জামায়াতের ড্যামকেয়ার বৈজ্ঞানিক যাত্রা
বিরতিহীন নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার ফাঁকে মজেই আছে জামায়াতে ইসলামী। তা বিজয়ের ডিসেম্বরে আরও বেশি। যে সময়টা সচরাচর রাজনৈতিকভাবে চরম কোণঠাসা থাকে দলটি। মাসটিতে একাত্তর-স্বাধীনতা যুদ্ধ প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠার পাশাপাশি জামায়াতকে হজম করতে হয় বেশুমার গালমন্দ। এছাড়া এ মাসটিতে জামায়াত নিষিদ্ধ নিয়ে কিছু উদ্যোগ-ভাবনার খবরাদিও থাকে গণমাধ্যমে।
কৌশল হিসেবে এ মাসটাতে জামায়াত নেতাকর্মীরা থাকেন গা ঢাকায়। নইলে ডুব দেয়ার মতো শীতের ওয়াজ-মাহফিলে মুসল্লি হয়ে। এবারের মৌসুমটিতে তাদের সেই রকমের কিছু করতে হয়নি। রাজাকার তালিকা, মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের উৎপাতে জামায়াত এবার অপ্রাসঙ্গিক থেকে গেছে। প্রাসঙ্গিক হয়েছে রাজাকারের বিতর্কিত তালিকা এবং জাতির জন্য আপদ হয়ে ওঠা ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ’ নামের অর্বাচীন সংগঠনটির সন্ত্রাস-নৈরাজ্য। গোটা আবহটা একদিকে মুক্তিযুদ্ধকে অপমান করেছে, আরেকদিকে জামায়াতকে দিয়েছে তৃপ্তি। মৌসুম ও সুযোগটা ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছে দলটি। জামায়াতে থাকা একসময়ের জাসদের দুই নেতাকে আমির ও সেক্রেটারি জেনারেল বানিয়েছে নানান হিসাব কষে। ৫ ডিসেম্বর নতুন আমির হিসেবে শপথ নেন ডা. শফিকুর রহমান। আর ২৬ ডিসেম্বর তার কাছে শপথ নেন নতুন সেক্রেটারি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার।
জামায়াত রাজনীতির মাঠ ও হাল পরিস্থিতি বুঝেই তাদের নিয়ে এসেছে দলের মূল নেতৃত্বে। সেইসঙ্গে প্রচার করছে তাদের একসময়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমে নামা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদ ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত থাকার তথ্য। নয়া আমির ডা. শফিক ছাত্রাবস্থায় জাসদ ছাত্রলীগ করতেন। ১৯৭৩-৭৫ সালে সিলেটে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমে একনিষ্ট ভূমিকা ছিল তার। ইসলামী ছাত্রশিবিরে যোগ দেন ১৯৭৭ সালে। সিলেট মেডিকেলে পড়ার সময় প্রথমে মেডিকেলের শিবিরের সভাপতি ও পরে সিলেট শাখার সভাপতি হন। জামায়াতে যুক্ত হন ১৯৮৪ সালে। পরে ধাপে ধাপে উঠে আসেন শীর্ষ পদে।
মিয়া গোলাম পরওয়ারও একসময় জাসদ করতেন। চুয়াত্তর-পঁচাত্তরে জাসদের রাজনীতি করতেন জন্ম জেলা খুলনায়। ১৯৭৭ সালে ভেড়েন ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই। ছাত্রজীবন শেষে জামায়াত। ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনা-৫ আসনে সংসদ সদস্য হন। একই আসনে ১৯৯১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে পরাজিত হন। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ২০-দলীয় জোট থেকে একই আসনে প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হন। কিন্তু নির্বাচনের দিন তিনি নির্বাচন বর্জন করেন। রাজনীতির পাশাপাশি সম্পৃক্ত ছিলেন সাংবাদিকতা ও অধ্যাপনায়।
নতুন বৈজ্ঞানিক নেতৃত্বের পাশাপাশি জামায়াতের অভ্যন্তরে নারী নেতৃত্বের বিষয়েও কিছু সংস্কার এসেছে। দলের নারী ভোটার কাছে নতুন আমির আগে থেকেই বেশ জনপ্রিয়। মজলিশে শুরার নারী সদস্যরা আগে শুধু আমির নির্বাচনে ভোট দিতেন। তিন সদস্যের আমির প্যানেল নির্বাচনে তাদের ভোটাধিকার ছিল না। এবার নারী সদস্যদের এই ভোটাধিকার দেয়া হয়েছে।
এখন পর্যন্ত সুদিন ফেরার আশায় জামায়াতের সাম্প্রতিক তৎপরতার কারণ অজ্ঞাত। তবে সাদা চোখে স্পষ্ট মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলীয় সরকারের হাতে এবারের বিজয়ের মাসে ঘোষিত রাজাকারের বিতর্কিত তালিকা প্রকাশ এবং বাতিল দুটাতেই রাজনৈতিকভাবে অন্য মাত্রায় বেনিফিসিয়ারি জামায়াতে ইসলামী। রাজাকারের তালিকায় সমানে মুক্তিযোদ্ধার নামভুক্তির আগে দফায় দফায় মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় ঢুকেছে বহু মুক্তিযোদ্ধার নাম। এগুলোর সবই জামায়াতের জন্য স্বস্তি-আনন্দের। ভবিষ্যতের জন্য আশা জাগানিয়া। রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধা একাকার হয়ে যাওয়া, এ নিয়ে জম্পেশ বিতর্ক জামায়াতকে সামনের দিনগুলোর জন্য আলো দেখাচ্ছে। আলোচনা থাকলেও সরকার কেন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করছে না? নিষিদ্ধ হওয়ার মতো শঙ্কা কেন জামায়াতও করছে না- এটি মোটা দাগের প্রশ্ন হয়েই থাকছে।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/বিএ/এমএস