মন খারাপের সময় সন্তানের পাশে থাকুন
বছরের প্রথম দিনের পত্রিকার পাতায় চোখ রাখলেই মন ভালো হয়ে যাবে যে কারও। পত্রিকার পাতায় পাতায় বর্ষবরণের খবর। নতুন বছর নিয়ে নানা প্রত্যাশার কথাও আছে। আছে শিক্ষার্থীদের হাসিমুখের ছবি। আগের বছরের শেষ দিনে একই সাথে ঘোষণা করা হয়েছে পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষার ফল। পরীক্ষার ফল মানেই টেলিভিশনের পর্দায় আর পত্রিকার পাতায় শিক্ষার্থীদের উল্লাসের ছবি। ১ জানুয়ারি আবার ছিল বই উৎসব। বাংলাদেশে অনেক রকমের উৎসব হয়। সবচেয়ে আনন্দের উৎসব বই উৎসব। অনেক বছর ধরেই বছরের প্রথম দিনই বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ করে সরকার। এবারও প্রায় সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থীর জন্য ৩৫ কোটিরও বেশি বই বিতরণ করা হচ্ছে।
নতুন বই হাতে শিশুদের উল্লাস দেখলে আমি বারবার ফিরে যাই নিজের শৈশবে। নতুন বইয়ের ঘ্রাণের যে আনন্দ, তার কোনো তুলনা নেই। বাসায় নিয়ে পুরোনো ক্যালেন্ডার বা উদয়নের পৃষ্ঠা দিয়ে সুন্দর করে ‘টিস’ করে, ভোমর দিয়ে তিন রঙের সুতায় সেলাই করে তারপর নাম, ক্লাস, বিষয়, রোল নাম্বার লিখে রাখতাম। তবে আমাদের সময় যেহেতু বিনামূল্যে বই দেয়ার রেওয়াজ ছিল না। তাই বই কিনতে হতো। তবে সব সময় নতুন বই পেতাম না আমরা। আমরা ছয় ভাই-বোন। বড়জনের বই পরের জন পড়বে, মধ্যবিত্ত পরিবারে এটাই নিয়ম। মাঝে মধ্যে দু-একটা নতুন বই পেলে যেন হাতে চাঁদ পেয়ে যেতাম। তাই বছরের প্রথম দিনই টেলিভিশনের পর্দায় নতুন বই হাতে শিশু-কিশোরদের উচ্ছ্বাসের ছবি দেখলে মন ভালো হয়ে যায়।
পিইসি ও জেএসসির ফলাফল আর নতুন বইয়ের উৎসব সব মিলে বছরের প্রথম দিনটি ছিল সত্যিই উৎসবমুখর। কিন্তু সুখের পাশেই যেমন শুয়ে থাকে দুঃখ। তেমনি উৎসবের আড়ালেই লুকিয়ে ছিল গভীর বিষাদ। পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ছয়জন আত্মহত্যা করেছে। পরীক্ষায় ফেল করার কারণে আত্মহত্যা, বিষয়টি ভাবতেই আমার মন গভীর বেদনায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। সব উচ্ছ্বাস, উৎসব আড়াল হয়ে যায় সেই বিষাদের চাদরে। আমাদের সময়ে প্রখম বড় পরীক্ষা ছিল এসএসসি। কিন্তু এখন সেই পরীক্ষায় বসার আগেই আরো দুটি পরীক্ষা দিতে হয়- পিইসি ও জেএসসি। তবে শুধু পিইসি দিয়েই শুরু নয়। এখন শিশুদের পরীক্ষা শুরু হয় মুখে বোল ফোটার আগেই। আমাদের সময় পাঁচ বছর বয়সে সরকারি প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি দিয়ে শুরু হতো শিশুর শিক্ষাজীবন। এখন ক্লাস ওয়ানে ওঠার আগে প্লে, কেজি, কেজি ওয়ান- মোটামুটি বছর তিনেক যুদ্ধ করে আসতে হয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভালো স্কুলে ভর্তির যুদ্ধে নামতে হয় শিশুদের। তারপর তার বইয়ের ভারী ব্যাগ, ক্লাস টেস্ট, কোচিং, এই পরীক্ষা, সেই পরীক্ষা মিলিয়ে যে কোনো শিশুর কাছে পড়াশোনা মানেই আতঙ্ক।
