মেয়র প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতা
আবারও ঢাকা সিটিতে নির্বাচন, আবারও দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র নৌকা ধানের শীষের লড়াই। এ মাসের ৩০ তারিখ ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে এই শহরের নাগরিকরা দুজন মেয়র নির্বাচন করবেন। যদিও দুই অঞ্চলে অনেক কাউন্সিলর আসবেন, যারা ওয়ার্ড পর্যায়ে মানুষের সবচেয়ে কাছে অবস্থান করেন। তবুও বেশি আলোচনা দুই মেয়রকে নিয়ে।
দুই দলের মেয়র প্রার্থীরাই নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলেছেন। সবাই বলছেন তারা ঢাকাকে বাসযোগ্য করে গড়ে তুলবেন। মশক নিধন করা, নগরকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, পরিবেশ সমস্যার সমাধান করা, যানজট নিরসন করার মত প্রতিশ্রুতি আসছে। প্রশ্ন হল মশক নিধন আর আবর্জনা পরিষ্কার ছাড়া অন্য কাজ কি সিটি মেয়র করতে পারবেন?
ঢাকা সিটি কর্পোরেশন হল কেন্দ্রীয় পর্যায়ে অবস্থান করা সবচেয়ে বড় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান। যারা মেয়র হয়ে আসেন তারা আর্থ-সামাজিক পর্যায়ের প্রভাবশালী মানুষ। কিন্তু তবুও এই নগরীর মানুষ যেন প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। কারণ তারা পরিষ্কার দেখতে পান তারা বাস করছেন বাসযোগ্যতার বিচারে সারা বিশ্বে নিচের দিকে থাকা একটি মহানগরীতে। যানজটে নাকাল প্রতি নিয়ত, উন্নয়ন কাজের বেদনায় এখন বায়ু বিষের সংক্রমণে জীবন যায় যায়, মশা আর মশাবাহি রোগে জরুরি পরিস্থিতি আর সারা শহর আবর্জনা আর ময়লার চাদরে ঢাকা।
মশা আর আবর্জনা পরিষ্কার দুই সিটি কর্পোরেশন নিজে করতে পারলেও, মেয়ররা অসহায় অন্যসব সেবা প্রদানে। প্রতিটি কাজে তাদের চেয়ে থাকতে হয় কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান সমূহের ওপর। জলাবদ্ধতা মোকাবেলায় ঢাকা ওয়াসা, যানজটের বেলায় মেট্রোপলিটান পুলিশ, বিদ্যুতের বেলায় বিদ্যুৎ বিভাগ। নিরাপদ সড়কের জন্য মালিক শ্রমিক ভয়ংকর ঐক্য কখনও ভেদ করা সম্ভব নয় মেয়রদের পক্ষে।
তাহলে তারা এত প্রতিশ্রুতি দেন কেন যে সমস্যার সমাধান তাদের হাতে নেই? এই যে নগর জুড়ে এত উন্নয়ন আর মেরামতের কাজ লেগেই থাকে সারা বছর, সেখানে কি এই শহরের নাগরিকদের কোন অংশগ্রহণ কখনও ছিল বা আছে? উন্নয়ন কাজের বিষয়ে সহমত থাকতে হবে নাগরিকদেরও, উন্নয়নের কাজে নাগরিকদের সরাসরি যোগদান থাকা উচিত– এমন একটি কথা কি কোন মেয়র কখনও বলতে পেরেছেন?
