মুজিববর্ষে যেন আর কোনো ছেলেমানুষি না হয়
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ শুধু বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বের উৎসব। দিবসটি পালিতও হবে বিশ্বজুড়ে, বছরজুড়ে। আয়োজনে শামিল হয়েছে ইউনেস্কোও। কারণ বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশের নেতা ছিলেন না, ছিলেন নিপীড়িত বিশ্বের মানুষের নেতা। এখনও বিশ্বে অন্যায়-অবিচার-বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামে অনন্ত অনুপ্রেরণার উৎস বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এখনও বঙ্গবন্ধু প্রাসঙ্গিক।
আগামী ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ৯৯তম জন্মদিনে শুরু হবে মুজিববর্ষ, যা শেষ হবে আগামী বছরের ১৭ মার্চ। মুজিববর্ষ থেকেই ২৬ মার্চ বাংলাদেশ পা রাখবে ৫০ বছরে। সব মিলিয়ে সাজ সাজ রব। মুজিববর্ষের ক্ষণগণনা শুরু হয়েছে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের জন্য উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। মুজিববর্ষের ক্ষণগণনা শুরু নিয়ে সেই কমিটির ব্যাপক প্রস্তুতি ছিল, ছিল সাজ সাজ রব।
ক্ষণগণনাটা কীভাবে শুরু হবে, তার কিছুটা জানা ছিল আগেই, তাই একধরনের এক্সাইটমেন্টও ছিল। ক্ষণগণনার সে অনুষ্ঠানে আমারও আমন্ত্রণ ছিল। তবে অনুষ্ঠানটি সঠিকভাবে সম্প্রচারের জন্য আমি অনুষ্ঠানস্থলে না গিয়ে অফিসে যাই। মুজিববর্ষের ক্ষণগণনার জন্য দেশের ৫৩টি জেলা, ২টি উপজেলা, ১২টি সিটি কর্পোরেশনের ২৮টি স্থান এবং রাজধানীর বিভিন্নস্থানে ৮৩টিসহ মোট ১৫০টি কাউন্টডাউন ঘড়ি বসানো হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে এই ক্ষণগণনার উদ্বোধন করেন। তবে ক্ষণগণনার চেয়েও বেশি আগ্রহ ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পুনর্মঞ্চায়ন নিয়ে।
৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দুপুরে বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ রয়েল এয়ারফোর্সের একটি বিশেষ বিমানে ফিরেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে। সেই আবহ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা ছিল এবারের বিশেষ আয়োজনে। পুরো আয়োজনটি করা হয় তেজগাঁওয়ের সেই ঐতিহাসিক বিমানবন্দরেই, যেখানে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশে পা রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ব্যবস্থা ছিল পুরোনো একটি বিমানেরও। সব মিলিয়ে দারুণ এক্সাইটমেন্ট।
বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসার দিনটি বাংলাদেশের মানুষের জন্য গভীর আবেগের। দীর্ঘ ২৩ বছরের মুক্তিসংগ্রাম আর ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে বিজয় অর্জিত হয়। কিন্তু তবুও যেন পূর্ণতা পায়নি বিশ্বের বুকে নতুন মানচিত্র বাংলাদেশ। বিজয় অর্জনের ২৫ দিন পর পূর্ণতা পেল মুজিবের প্রিয় বাংলা, স্বপ্নের সোনার বাংলা। কারণ পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন-দিল্লি হয়ে প্রিয় বাংলাদেশে ফিরে এলেন এই দেশের স্বপ্নদ্রষ্টা মুজিব। স্বদেশের মাটিতে পা রেখে সহকর্মীদের আলিঙ্গণে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন বঙ্গবন্ধু। তাঁর আবেগ যেন ছুঁয়ে যায় লাখো মানুষকেও।
