দল গোছাচ্ছে আওয়ামী লীগ, অপেক্ষায় বিএনপি
শীতকালে আমাদের দেশে সাধারণত রাজনীতির বাজার তুলনামূলক ভাবে গরম থাকে। দেশে বড় সব আন্দোলন-সংগ্রাম শীতের আগেপরেই হয়েছে। এবছর সারা দেশে শীতের প্রকোপ বেশি। শীতে মানুষ জুবুথুবু হয়ে আছে। তবে রাজনীতিতে এখন পর্যন্ত গরম হাওয়া নেই। রাজনীতির মাঠ সহসা গরম হয়ে ওঠার কোনো লক্ষণও নেই। তবে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কিছুটা গরম ভাব দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি মুখোমুখি হচ্ছে ৩০ জানুয়ারি।
আমাদের দেশে নির্বাচনে কেউ হারতে চায় না। যে প্রার্থীর একশো জন কর্মী নেই, তিনিও জয়ের কথাই ভাবেন। বিএনপিকে জেতার সুযোগ করে দিয়ে আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই নিরপেক্ষতার প্রমাণ দেবে না। সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে কিছু মানুষের মধ্যে উত্তাপ থাকলেও অনেককে নিরুত্তাপই দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ ধরেই নিয়েছেন, সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগই জিতবে। এমন সম্ভাবনার কথা বিএনপিও প্রচার করছে।
উত্তাপ ছড়ানোর রাজনীতির দিন কি তাহলে শেষ হয়ে গেল? এই প্রশ্নের জবাব এখনই এক কথায় দেওয়া যাবে না। তবে এটা ঠিক যে দেশের মানুষ রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন দেখতে চায়। রাজনীতির কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা যেন ব্যাহত না হয়, আয়-উপার্জনে ব্যাঘাত না ঘটে– মানুষ সেটাই চায়। তাই এখন রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণার আগে নেতানেত্রীদের মানুষের মনোভাবের কথাটা বিবেচনায় নিতে হবে। রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে হরতাল-ধর্মঘট ইতিমধ্যে কার্যকারিতা হারিয়েছে। কথামালার রাজনীতিতে যে সাধারণ মানুষের আস্থা-ভরসা নেই, সেটা বোঝা যাচ্ছে। বিএনপি সমর্থকরাও নেতাদের ডাকে রাস্তায় নামে না আস্থাহীনতার কারণেই।
জাতীয় ভাবে দৃশ্যত রাজনীতির ময়দানে বড় কোনো খেলা নেই। মাঠের বিরোধী দল বিএনপিকে সরকার কোণঠাসা করে রেখেছে। সভা-সমাবেশের অনুমতি খুব একটা দেওয়া হয় না। তাই বিএনপি ঘরোয়া রাজনীতি অর্থাৎ সেমিনার, সংবাদ সম্মেলন কিংবা বড় জোর মানববন্ধন কর্মসূচিতে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছে। প্রতিদিনই কোনো না কোনো উপলক্ষে বিএনপি নেতারা বক্তব্য রাখছেন। গণমাধ্যমে তাদের বক্তব্য প্রচার ও প্রকাশ হচ্ছে। দেশে কথা বলার স্বাধীনতা নেই বলে অনেক কথাই বলা হচ্ছে।
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের রাজনীতিও এখন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা কিংবা দিবস পালনের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। নিয়মিত রাজনৈতিক কার্যক্রম বলতে এখন শুধু পাল্টাপাল্টি বক্তৃতা-বিবৃতি দেওয়াকেই বোঝায়। জাতীয় রাজনীতি যখন গতিহীন তখন তৃণমূলের রাজনীতি যে স্থবির অবস্থায় থাকবে– সেটা নিশ্চয়ই কোনো অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমাদের দেশের রাজনীতি প্রায় সব সময়ই ওপর থেকে নিচে যায়। নিচ থেকে ওপরে ওঠে না।
