তবে কেন লোক হাসালি…

প্রভাষ আমিন
প্রভাষ আমিন প্রভাষ আমিন , হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ
প্রকাশিত: ১০:৩৯ এএম, ২০ জানুয়ারি ২০২০

একেই বলে চেইন রি-অ্যাকশন বা স্নো বল অ্যাফেক্ট। ছোট্ট একটা ভুল থেকে যে কত রকমের জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে, তার উদাহরণ হতে পারে এবারের ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তারিখ বিতর্ক। এই বিতর্কে কারও ভুল ছিল বা খামখেয়ালি ছিল। কিন্তু দোষ ছিল না কারও। তবু এ নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করল, বিক্ষোভ করল, শেষ পর্যন্ত আমরণ অনশন করে দাবি আদায় করল। আবারও প্রমাণিত হলো, দাবি ন্যায্য হলে তা আদায় করা অসম্ভব নয়। দাবিটা যে ন্যায্য সেটা নির্বাচন কমিশন বোঝেনি, হাইকোর্ট বোঝেনি। আসলে মানুষের অনুভূতি ছুঁতে হলে হৃদয় থাকতে হয়। সেটার বড্ড অভাব আমাদের মাঝে। আমরা বড় বেশি কাগজ দেখে সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু কাগজে তো হৃদয় লেখা থাকে না।

কাগজের সিদ্ধান্তটাই ধরুন। বাংলাদেশে নির্বাচন, পরীক্ষা, এমনকি রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিও ক্যালেন্ডার দেখে ঠিক হয়। কোনো ছুটি আছে কিনা, ধর্মীয় অনুষ্ঠান আছে কিনা, কোনো জাতীয় উৎসব আছে কিনা। কোনো ধর্মীয় উৎসবে তো ভোট, পরীক্ষা, রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি হবেই না; এমনকি হবে না স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস, নববর্ষ ইত্যাদি অনুষ্ঠানেও ভোট, পরীক্ষা হয় না। তাই ক্যালেন্ডার সামনে নিয়েই সব তারিখ ঠিক করতে হয়। কিন্তু ক্যালেন্ডারেই যদি ভুল থাকে, তবেই লাগে গণ্ডগোল। প্রতিবছরই সরকারি ছুটির তালিকা প্রণয়ন করা হয় এবং তা মন্ত্রিসভার অনুমোদন লাগে। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটির তালিকা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

তাদের তালিকায় সরস্বতী পূজার ছুটি নির্ধারিত আছে ২৯ জানুয়ারি। সেই ক্যালেন্ডার দেখেই নির্বাচন কমিশন ভোটগ্রহণের তারিখ ঠিক করেছে। তাই এ পর্যন্ত তাদের কোনো ভুল নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও যে বিশাল ভুল করে ফেলেছে, তা কিন্তু নয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজার সময় নির্ধারিত হয় গ্রহ-নক্ষত্র তিথি মিলিয়ে। এবার সরস্বতী পূজার তিথি শুরু হবে ২৯ জানুয়ারি সকাল সোয়া ৯টায়, শেষ হবে ৩০ জানুয়ারি সকাল ১১টায়। তবে সরস্বতী পূজা পালিত হবে ৩০ জানুয়ারি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় তিথির শুরু দেখেই ছুটি ঠিক করে ফেলেছে। এই ভুল থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং নির্বাচন কমিশনের শিক্ষা নেয়ার অনেক কিছু আছে। শুধু ক্যালেন্ডার দেখেই সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। ধর্মীয় বিষয়ে সংশয় থাকলে ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ নিতেই হবে। ভুলটা শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা নির্বাচন কমিশনের নয়। তবুও ভুগতে হলো সবাইকেই। এ আসলে ভুল নয়, গ্রহের ফের।

