থার্টি ফার্স্ট নাইটে মদ খেতেই হবে কেন?
মদ খাওয়ার প্রতি আমার অসমর্থন অনেককেই বিস্মিত করে। আশ্চর্য হয় অনেকেই। তোমার মতো স্মার্ট, আধুনিক একটা ছেলে মদ খাবে না, খেতে চাও না, তা কী করে হয়- এমন মন্তব্য শুনে শুনে আমি রীতিমতো অস্থির। সত্যি, কারও কারও নাক ডুবিয়ে মদ খাওয়া আমাকে রীতিমতো অস্থির করে তোলে। আমার মদ খেতে না চাওয়া অনেকের কাছে বিস্ময়করই বটে।
বুঝতে পারি না তাদের কথা। তাদের কথা আমার কাছে কোনো অনুবাদ তৈরি করে না। বরং নিজেই বিস্মিত হই। অবাক লাগে। এত এত লোক মদ খাওয়ার জন্য কেন অহেতুক নানান অজুহাত খোঁজে। মদ খাওয়ার সঙ্গে স্মার্টনেসের, আধুনিকতার কী সম্পর্ক থাকতে পারে? আগেও বলেছি, মদ খাওয়া কোনো মডার্নিটি নয়, স্টুপিডিটি মাত্র। আমার তা-ই মনে হয়, তা-ই মনে হয়েছে সবসময়। মদ খেয়ে তাবৎ ক্ষমতাবান লোক, জ্ঞানী-গুণী লোক, মেধাবী লোক, অক্ষম, অপদার্থ, নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকে। নেশায় বুঁদ হয়, ঝিমায়। জ্ঞানী মানুষটিও আর জ্ঞানী থাকে না। মেধাবী লোকটিও হয়ে পড়ে অমেধাবী। কেননা খেতে খেতে একসময় মদ তাকে খায়, সে আর নিজের থাকে না। নিজের থাকাটা নিজের কাছে সবসময়ই খুব জরুরি।
প্রতি বছর থার্টি ফার্স্ট নাইট, লোকে উপলক্ষ খোঁজে মদ খাবে, কোথায় গিয়ে, কীভাবে? মদ যেন খেতেই হবে। খেতে হবেই। না খেলে দিনটি আর দিন থাকে না। রাতটি আর রাত থাকে না। ৩১ ডিসেম্বর অর্থহীন হয়ে পড়ে। বর্ষবিদায় কিংবা বর্ষবরণ বড্ড ম্লান, ম্যাড়ম্যাড়ে, পানসে, নিষ্প্রাণ মনে হয়। দিনটিকে জাগিয়ে তুলতে, জেগে উঠতে মদ প্রয়োজন হয়। লোকের খুব ভুল ধারণা। মদ তো বরং জেগে থাকা মানুষকেই ঝিমিয়ে দেয়, নেতিয়ে পড়ে। মদ খেয়ে তাহলে থার্টি ফার্স্ট উদযাপন কেন করতে হবে? আমি যদি উদযাপনের আনন্দে জেগে না উঠি, জ্বলে না উঠি তবে সে আনন্দ মিছে।
আজকাল শুধু ছেলে নয়, মেয়েরাও দিব্যি মদ খাচ্ছে। ক্লাবে, বারে, ডিসকোতে পার্টিতে যাচ্ছে- মদ খাবে বলে। ডিজে পার্টি থেকে মদ খেয়ে রাত করে ভিজে বাড়ি ফিরছে। ফ্যাশন এবং প্যাশন মেয়েদের কাছে এখন দুটোই। কেউ কেউ বলবেন, কেমন নারীবাদী তুমি? মেয়েরা পার্টিতে যাবে না? মদ ছুঁবে না? বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে হ্যাংআউট, হ্যাংওভার হলে তোমার তাতে আপত্তি কী? নাকি ঈর্ষা করো? হিংসা হয়? এমন প্রশ্নও আমি অনেক শুনেছি। আসলে পুরুষরা করছে বলে মেয়েরা করতে পারবে না বিষয়টি তা নয়। এটা নারী-পুরুষের কোনো বিষয় নয়। ভালো সবার জন্যই ভালো, মন্দ সবার জন্যই মন্দ। আমি নারী-পুরুষকে আলাদা করে দেখিনি কখনোই। দেখি না এখনও। পুরুষের মদ খাওয়া, মদ্যপ হওয়া যেমন অপছন্দের, তেমনি নারীদের মদ্যপ হওয়া, মদ খাওয়াও পছন্দের নয়। বরং মনে করি অমদ্যপ হলে নারী এবং পুরুষ নিজেদের সঙ্গ উপভোগ করতে পারে বেশি।
কেউ কেউ মদ খাওয়ার ছুতো খুঁজতে পশ্চিমের উদাহরণ টানে। বলে, আরে ভাই বিদেশে মদ, মেয়ে মানুষ সব ফ্রি। তাদেরকে বলব, পুব-পশ্চিম কোনোদিক সম্পর্কেই ধারণা নেই তাদের। যা বলে, তা নেহাৎ মনগড়া, মিথ্যা কথা। একেবারেই বানোয়াট। ফ্রি সেক্স আর ফ্রিডম অব সেক্স দুটোকে এক করে ফেললে মুশকিল। আর মদ খেয়ে মাতাল হওয়া পশ্চিমেও বিবেচিত অসভ্যতা হিসেবেই। মনে রাখতে হবে, ‘ড্রাঙ্ক’ গালিটি কিন্তু বাংলা নয় ইংরেজি। খোদ আমেরিকাতেই ২১ বছরের নিচে কেউ বারে যাওয়ার অনুমতি পায় না। থার্টি ফার্স্ট নাইট উপলক্ষে গত ক’দিন ধরেই আমেরিকার টেলিভিশন, অনলাইন, খবরের কাগজে প্রচারিত হচ্ছে- মদ খেয়ে নিজে ড্রাইভ করবেন না, ট্যাক্সিতে বাড়ি ফিরুন। অথচ এখানে অনেকে মদ খেয়ে, মাতাল হয়ে গাড়ি চালানোকে মনে করে স্মার্টনেস। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, ঢাকার বারগুলোতে এখন কেবল কলেজগামীই নয়, স্কুলগামী ছেলেমেয়েদেরও দেখা মেলে।
আসলে উন্নতি আর অগ্রগতি দুটোর সূচক ভিন্ন। একটি উপরের দিকে, অপরটি সম্মুখে। আমাদের ভবন উঠছে, স্থাপনা বাড়ছে। কিন্তু বাড়ছে না চিন্তার অগ্রসরতা। আমরা পড়ে আছি বন্দি তিমিরে। যে সমাজের সুশীলরা, তথাকথিত প্রগতিশীলরা মদ খাওয়াকে আধুনিকতা মনে করে, সে সমাজ আসলে অনাধুনিক, অনগ্রসর। কেবল স্যুট-কোট পরলে, স্লিভলেস পরলে, ক্লাবে বারে ডিসকোতে গিয়ে আধাল্যাংটা হলে, ক্যাসিনোতে টাকা ছড়ালে, দামি গ্যাজেট ব্যবহার করলে লোকে আধুনিক হয় না। আধুনিকতা থাকে মানুষের চিন্তায়, মেধায়, মননে, মানবিকতায়। বিজ্ঞান মনস্কতায়, ধর্মান্ধতাহীনতায়।
আসুন হিসাব কষি এল বছর, আর গেল বছরের। মদ নয়, থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন করি জীবনকে ভালোবেসে। জীবনের সুধা পান করি নারী পুরুষ নির্বিশেষে।
লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।
এইচআর/বিএ/জেআইএম