আওয়ামী লীগ অবশ্য দল গোছানোর চেষ্টা করছে। জাতীয় সম্মেলনের পর সারা দেশে সংগঠনের শক্তি বৃদ্ধিতে মনোযোগ দেওয়া হবে বলে মনে করা হচ্ছে। চলতি বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং পরের বছর স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন এখন আওয়ামী লীগের মূল টার্গেট। মাঠ পর্যায়ে এখন আর আলাদা কোনো রাজনীতি নেই বললেই চলে। কেউ স্বীকার করতে না চাইলেও বাস্তবতা এটাই যে, মাঠের বা তৃণমূলের রাজনীতি এখন চৈত্র মাসের শুকনো ডোবার মতো। সবাই যেন কীসের অপেক্ষায়, কোনো বাঁশির সুর বেজে ওঠে কি না সে জন্য কান পেতে আছে।
কেন্দ্রের নির্দেশ ছাড়া কেউ কিছু করে না। আবার কেন্দ্র থেকে নির্দেশ দিলেও অনেক সময় তা কার্যকর হয় না। আওয়ামী লীগ জানে, যতদিন শেখ হাসিনা আছেন ততদিন তাদের কোনো ভাবনা নেই। তাই আওয়ামী লীগ সরকারে থাকায় দল ঢুকে গেছে সরকারে। আওয়ামী লীগের সরকার না হয়ে সরকারের আওয়ামী লীগ হয়েছে। ফলে দলটিকে আর আলাদা করে খুঁজে পাওয়া যায় না। ছোট বড় প্রায় সব নেতাই তদ্বির বা অন্য কোনো ধান্দায় ব্যস্ত। গত কয় বছরে তৃণমূলের অনেকেই বিপুল অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছেন। কে কীভাবে টাকা কামিয়েছেন কান পাতলেই তা শোনা যায়। এ সব শুধুই কি রটনা? অনেকেই মনে করেন, যা রটে তার কিছু না কিছু বটে! ক্যাসিনোকাণ্ডের ফলে দুর্নীতির সামান্য যে চিত্র প্রকাশ পেয়েছে তাতেই তো অনেকের চক্ষু চড়কগাছ!
অনেকেই মনে করেন, জাতীয় পর্যায়ে এবং তৃণমূলে আওয়ামী লীগের এখনকার রাজনীতি হলো আখের গোছানোর। পাওয়া এবং খাওয়ার রাজনীতি। কিন্তু সবাই তো আর খেতে পরতে পারছেন না। তাই তৈরি হচ্ছে দ্বন্দ্ব। পাওয়া গ্রুপ এবং না-পাওয়া গ্রুপের দ্বন্দ্ব এতটাই প্রকট যে কেন্দ্র থেকে হুকুম দিয়েও এটা দূর করা সম্ভব হচ্ছে না। দলের মধ্যে ‘শুদ্ধি’ অভিযানের আওয়াজ দেওয়া হলেও তেমন কোনো পরিবর্তন দৃশ্যমান হচ্ছে না। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান তৃণমূলে পৌঁছানোর আগেই মুখ থুবড়ে পড়েছে।
তৃণমূলে বিএনপির অবস্থা কেমন? বিএনপির অবস্থা এক কথায় কাহিল। তারা আশাহীন, ভাষাহীন। বিএনপির সমর্থকদেরও যেহেতু ভরসার জায়গা খালেদা জিয়া খালেদা জিয়া সেহেতু তাদের মধ্যে হতাশা বেশি। মামলা-হামলা নিয়ে আছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও। বেগম জিয়া দুর্নীতি মামলা সাজা পেয়ে জেলে আছেন। তিনি কবে মুক্তি পাবেন, তা কেউ জানে না। তার অসুস্থতার খবর বড় করে প্রচার এবং আন্দোলনের মাধ্যমে তাকে মুক্ত করার হুংকার দেওয়ার মধ্যেই সীমিত আছে বিএনপির কেন্দ্রীয় রাজনীতি।
তৃণমূল কেন্দ্রকে অনুসরণ করছে। নেতারা কিছু দিন পরপর সরকার পতনের কথা বলে কর্মীদের চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করেন। ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা এখন দেখেন কিনা বলা মুশকিল। তবে তারা সংগঠনকে মজবুত করার জন্য মানুষের কাছে নিজেদের রাজনৈতিক বক্তব্য তুলে ধরার চেয়ে বেশি পছন্দ করেছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের তোয়াজ করতে। কে কাকে ল্যাং মেরে সামনে যেতে পারবে সেই অসুস্থ প্রতিযোগিতা বিএনপিতেও চরমভাবেই চলছে।