তারিখ নির্ধারণে ভুল না করলেও নির্বাচন কমিশন এরপর যা করেছে, তা তাদের হাস্যকর করে তুলেছে। তফসিল ঘোষণার পরপরই গণ্ডগোলটা ধরা পড়ে। সঙ্গে সঙ্গেই হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করলেও নির্বাচন কমিশন সাড়া দেয়নি। সঙ্গে সঙ্গে ভুলটা সংশোধন করলে পানি এত দূর গড়াত না। কথায় বলে গাধা পানি খায়, তবে ঘোলা করে খায়। কমিশনেরও হয়েছে সেই দশা।

ব্যক্তিগত যোগাযোগে ব্যর্থ হয়ে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ স্মারকলিপি দিয়েও প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এরপর বিষয়টি যায় হাইকোর্টে। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালতও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়টি সংবেদনশীলতার সঙ্গে বিবেচনা করতে পারেননি। সুপ্রিম কোর্টের ক্যালেন্ডারেও ২৯ জানুয়ারি সরস্বতী পূজার ছুটি। আর ক্যালেন্ডার প্রণয়নের পরপরই প্রতিবাদ করা হয়নি কেন, এই অজুহাতে হাইকোর্ট রিট খারিজ করে দেন। বাধ্য হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামে, শুরু করে আমরণ অনশন।

কিন্তু হাইকোর্টে রিট খারিজের পর নির্বাচন কমিশন যেন হাতে চাঁদ পেয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা যখন আমরণ অনশনে অনুস্থ হয়ে হাসপাতালে নির্বাচন কমিশন তখনও অনড়। নির্বাচন কমিশন সচিব মো. আলমগীর এমন সব কথা বলতে শুরু করলেন, যেন নির্বাচনের তারিখ বদলালে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে, যুক্তরাষ্ট্র আর ইরানের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যাবে। তিনি বলে দিলেন, নির্বাচন আগানো-পেছানোর কোনো সুযোগ নেই। কমিশনের আচরণ দেখে আমার ছেলেবেলার কথা বলে মনে হচ্ছিল। ছেলেবেলায় যদি যেতে না চায়, গো ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। এটার সুন্দর ইংরেজি আছে, স্টাবোর্ন গোট; ভালো বাংলা কী হবে? গোয়ার ছাগল।

নির্বাচন কমিশন সচিব মো. আলমগীর একদিন বললেন, শিক্ষার্থীরা না বুঝে আন্দোলন করছে। এখন তো বুঝলেন মাননীয় সচিব মহোদয়, ঠ্যালার নাম বাবাজি। আপনার আমলাতান্ত্রিক বুঝ দিয়ে দেশ চলে না। পোলাপানের অবুঝ আন্দোলনের নড়িয়ে সকল গোয়ারের ভিত।

আমি শুরু থেকেই জানতাম, সরস্বতী পূজার দিনে কিছুতেই ভোট হবে না। কারণ বিদ্যার দেবী সরস্বতীর পূজা, হিন্দু সম্প্রদায়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎসব। তারচেয়ে বড় কথা হলো, এই পূজাটা বাসাবাড়ির পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও হয়। আর ভোটকেন্দ্র হয় মূলত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। জ্ঞানী সচিব মহোদয় বুঝেছিলেন একইসঙ্গে ভোট ও পূজা সম্ভব। আর আমরা মূর্খরা বুঝেছিলাম, সম্ভব নয়। জ্ঞানীরা মানুষের আবেগ-অনুভূতি কম বোঝে। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটেছে, তবে আমরা জানি, অবস্থা এখনও এতটা খারাপ হয়নি যে সরস্বতী পূজার দিনে ভোট করতে হবে। নির্বাচন কমিশন সচিবের মতো অসংবেদনশীল মানুষরাই দেশে সংখ্যালঘু। বরং এই সংখ্যালঘুদের চাপে কোণঠাঁসা হয়ে পড়া ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ানোর মতো সংবেদনশীল মানুষের সংখ্যাই বেশি।

তবে নির্বাচন পেছানোতে অনেকগুলো প্রশ্ন এসেছে সামনে। পেছানো যদি গেলই, তবে এত জল ঘোলা হলো কেন, কেন আগে বদলানো হলো না বা গেল না? তারচেয়ে বড় কথা দাবিটা যদি ন্যায্য হয়, তবে সেটা আদায় করতে আমরণ অনশনে যেতে হবে কেন? বঙ্গবন্ধু তো বলে গেছেন, ন্যায্যকথা একজন বললেও তা মানতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অবুঝ শিক্ষার্থীরা যেটা বুঝল, নির্বাচন কমিশন ও হাইকোর্ট সেটা বুঝল না কেন? তাহলে কি ভবিষ্যতে ন্যায্য দাবির ফয়সালাও রাজপথেই করতে হবে?

