নারীবান্ধব মানবিক সমাজ কবে!
অডিও শুনুন
সম্প্রতি রাজধানীর কুর্মিটোলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ধর্ষণের বিচার চেয়ে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বিভিন্ন জায়গায় চলে নানা রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মসূচি। সবাই ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাচ্ছেন। ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত মজনুকেও দ্রুততম সময়ের মধ্যে ধরতে পেরেছেন আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক বিচার কি হবে? পাশাপাশি একটা প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে, এই আধুনিক যুগেও নারীর নিরাপত্তা নেই কেন রাষ্ট্রে। নিশ্চিতের দায়িত্ব কারোর নেই কি?
চলুন একটু পেছন ফিরে দেখি, কুমিল্লা সেনানিবাসের সুরক্ষিত চৌহদ্দির ভেতরেই তো ধর্ষণের শিকার হলো তনু। শুধু তাতেই ক্ষান্ত হয়নি ধর্ষক, খুনই করে ফেললো একটি সম্ভাবনাময় জীবনকে। সেই দিনাজপুরের ইয়াসমিন থেকে তৃষা, তনুসহ সর্বশেষ গত বছরের নুসরাত পর্যন্ত- কোনটির পরিপূর্ণ বিচার কি হয়েছে, যা দৃষ্টান্ত হয়ে একটু হলেও ধর্ষকদের ভীত করে তুলতে পারে? কেউ কি হলফ করে বলতে পারেন, আদৌ এই ধর্ষণ এবং ধর্ষণসহ হত্যা মামলাগুলোর সুষ্ঠু বিচার কি আমাদের নিশ্চয়তা দেবে, আর কোন ধর্ষণ হবে না। আর কোন নারী শিশুর ওপর কোন ধর্ষকের কালো থাবা আসবে না।
অহরহই ধর্ষণ, খুনের ঘটনা শোনা যায়। কয়েকদিন পর পর বেশ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে ঘটনাগুলো। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও নড়েচড়ে বসে। জেগে উঠেন মানবাধিকার কর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেনি-পেশার মানুষ। কিন্তু কয়েকদিন পরই আবার বিষয়টি কেন যেন ঝিমিয়ে পড়ে। ২০২৯ সাল নাগাদ দেশের নগরগুলোর জনসংখ্যা আট কোটি ছাড়িয়ে যাবে। আর ২০৫০ সালের পর বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ নগরে বসবাস করবে। এই জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি নারী ও শিশু। সেই নগর নারীর জন্য কতখানি নিরাপদ তার বিবেচনা এখন সময়ের দাবি। সংশ্লিষ্টদের মনে রাখা জরুরি যে, যে নগর নারীর জন্য যত নিরাপদ, সে নগর তত বেশি টেকসই; তত বেশি সমৃদ্ধ ও পরিবেশবান্ধব হয়।
শুধু সুউচ্চ ভবন বা স্থাপনা তৈরি হলেই নগরায়ণ হয় না। উন্নত ও বাসযোগ্য নগর গড়ে তুলতে প্রতিটি নাগরিকের জন্য বিশেষ করে নারী ও শিশুর জন্য নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি জরুরি। কারণ বাসস্থান, কর্মস্থল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও চলাফেরা—এসব ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতায় সবচেয়ে বেশি ভুগছে নারী ও শিশুরা।
বর্তমান নগরগুলোর চারপাশে তাকালে দেখা যায়, শুধু ব্যবসায়িক পরিকল্পনায়ই নগর উন্নয়ন করা হচ্ছে। তাই পাড়া-মহল্লায়ও শুধু খাবার, কাপড়সহ ইত্যাকার নানা ধরণের দোকান সাজানো থাকে। কিন্তু খোলা মাঠ, বিনোদনের জন্য একখন্ড জায়গা খুঁজতে গেলে কয়েক এলাকা ঘুরে মরতে হচ্ছে। অথচ শিশুর বিকাশের জন্য খোলা মাঠ কতটা জরুরি তা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। ঢাকার অনেক মাঠের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। যদি এলাকাভিত্তিক ছোট জায়গাগুলোও একটু বিনিয়োগ ও সংস্কার করে ব্যবহারের উপযোগী করা যায়, তাতেও অনেকটাই প্রশস্ত মানসিকতা নিয়ে বড় হওয়ার সুযোগ পাবে আগামী প্রজন্ম।
নারীদের অধিকার ও তাদের সুরক্ষায় সরকার ভিশন ২০২১ বাস্তবায়নে গ্রহণ করেছে নানা পরিকল্পনা। ইভটিজিং ও বখাটেদের উত্যক্তের হাত থেকে নারীদের রক্ষার জন্য সারা দেশে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে করা হচ্ছে জেল-জরিমানা। তারপরও নারীদের প্রায় ৬৭ শতাংশ পরিবার, পরিবহন, সমাজ ও কর্মক্ষেত্রে কোনো না কোনোভাবে নিপীড়ন, নির্যাতন, যৌন হয়রানি ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।
বর্তমানে সমাজ ব্যবস্থার নানা অসঙ্গতি দেখে আমার প্রায়শই মনে হয়, ডায়ালিসিসের মাধ্যমে রোগীর শরীর থেকে অপ্রয়োজনীয় পানি যেমন নিষ্কাশন করা যায়; তেমনি সমাজটা নির্মল ও নিষ্পাপ রাখতে যদি এরকম কোন ডায়ালিসিস পদ্ধতি থাকতো, যার মধ্য দিয়ে সমাজের পশুত্ব দূর করা যেত! প্রতিটি মানুষ মনের ময়লা ঝেড়ে মানবিক সমাজ গড়তে পারতো! আহা, হবে কি পূরণ, এমন স্বপ্ন-সাধ!
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, বাংলাভিশন।
এইচআর/এমএস