বাস্তব অবস্থা এটাই যে, এলাকা এলাকায় দল আছে, আছে দলাদলিও। কেউ বলতে পারেন, এটাই তো রাজনীতি। দল এবং দলাদলি থাকলেই বুঝতে হবে রাজনীতি আছে। হ্যাঁ, এই অর্থে তৃণমূলে রাজনীতি আছে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি আছে সব জায়গায়। জাতীয় পার্টি আর জামায়াত আছে অনেক জায়গায়। আর অন্যসব দল আছে কোনো কোনো জায়গায়। বাম দলগুলোর অবস্থান তৃণমূলে একেবারেই দুর্বল। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি শুধু যে দেশের সব জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন-ওয়ার্ড পর্যায়ে আছে তা নয়, বাড়ি বাড়িতেও আছে। কোথাও কোথাও এটাও দেখা যায় যে এক পরিবারে চার রাজনৈতিক দলের সদস্যও আছেন। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত এবং জাসদ।
জাতীয় ভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে খুব সদ্ভাব না থাকলেও তৃণমূলের চিত্র কিছুটা ভিন্ন। তৃণমূলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে রেষারেষি নেই সেটা বলা যাবে না, তবে এক ধরনের গোপন সমঝোতাও আছে। অথবা বলা যায় আত্মরক্ষার কৌশল রপ্ত করে চলা হচ্ছে। শোনা যায়, এই রকম সমঝোতা আওয়ামী লীগেরও আছে কোথাও কোথাও জামায়াতের সঙ্গে। এই মিলমিশের পেছনে আবার লেনদেনের সম্পর্ক আছে বলেও শোনা যায়। সরকারি দলের লোকেরা দুপয়সা আয়রোজগার করছেন, বিএনপি-জামায়াত তাদের সহযোগিতা করছে। এমনও শোনা যায় যে, এই মর্মে গোপন সমঝোতা হচ্ছে, এখন বিএনপি-জামায়াতকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে পরে দরকার হলে আওয়ামী লীগও যেন সেটা পায়। অর্থাৎ তৃণমূলের রাজনীতিও আর নীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। নীতির রাজনীতি তো দেশ থেকে বিদায় নিয়েছে।
একটা সময় ছিল যখন রাজনীতির গতিমুখ ছিল তৃণমূলে। মানুষের মধ্যে থেকে, মানুষের জন্য কাজ করে তৃণমূলে যারা জনগণের বিশ্বস্ত নেতা হয়ে উঠতেন তারাই ধাপে ধাপে জাতীয় রাজনীতিতে ঠাঁই পেতেন। এখন ধারা বদলে গেছে। এখন নেতা হওয়ার জন্য জনগণের সমর্থনের প্রয়োজন হয় না। এখনকার বেশির ভাগই হাইব্রিড নেতা। উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া। রাজনীতি এখন বিত্তবান হওয়ার উপায়। রাজনীতি পরিণত হয়েছে ব্যবসায়। কম বিনিয়োগে বেশি মুনাফা। জাতীয় রাজনীতির এই ধাক্কা তৃণমূলেও আঘাত হেনেছে। তাই তৃণমূলেও চলছে টাকার খেলা। স্থানীয় পর্যায়ের যেকোনো নির্বাচনেও এখন যে পরিমাণ টাকা ব্যয় করা হয় তা এক কথায় অকল্পনীয়।
তবে তৃণমূলের রাজনীতিতে সবার অলক্ষ্যে একটি পরিবর্তন ঘটছে বলে আমার ব্যক্তিগত ধারণা। গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর নিষ্ক্রিয়তা এবং উদাসীনতার সুযোগে ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষত জামায়াতে ইসলামী তৃণমূলে প্রভাব বিস্তার করছে। জামায়াত বাংলাদেশের সবচেয়ে কৌশলী ও সুচতুর রাজনৈতিক দল। তাদের বেড়ে ওটার ভয়াবহ বিপদ আজ যারা দেখছেন না, তারা খুব শিগগিরই পস্তাবেন। জামায়াতের সঙ্গে আজ যারা কৌশলের খেলা খেলছেন তারা যখন নিজেদের ভুল বুঝতে পারবেন, তখন হয়তো আর সংশোধনের সুযোগ পাওয়া যাবে না। প্রকাশ্যে হৈ চৈ না করে জামায়াত গোপনে তলা গোছাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে জামায়াতের নারী কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে নারীদের মগজ ধোলাই করছে।
তৃণমূলের রাজনীতির ক্ষয়রোগ নিরাময় করতে হলে জাতীয় রাজনীতিতেই আগে পরিবর্তন আনতে হবে। তৃণমূলের ওপর ভর করে জাতীয় রাজনীতি, নাকি জাতীয় রাজনীতির ধারায় তৃণমূলের রাজনীতি– এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা দরকার।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
bibhu54@yahoo.com
এইচআর/জেআইএম