কয়েকদিন নির্বাচন কমিশন সচিবের কথা শুনে মনে হয়েছিল, নির্বাচনের তারিখ বদলালে ভূমিকম্প হবে, সাইক্লোন হবে, সুনামি হবে। তাই ছুটির দিনে জরুরি মিটিং শেষে সিইসি যখন নির্বাচন দুদিন পেছানোর ঘোষণা দিচ্ছিলেন; আমি তখন চেয়ারের হাতল ধরে শক্ত করে ধরে বসেছিলাম। না, কিছুই হয়নি। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটা ছোটখাটো কম্পন হয়েছে, তবে সেটা হাসির। নির্বাচন পেছানোর সিদ্ধান্ত নিয়েও কারও ধন্যবাদ পায়নি কমিশন। বরং সবার হাসির পাত্র হয়েছে। অনেকেই লিখেছেন, সেই তো নথ খসালি, তবে কেন লোক হাসালি? সহানুভূতি তো দূরের কথা, সবাই বরং সন্দেহ করছে কমিশনকে।

অনেকের ধারণা, নির্বাচন পেছানোর সিদ্ধান্তটাও নিজেরা নিতে পারেনি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন। ওবায়দুল কাদের যখন বললেন, নির্বাচনের তারিখ বদলালে সরকারের আপত্তি নেই, তখনই গোয়ার গোবিন্দ কমিশন নড়েছে। বাংলাদেশের অনেক নির্বাচন কমিশনই সরকারের তল্পিবাহক ছিল, তবে বর্তমান কমিশন সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। তবে একটা বিষয় মাথায় ঢুকল না, নির্বাচন না এগিয়ে পেছাল কেন? একদিন এগিয়ে ২৯ জানুয়ারি করলেই তো ল্যাঠা চুকে যেত। নির্বাচন দুদিন পেছানোয় পিছিয়ে গেল এসএসসি পরীক্ষা। এমনকি বাংলাদেশের ঐতিহ্যের অংশ হয়ে যাওয়া বইমেলা এবার শুরু হবে একদিন পর। একেই বলে স্নো বল অ্যাফেক্ট। তিথির ভুলে একটা ছোট্ট স্নো বল গড়িয়ে ক্যালেন্ডারে ঢুকে গেল, ক্যালেন্ডার থেকে নির্বাচন কমিশন, কমিশন থেকে হাইকোর্ট। ছোট্ট স্নো বল গড়াতে গড়াতেই বড় হলো, গেল শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। বলটা এত বড় হলো; তার এক ধাক্কায় পিছিয়ে গেল ভোটগ্রহণ, পরীক্ষা ও বইমেলা।

কমিশনের ব্যাপারে আরও সন্দেহ আছে। আসলে তারা অতীতে এমনসব অবিশ্বাস্য নির্বাচন করেছে, এখন আর তাদের কেউ বিশ্বাস করে না, খালি সন্দেহ করে। কমিশন নাকি ইভিএম বিতর্ক আড়াল করতেই তারিখ বিতর্ক জিইয়ে রেখেছিল। তবে আমি এটা বিশ্বাস করি না। আসলে তারা বুঝতেই পারেনি। তবে এখন কমিশনের সামনে একটা সুবর্ণ সুযোগ। তাদের প্রতি মানুষের ঘৃণা, গালি, অবিশ্বাস, সন্দেহ উড়িয়ে দেয়ার একটাই চান্স; একটা ভালো ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান। সেটা কি তারা পারবেন, নাকি এর জন্যও ওবায়দুল কাদের কী বলেন, সে দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে?

এইচআর/বিএ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।