আমরা শিশুদের শৈশব কেড়ে নিয়েছি অনেক আগেই। এখন শৈশব তো দূরের কথা, দম ফেলার সময় নেই। স্কুল থেকে গাড়িতে বসেই নাকেমুখে কিছু খেয়ে সরাসরি কোচিং, কোচিং থেকে বাসার টিচার, হোমওয়ার্ক- সত্যিকার অর্থেই শিশুটির দম ফেলার সময় নেই। আমরা যারা অভিভাবক, নিশ্চয়ই আমাদের সন্তানদের ভালোবাসি, তাদের ভালো চাই। কিন্তু একটা শিশুর শৈশব চুরি করে, দম ফেলার সময় না দিয়ে তার আসলে কী ভালো চাই আমরা। আমাদের চাপে সে হয়তো অনেক ভালো ফল করলো, অনেক ‘সফল’ হলো। কিন্তু সে যদি বড় হয়ে আপনাকে প্রশ্ন করে, মা আমার খেলার সময় ছিল না কেন, টিভি দেখার সময় ছিল না কেন, বেড়ানোর সময় ছিল না কেন, আমার শৈশব এমন চাপে কাটলো কেন? কী জবাব দেবেন আপনি?
আমাদের সময় এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের হার হতো ৩০ ভাগের আশপাশে। এখন সেটা কখনো কখনো ৯০ এর ঘর ছুঁয়ে যায়। তারপরও তো ১০ ভাগ শিক্ষার্থীকে ফেল করতে হয়। যেমন- এবার পিইসি পরীক্ষা দিয়েছিল ২৪ লাখ ৫৪ হাজার ১৫১। পাস করেছে ২৩ লাখ ৪৩ হাজার ৭৪৩। তার মানে ফেল করেছে এক লাখ ১০ হাজার ৪০৮। জেএসসিতেও ফেল করেছে ২ লাখ ৭৫ হাজার ৮৭৩। তবে এখন অনেক অভিভাবকের কাছে জিপিএ-৫ এর নিচে পাওয়া মানেই যেন ফেল। জিপিএ-৫ এর নিচে পেলে লজ্জায় মুখ দেখানো যায় না। ফেসবুকেও জানান দেয় না কেউ। পৃথিবীতে কোনো পরীক্ষায় সবাই পাস করে না। সবার প্রথম হওয়ার সুযোগই নেই। যারা ফেল করে বা খারাপ রেজাল্ট করে, পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর তাদের মন খারাপ থাকে। কিন্তু শিশুদের যে মন থাকতে পারে, সেই মনও যে খারাপ হতে পারে; আমরা অভিভাবকরা বুঝতেই চাই না।
মন খারাপের সময় যখন আমাদের উচিত সন্তানের পাশে দাঁড়ানোর, তখন আমরা সব আক্রোশ নিয়ে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। অমুক পারলে, তুই পারলি না কেন? এই তুলনায়, এই প্রশ্নে, এই অপমানে, এই লজ্জায়, এই গ্লানিতে অনেকে আত্মহত্যা করে। এবার যেমন ছয়জন করেছে। যাদের আত্মহত্যা করার মতো সাহস নেই, তাদের জীবন আমরা বিষিয়ে তুলি, বেঁচে থাকার আনন্দটা কেড়ে নেই। অনেকে এমনও বলে, তোর মুখ দেখতে চাই না, তুই মরতে পারিস না। এই ছোট কথা যে সেই শিশু মনে কত বড় প্রভাব ফেলে, আমরা চিন্তাই করি না। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, আমরা এই শিশুদের বন্ধু না শত্রু। এই যে শিশুরা ফেল করছে, এটা নিশ্চয়ই শিক্ষকদের ব্যর্থতা। তারা ভালো মতো পড়াতে পারেননি। অভিভাবকদের ব্যর্থতা। তারা ভালো খোঁজ রাখেননি। নিজেদের ব্যর্থতার দায় আমরা কেন শিশুদের ওপর চাপিয়ে দেই।