তেজগাঁও থেকে সোহরাওয়ার্দীর পথে পথে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী ট্রাক বারবার আটকে যায় জনস্রোতে। ৭১এর ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি বিশ্বের সেরা ভাষণের একটি। আবেগ এবং সময়ের বিবেচনায় সেটি সেরা। কিন্তু ৭২এর ১০ জানুয়ারি সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই বঙ্গবন্ধু যে ভাষণটি দিয়েছিলেন, সেটিও অন্যতম সেরা। এই দেশের প্রতি দেশের মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর গভীর ভালোবাসা ফুটে উঠেছে কথায় কথায়। ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার অঙ্গীকার।
বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসার আবেগ ছড়িয়ে পড়ে ওপার বাংলায়ও। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ৭২ এর ১০ জানুযারি আকাশবাণী কলকাতায় প্রচারিত হয়- ‘বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে তোমার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায় তুমি আজ/ঘরে ঘরে এত/খুশি তাই/কী ভালো তোমাকে বাসি আমরা/ বলো কী করে বোঝাই।’ তাই ১০ জানুয়ারি ফিরে এলে বারবার আমরা আবেগাপ্লুত হই। এবার আরো বেশি ছিলাম। কারণ এবার উপলক্ষটা বিশেষ, আয়োজনও বিশেষ।
১০ জানুয়ারি বিকেলে যখন পুরোনো একটি বিমান প্রতীকী হিসেবে তেজগাঁও বিমানবন্দরে থামে। আবেগের ঢেউ খেলে যায়। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা, শেখ হাসিনার পুত্র সজিব ওয়াজেদ জয় ছিলেন অনুষ্ঠানে। ছিলেন দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। তবে দর্শকসারিতে ড. কামাল হোসেনকে দেখে ভালো লাগলো। বর্তমানে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হলেও ড. কামাল হোসেন পাকিস্তান থেকে বঙ্গবন্ধুর সাথেই বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন।
রাজনীতিতে এই উদারতাই আমরা প্রত্যাশা করি। দর্শক সারিতে ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মহিউদ্দিন আহমেদ, যিনি বঙ্গবন্ধুর লন্ডনের সময়টুকুতে কাছাকাছি ছিলেন। এ গভীর আবেগ বড় ধাক্কা খেল লেজার শো’তে। বিমানের দরজায় লেজারে বঙ্গবন্ধুকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা হলো। এটুকু তবু মেনে নেয়া যায়। এরপর যা হলো, তাকে হাস্যকর বললেও কম বলা হয়। বিমানের দরজা থেকে একটা আলোর পিন্ড সাদা কার্পেটেরে ওপর দিয়ে এগিয়ে যায় মঞ্চের দিকে। সেই আলোর দলায় ফুল দিয়ে
স্বাগত জানানো হয়।
সবাই দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানায়। সশস্ত্র অভিবাদন জানায় তিনবাহিনী। পুরো বিষয়টিই হাস্যকর। কিন্তু আমার একটুও হাসি আসেনি। বরং কান্না পেয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এ হাস্যকর ছেলেমানুষি, তাঁকে ভালোবাসা নয়, অপমান করা হয়েছে। আমাদের পরম আবেগের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। নিজেকে প্রতারিত মনে হচ্ছিল। বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকে অনেক ট্রল হয়েছে। আমার তাই হাসি আসেনি, কান্না পেয়েছে। পুরো আয়োজনে উৎকট বাণিজ্য ছিল, কোনো আবেগ ছিল না।
বিষয়টিকে দুইভাবে বিবেচনা করা যায়। মর্নিং শোজ দ্যা ডে- যদি সত্যি হয়; তবে আগামী একবছরে আমাদের আরো অনেক কাঁদতে হবে। তবে সুযোগ আছে, ক্ষণগণনার ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে মুজিববর্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার, মহিমান্বিত করার। মুজিববর্ষের আয়োজনে যেন বঙ্গবন্ধুর প্রতি জাতির আবেগ, ভালোবাসার প্রতিফলন ঘটে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সত্যিকারের আদর্শের বাস্তবায়নে যেন আমরা সবাই কাজ করতে পারি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের উন্নত, সমৃদ্ধ, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়াই যেন আমাদের সবার ব্রত হয়।
এইচআর/পিআর