প্রকৃতিতে শীত, রাজনীতিতে নির্বাচনী উষ্ণতা
গোটা দেশ এখন শীতে কাবু, জবুথবু। মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বইছে দেশজুড়ে। তবে উত্তরাঞ্চলের অবস্থা সত্যি খারাপ। ঢাকায় এবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৩ ডিগ্রি, আর পঞ্চগড়ে নেমেছে ৪ দশমিক ৫ ডিগ্রি পর্যন্ত। এবার আপনার শীতের সঙ্গে পঞ্চগড়ের মানুষের তুলনা করুন। আপনারা আরামদায়ক পরিবেশে, লেপ-কম্বল-কম্ফোর্টারের ওমে আছেন। আর দিনাজপুর-পঞ্চগড়-রংপুরের মানুষদের প্রতিদিন শীতের সঙ্গে লড়াই করতে হয়; বেঁচে থাকার লড়াই, টিকে থাকার লড়াই। ঢাকায় যাদের খোলা আকাশের নিচে থাকতে হয়, তাদের কথাও ভাবুন। প্লিজ, আপনি আপনার সামর্থ্যমতো পাশের মানুষটির পাশে দাঁড়ান। একটু উষ্ণতা ভাগাভাগি করে নিন।
প্রকৃতিতে যখন শীতের দাপট, রাজনীতিতে তখন হঠাৎ নির্বাচনী উষ্ণতা। আমি ‘উষ্ণতা’ শব্দটি ইচ্ছা করেই ব্যবহার করেছি; এখনও রাজনীতির মাঠে উত্তাপ ছড়ায়নি। তবে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন আমাদের অনেকদিন ব্যস্ত রাখবে সন্দেহ নেই। বিশেষ করে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দেয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহ তৈরি হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি তার মূল প্রার্থী বদলায়নি। গত মূল নির্বাচনে যিনি দুপুরের মধ্যেই রণেভঙ্গ দিয়ে আনিসুল হকের জয় সহজ করে দিয়েছিলেন, সেই তাবিথ আউয়ালই বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন। গত নির্বাচনেই তিনি তার সম্ভাবনার জানান দিয়েছিলেন। শিক্ষিত, ভদ্র, বিনয়ী তাবিথকে অনেকেই পছন্দ করেছিলেন। দুপুরের মধ্যে রণেভঙ্গ না দিলে একটা ভালো লড়াই হয়তো দেখা যেত।
আসলে মেয়র হতে চেয়েছিলেন তাবিথ আউয়ালের পিতা আব্দুল আউয়াল মিন্টু। এ নিয়ে তার ব্যাপক প্রস্তুতিও ছিল। কিন্তু মনোনয়ন প্রশ্নে মনোমালিন্যে আওয়ামী লীগ ছেড়ে বিএনপিতে যোগ দিয়েও মেয়র হওয়ার স্বপ্নপূরণ হয়নি মিন্টুর। এখন সন্তানকে দিয়ে অপূর্ণ স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন। তাবিথ প্রার্থী হিসেবে ভালো। কিন্তু সমস্যা হলো মৌসুমী প্রার্থী। গত নির্বাচনে রণেভঙ্গ দেয়ার পর আর তাকে কোথাও দেখা যায়নি। গত নির্বাচনে তিনি এমন অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, যেগুলো নির্বাচিত না হলেও জনগণের পাশে থেকে বাস্তবায়ন সম্ভব ছিল। তাছাড়া যিনি সুখে-দুঃখে জনগণের পাশে থাকেন তিনিই তো আসল নেতা। কিন্তু দুই নির্বাচনের মাঝে তাবিথকে আর পায়নি মানুষ। যেন নির্বাচিত হওয়াটাই একমাত্র মোক্ষ। এটা অবশ্য শুধু তাবিথ নয়, বাংলাদেশের অধিকাংশ নেতার ক্ষেত্রেই সত্যি। শুধু নির্বাচনের সময়টাতেই তারা জনগণের কাছে যান এবং পরে ভুলে যান। ক্লিন ইমেজের তাবিথ নিশ্চয়ই আতিকের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারবেন। তবে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও বর্তমান মেয়র আতিকুল ইসলামের সুবিধাটা হলো, উপনির্বাচনে জিতে মাত্র নয় মাস মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। একজন মেয়রের সাফল্য-ব্যর্থতা মাপার জন্য এ বড্ড কম সময়। তাই হানিমুন পিরিয়ডের সুবিধাটা পাবেন তিনি।