ঠিক এ জায়গাটিতেই সিটি কর্পোরেশনের কার্যকারিতা। নগরের মানুষ কর প্রদান করে সেবা পাওয়ার আশায়। অথচ তারা উপেক্ষিত, তারা অবহেলিত। সমস্যাটা কর্পোরেশনের কাঠামোতেই। দেশ পরিচালিত হচ্ছে সংসদীয় পদ্ধতিতে, অথচ স্থানীয় সরকারগুলোর কাঠামো রাষ্ট্রপতি শাসন পদ্ধতির মত।
এখানে দলীয় প্রতীক নিয়ে মেয়র নির্বাচিত হচ্ছেন এবং তিনিই সব। যদি আগে কাউন্সিলররা নির্বাচিত হতেন, তারা মেয়র নির্বাচন করতেন, তাহলে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা বা ইউনিয়ন পরিষদ পরিচালনা হতো সংসদীয় পদ্ধতিতে। কাউন্সিলর পদে ভাল মানুষেরা নির্বাচন করতে আগ্রহী হতেন। কাউন্সিলররা হয়ে উঠতেন জনগণের আসল প্রতিনিধি।
আমাদের ঢাকাকে আমরা মেগাসিটি বলি। এটি আমাদের রাজধানী। রাজধানী মানেই হলে একটি দেশের মুখচ্ছবি। অথচ কি দশা এই শহরটার! দুই একটি এলাকা বাদ দিলে পুরো শহরের রাস্তাঘাটের অবস্থা শোচনীয় বললে প্রায় কিছুই বলা হয় না।
শহরের সর্বত্রই এমন বেশ কিছু জনস্থান আছে, যেগুলোকে কখনও হয়তো রাস্তা বলা যেত, এখন স্বচ্ছন্দে খানা-খন্দ, ডোবা বা খাল আখ্যা দেওয়া যায়। কোনও সভ্য দেশেই এ সবের উপর দিয়ে কোনও যানবাহন চলাচল করে না।
সভ্য দেশ হলে, খানা খন্দকে ভরা রাস্তায় যাতায়াতের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত গাড়িকে এবং অবশ্যই জনসাধারণকেও সিটি কর্পোরেশন বা সরকার ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হত। এখানে সরকারি বা কর্পোরেশনের সেবার নিম্নমানের কারণে নাগরিকদের ক্ষতি হবে ধরে নিয়েই নাগরিক নিজে নামেন এবং তার গাড়ি পথে নামান।
এ শহরের অবস্থা এখন বর্ষাকালে এমন হয় যে, বৃষ্টি হওয়া লাগেনা, মেঘ দেখলেই ভেসে যায়। প্রতি বর্ষায় শহর ও শহরতলির পথঘাট যান-চলাচলের অযোগ্য হয়ে ওঠে, ভবিষ্যতেও উঠবে এবং আমাদের মেয়র সাহেবরা নানা কথা বলে দায়িত্ব এড়িয়ে চলে যাবেন।
পথ ঘাটের বেহাল দশার ভেতর জনগণ ঠিকাদার এবং পূর্ত বিভাগ ও কর্পোরেশর ইঞ্জিনিয়ার ও অন্যান্য প্রতিনিধিদের কায়েমি স্বার্থের খেলা দেখতে পান। জনসাধারণ কেবল দেখেন, প্রতি বছর নিয়ম করে বর্ষার আগেই রাস্তা ভাঙে, বর্ষার পর সারাইয়ের সরকারি প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, বর্ষায় পথঘাট চলাফেরার অনুপযুক্ত থাকে, বর্ষার পরেও এমন খামখেয়ালী ভাবে মেরামতির কাজ হয় যাতে অচিরেই আবার পথের ত্বক নষ্ট হয়ে যায়, পথের ক্ষত দাঁত বের করে ভেংচি কাটে।
প্রায় সব সড়কের এক কাহিনী। একটি সংস্থা কাজ শেষ করে, রাস্তায় পট্টি দেওয়া হয়, আরেক সংস্থা কয়দিন পর আবার রাস্তা কাটতে শুরু করে। নিরন্তর চলে এমন ভাঙা আর গড়া। এমন যন্ত্রণা থেকে জনগণকে মুক্ত করতে কর্পোরেশন তার কোন অস্তিত্বই জানান দিতে পারে না কখনও।
ফুটপাত থেকে হকার সরাতে পারেনা, রিকশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা, পারেনা শহর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে। কর্পোরেশন পারেনা নগরীতে সুস্থ চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থা করতে। ক্রমেই ইট পাথর আর অনিয়মের জঙ্গল হয়ে উঠা শহরে মেয়রদের কি করণীয় তারা নিজেরাই একটু ভাবুন, তারপর প্রতিশ্রুতি দিন।
সুস্থ সৃজনশীল শান্তিময় জীবনের আশ্বাস তখনই কার্যকর হবে যখন কেন্দ্র বাস করা এই প্রান্তিক নাগরিকদের মধ্যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক মূলধনের ইতিবাচক সম্প্রসারণ হবে, দুর্ভোগগুলো থেকে তারা যত দূর সম্ভব মুক্ত হবেন।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
এইচআর/এমএস