ধর্ষণ ও খবর

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ১০:০১ এএম, ১১ জানুয়ারি ২০২০

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনার পর মিডিয়ার কাভারেজ ও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিক্রিয়া নিয়ে কথা উঠছে। ধর্ষণের কদর্যতা, মেয়েটির আহত-সন্ত্রস্ত দশা, ঘটনা নিয়ে উত্তাল প্রতিবাদ নাগরিক মনে, বিশেষ করে নারীদের মনের উপর এগুলোর অভিঘাত কেমন হচ্ছে, কিংবা এসব খবর কাউকে ধর্ষক হতে প্রলুব্ধ করছে কিনা, সেই ভাবনা তৈরি হচ্ছে।

গণমাধ্যমে নারীর প্রতি সহিংসতার সংবাদ প্রচার ও প্রকাশের ধরন নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। একটা পরিবর্তনতো এসেছেই। ধর্ষণের খবর নির্মাণ বদলানো সম্ভব হয়েছে। একটা সময় ধর্ষণ ছিল সেই নারী ও তার পরিবারের লজ্জা। সামাজিক শক্তি সমূহের সহযোগিতায় গণমাধ্যম নারীর প্রতি সব প্রকার সহিংসতাকে ‘প্রশাসনের সংকট’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে।

ধর্ষণকে নারীদের ‘সম্মানহানি’ থেকে নিয়ে আসা গিয়েছে তাদের ‘অধিকারভঙ্গে। নারীদের নিরাপত্তা রাষ্ট্রের দায়– এমন কথা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে রাজপথে নামা বেড়েছে। এটা হয়েছে কারণ নাগরিক সমাজ বিশেষ করে নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো এ নিয়ে সোচ্চার হয়েছে এবং মিডিয়াকে পাশে চেয়েছে। সবচেয়ে বেশি সম্ভব করেছে নারী সাংবাদিকরা, যারা অনেক সংবেদনশীল কায়দায় এসব খবর লিখছেন, বলছেন এবং এ নিয়ে আলোচনা করছেন। কিন্তু তবুও মনে হচ্ছে অনেক দূর যেতে হবে আমাদের মিডিয়াকে।

ধর্ষণের খবরে একটা ছাচে ঢালা পদ্ধতি যেন সবাই অনুসরণ করছে। আমরা মিডিয়ায় কি ধরনের শব্দ ব্যবহার করছি সে নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন। কোন কোন পত্রিকা বা অনলাইন এখনও যখন লিখে রাতভর ধর্ষণ, উপর্যুপরি ধর্ষণ, পালাক্রমে ধর্ষণ, সম্ভ্রমহানি, শ্নীলতাহানী, যখন ধর্ষণের খবর লিখতে গিয়ে সাংবাদিক লিখে ফেলেন মেয়েটি স্কার্ট পরা ছিল, তার গায়ে জিন্স প্যান্ট ও গেঞ্জি ছিল, তখন কি নারীকে সন্মান দেওয়া হয়?

মিডিয়া নারীর অসম্মতির অধিকার ভঙ্গ হলে খবর করে। কিন্তু নারীর সম্মতিও তার অধিকার, সেটা ভাবনায় আনে না মিডিয়া। অর্থাৎ, কোন নারী যদি বিয়ের বাইরে যৌনসম্পর্কে জড়াতে চায়, এটা যে তার অধিকার সেটা নিয়ে জোরে বলছে না, বা বলতে পারছে না। এটা বলতে পারছে না বলেই নানা গল্প সৃষ্টি হতে থাকে, লেখা হতে থাকে, ‘স্বেচ্ছায় প্রেমিকের সাথে বাইরে গিয়েছিল মেয়েটি’- জাতীয় বাক্য। আর তখন অনেকেই বলতে শুরু করে ‘মেয়েগুলোরও দোষ আছে’।

মেয়েদের প্রতি সম্মান, সহানুভূতি বজায় রেখে ধর্ষণের খবরে সম্মতি, সহমতের প্রসঙ্গ কী করে আনা যাবে, আজ সাংবাদিকদের সামনে সেটাই চ্যালেঞ্জ। ধর্ষণের খবর লিখতে হলে শুধু নারী নির্যাতন নয়, ক্ষমতা থেকে, রাজনীতি থেকে সমাজে কিভাবে অন্যায় প্রশ্রয় পাচ্ছে সেটা বোঝার মত পলিটিক্যাল কারেক্টনেস থাকা দরকার।

ধর্ষণের শিকার নারীর নাম-পরিচয় প্রকাশ করছে না আমাদের মিডিয়া। এটি অবশ্যই একটি ভাল দিক। ভিকটিমের নাম-পরিচয় প্রকাশ করা হলে তারা অসম্মানিত হয়। কিন্তু ধর্ষণের শিকার হলেই সন্মান গেল, হেয় হতে হয়, এমন ধারণা ভাঙার দায়িত্বও মিডিয়ার।

পশ্চিমা সমাজে, এমনকি ভারতেও অনেক রেপ ভিকটিম প্রকাশ্যে আসছেন, বলছেন যে তারা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তারা এ নিয়ে আন্দোলনও গড়ে তুলেছেন যার যার অবস্থান থেকে। ধর্ষণের শিকার হলেই তিনি হেয় হবেন, তার সন্মান চলে যাবে এমন ধারণা থেকে বের করে আনার মত খবর নির্মাণ পদ্ধতি এবার শুরু করতে পারেন গণমাধ্যম কর্মীরা।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/এমএস

‘ধর্ষণের খবরে একটা ছাচে ঢালা পদ্ধতি যেন সবাই অনুসরণ করছে। আমরা মিডিয়ায় কি ধরনের শব্দ ব্যবহার করছি সে নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন। কোন কোন পত্রিকা বা অনলাইন এখনও যখন লিখে রাতভর ধর্ষণ, উপর্যুপরি ধর্ষণ, পালাক্রমে ধর্ষণ, সম্ভ্রমহানি, শ্নীলতাহানী, যখন ধর্ষণের খবর লিখতে গিয়ে সাংবাদিক লিখে ফেলেন মেয়েটি স্কার্ট পরা ছিল, তার গায়ে জিন্স প্যান্ট ও গেঞ্জি ছিল, তখন কি নারীকে সন্মান দেওয়া হয়?’

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।