আমরা সারাক্ষণ সাফল্যের চিন্তায় মগ্ন। পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে হবে, সবার চেয়ে ভালো করতে হবে, বড় চাকরি পেতে হবে; ব্যস তুমি সফল। বাবা-মার মুখ উজ্জ্বল করেছ। আমরা বুঝতেই চাই না, সব শিশুর তো পড়াশোনা ভালো নাও লাগতে পারে। কেউ হয়তো গানে ভালো, কেউ হয়তো খেলায়, কেউ হয়তো ভালো ছবি আঁকবে। কারো হয়তো রোদ্দুর হতে মন চাইবে, কেউ হতে চাইবে পাখির মতো বন্য, কেউ ঘুড়ি হতে চাইবে, কেউ আকাশ। আমরা তো জানি না, জানতেই চাই না; কার কী ভালো লাগছে। আমরা নিজেদের জীবনের ব্যর্থতা, অপ্রাপ্তি সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেই। সবাই তো মেধাবী নাও হতে পারে। সবাই বড় চাকরিতেই জীবনের মানে খুঁজবে, এসব তো নাও হতে পারে। কেউ তো বড় হয়ে সন্যাসী হতেও চাইতে পারে।
কেউ বা সাকিব আল হাসান। আমি বলছি না, পড়াশোনাটা কম গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান অর্জন এবং সেই জ্ঞান মানবের কাজে লাগানো। মুশফিকুর রহীম কিন্তু ক্রিকেট খেলার পাশাপাশি পড়াশোনা করেছে এবং ভালো রেজাল্টও করেছে। সন্তানের ভালো রেজাল্টের জন্য বাবা-মা চেষ্টা করবে। সন্তানের পড়াশোনার খোঁজ রাখবে। সন্তানও ভালো করার চেষ্টা করবে। কিন্তু সেই চাওয়াটা যেন পারস্পরিক হয়। সন্তানের বিপদের সময় যেন বাবা-মাই তার পাশে থাকে। আমরা যেন সাফল্যকে নিজেদের মতো বিচার করে, সন্তানকে অনন্ত রেসে নামিয়ে না দেই। তাকে যেন মৃত্যুর দিকে ঠেলে না দেই। যেন তার বেঁচে থাকাটা, তার শৈশবটা নিরানন্দ করে না তুলি।
এই আমরা বলি, ফেইলিউর ইজ দ্য পিলার অব সাকসেস, ব্যর্থতাই সাফল্যের স্তম্ভ। এই ট্রান্সলেশন শিখে শিখে অনেকে জিপিএ-৫ পায়। ব্যর্থতাই যদি সাফল্যের স্তম্ভ হবে, তাহলে ব্যর্থদের আমরা মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছি কেন। পিইসি বা জেএসসি পরীক্ষায় ফেল করা মানেই জীবন শেষ নয়। আবারও পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ থাকছে, পাস করার সুযোগ থাকছে। জীবনটা আসলে অনেক বড় এবং সবচেয়ে মূল্যবান। পরীক্ষায় ফেল করার মতো তুচ্ছ কারণে যেন আমাদের সন্তানরা সেই জীবন দিয়ে না দেয়। পিইসি এবং জেএসসি পরীক্ষায় যারা পাস করেছে, তাদের অভিনন্দন। যারা ফেল করেছে, আমরা যেন পাশে দাঁড়াই। ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় যেন তাকে সহায়তা করি।
এইচআর/পিআর