেশে এর আগে আর কোনো সরকার টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আসতে পারেনি। তৃতীয়ত, দেশে নব্বইয়ের পর গণতান্ত্রিক শাসন ধারা শুরু হওয়ার পর এবারই প্রথম নির্ভেজাল আওয়ামী লীগের সরকার গঠিত হয়েছে। এটা জোড়াতালির সরকার নয়। এক মত, এক পথের অর্থাৎ এক দলের সরকার। এগুলোই হলো বর্তমান সরকারের সবলতা।
বর্তমান সরকারের দুর্বলতা কি? টানা ক্ষমতায় থাকা সরকারের জন্য একটি চ্যালেঞ্জও। তাছাড়া শক্তিশালী একটি বিরোধী দলের অনুপস্থিতি সরকারের জন্য অস্বস্তির কারণ। গণতন্ত্রে সরকার এবং বিরোধী দল একে অপরের পরিপূরক হওয়ার কথা। কিন্তু সংসদীয় বিরোধীদল দুর্বল এবং সরকার-অনুগত। সরকারের জন্য আরো একটি সমস্যা হলো, যে নির্বাচনে বিপুল জয় নিয়ে সরকার গঠন করা হয়েছে, সেই নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে অনেক প্রশ্ন আছে। নির্বাচন নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে এক ধরনের অনীহা-অনাগ্রহ তৈরি হয়েছে। ভোটের প্রতি মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। অতি সম্প্রতি চট্টগ্রামে একটি সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার ছিল খুবই কম। ২৩ শতাংশের মতো। এটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সংহত করার জন্য সহায়ক নয়। ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন কতটুকু বিতর্কমুক্ত হয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়। বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এক বছরে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকারের সক্ষমতার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। দীর্ঘ ২৮ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ– ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেও সরকার প্রশংসার বদলে সমালোচিত হয়েছে, সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের অতিউৎসাহ ও বাড়াবাড়ির কারণে।
দেশে বিরোধী দল কার্যত নিষ্ক্রিয়। সরকারের কাজকর্মে কেউ বাধা দিচ্ছে না। দেশে হরতাল-ধর্মঘট নেই। সব কিছু সরকার এবং সরকারি দলের দখলে বা নিয়ন্ত্রণে। তাই বিরোধী দলের ওপর কোনো বিষয়ে দায় চাপানোর কোনো সুযোগ এখন সরকারের নেই। এমন বাধাহীন পরিবেশে প্রথম এক বছরে সরকার কি এমন ভালো কাজ করলো যা মানুষের মুখে মুখে আলোচিত হচ্ছে বা হওয়ার মতো? মন্ত্রিসভায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নতুন মুখ অন্তর্ভুক্ত করে একটি চমক অবশ্যই দেখানো গেছে। দীর্ঘ দিনের মন্ত্রীদের বাদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রশংসিত হয়েছেন। কিন্তু চমকের মন্ত্রীরা কেউ এক বছরে কোনো বড় চমক দেখাতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। বরং দেখা যাচ্ছে, প্রায় সব ব্যাপারেই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা কিংবা হস্তক্ষেপ লাগছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে মন্ত্রীরা কথা বলছেন কিন্তু দুর্নীতি কমেছে বা বন্ধ হয়েছে বলে মানুষ মনে করছে না। মানুষ কাজের গতি দেখতে পারছে না, বরং এক ধরনের স্থবিরতা যেন লক্ষ করা যাচ্ছে।
ভালো খবরের চেয়ে খারাপ খবর বেশি পাওয়া যাচ্ছে। এটা কি প্রচার মাধ্যমের একদেশদর্শিতার কারণে? নাকি সত্যি ইতিবাচক কিছু ঘটছে না দেশে? সড়কে নৈরাজ্য বন্ধ করা যাচ্ছে না। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা কমছে না। নারী নির্যাতনের ঘটনাও উদ্বেগের মাত্রা বাড়িয়েছে। বনানীর বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অনেকের প্রাণহানির ঘটনার পর জানা গেছে, রাজধানীর অনেক ভবনই যথাযথ অনুমোদন নিয়ে তৈরি হয়নি। সরকার আগের মেয়াদে কেন কোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়েছে, সে প্রশ্ন সামনে আসছে। আগে যা পারেনি, এবার তা পারবে তেমন কোনো লক্ষণ কি এক বছরে দেখা গেলো? তবে সেপ্টেম্বর মাস থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করায় এবং সরকার সমর্থক কয়েকজনকে গ্রেফতার করায় সরকার প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু দুর্নীতিবিরোধী বা শুদ্ধি অভিযান যদি গতি হারায় বা মাঝ পথে বন্ধ হয়ে যায় তাহলে সরকারের উদ্দেশ্যের সততা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেছেন।
নুসরাত নামের ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রীকে আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনাটি সুশাসনের অভাবের বিষয়টি নগ্নভাবে সামনে এনেছে। এই ঘটনার সঙ্গে শাসক দলের স্থানীয় পর্যায়ের কারো কারো সম্পৃক্ততার বিষয়টি সরকারের জন্য নিশ্চয়ই বিব্রতকর। তবে এই ঘটনার দ্রুত বিচার এবং অপরাধীদের শাস্তির রায় জনমনে কিছুটা হলেও স্বস্তি দিয়েছে।
এক বছর হয়তো একটি সরকারের মূল্যায়ন-পর্যালোচনার জন্য যথেষ্ট সময় নয়। কিন্তু এক বছরেও যদি কোনো ‘ট্রেন্ড সেট' করা না যায় তাহলে পরবর্তী সময় নিয়ে খুব আশাবাদী হওয়ার কিছু থাকে কি? দেশে উন্নয়নমূলক কাজ অনেক হচ্ছে সন্দেহ নেই। সরকার অনেক বড় বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছে। কিন্তু প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের ধীর গতি মানুষকে আশাহত করছে। কোনো প্রকল্পই নির্ধারিত সময়ে শেষ করা যায় না। সব প্রকল্পেই ব্যয় বাড়ে। কোনো কোনোটায় বাড়ে মানুষের ভোগান্তি। বলা হয়, ব্যয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতিও বাড়ে। ফলে মানুষের মধ্যে দেখা দেয় অসন্তোষ, ক্ষোভ। ঘন ঘন সরকার বদল হলে উন্নয়ন ব্যাহত হয়। টানা সরকারে থেকেও যদি মানুষের আশা পূরণ না করা যায় তাহলে হতাশা বাড়ে। এক বছর পর দেশের মানুষ সরকারের গতিশীলতা দেখতে চায়। কাজ দেখতে চায়। স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখতে চায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে মানুষের অনেক আবদার আছে কিন্তু যুক্তিহীন দাবি বুঝি একটিও নেই।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
এইচআর/জেআইএম