দক্ষিণের হিসাবটা উত্তরের মতো সহজ নয়। দুজনই নতুন প্রার্থী। গত নির্বাচনে দক্ষিণে বিএনপি প্রার্থী ছিলেন সাবেক মেয়র মির্জা আব্বাস। কারাবন্দি মির্জা আব্বাসের পক্ষে মাঠে ছিলেন তার স্ত্রী আফরোজা আব্বাস। তবে জয় পেয়েছিলেন ঢাকার সাবেক মেয়র হানিফের ছেলে সাঈদ খোকন। এবার চোখের জলে বিদায় নিতে হয়েছে তাকে। দলের মনোনয়ন পাননি তিনি। মনোনয়ন পেয়েছেন শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই শেখ ফজলুল হক মনির ছেলে শেখ ফজলে নূর তাপস। ধানমন্ডি এলাকার সংসদ সদস্য তাপসের ইমেজ পরিচ্ছন্ন। সাঈদ খোকন একেবারে ব্যর্থ, তেমনটি বলা যাবে না। তিনি অনেক কাজ করেছেন। কিন্তু এডিস মশা আর নিজের বেফাঁস কথাবার্তার কাছেই হেরে গেলেন সাঈদ খোকন। তাছাড়া দুর্নীতির অভিযোগও ছিল তার বিরুদ্ধে। ফজলে নূর তাপসকে আসলে লড়তে হবে ইমোশনের সঙ্গে।
দক্ষিণে বিএনপি প্রার্থী সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইশরাক হোসেন। তার পিতা সাদেক হোসেন একজন অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। কিন্তু দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে তিনি পালিয়ে ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় তার পাসপোর্ট বাতিল হয়ে যায়। ক্যান্সারে ভুগে সেখানেই মারা যান। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে পাসপোর্টবিহীন অবস্থায় ভিনদেশে মরতে হয়েছে, এ বড় বেদনার। এই আবেগটাই কাজে লাগাতে চাইবেন ইশরাক।
জনতার ভারে ন্যুব্জ একটি শহরে মেয়র হিসেবে সফল হওয়া খুব কঠিন। পা ঢাকতে গেলে মাথা খালি হয়ে যায়, মাথা ঢাকতে গেলে পা। আপনি জলাবদ্ধতা দূর করলে মশা কামড়াবে, মশা মারতে গেলে ফুটপাত দখল হবে। তবে কাজটা যে অসম্ভব নয়, তা দেখিয়ে দিয়ে গেছেন আনিসুল হক। মাত্র তিন বছরে তিনি আমাদের প্রত্যাশার মাত্রা এমন আকাশে তুলেছেন, অন্য কোনো মেয়রের পক্ষেই সফল হওয়া কঠিন শুধু নয় প্রায় অসম্ভব।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনও এখন দলীয় প্রতীকে হয়। তাই ব্যক্তির সাফল্য-ব্যর্থতার চেয়ে দলের হিসাব-নিকাশ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেউ কেউ ভাবতে পারেন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, এখন বিএনপি প্রার্থীকে জেতালেও কাজ করতে পারবে না। আবার ১১ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের ব্যাপারে মানুষের পুষে রাখা ক্ষোভ ভোট হয়ে ঢুকতে পারে ধানের শীষের বাক্সে। তবে বিএনপি রাজনৈতিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। জিতলে তো কথাই নেই; বলবে, প্রমাণিত হলো জনগণ বিএনপির সঙ্গে আছে। আর হারলে তো সেই ভাঙা রেকর্ড, আবারও প্রমাণিত হলো, এই সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
তবে এত হিসাব-নিকাশ, জনগণের চাওয়া-পাওয়া সবকিছু নির্ভর করছে নির্বাচন কেমন হবে তার ওপর। বহুল সমালোচিত, নিন্দিত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের বর্ষপূর্তির প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে একটি ভালো নির্বাচনের প্রত্যাশা করতে একটু ভয়ই লাগে। ৩০ ডিসেম্বরের মতো নির্বাচন হলে তাপস আর আতিককে আগাম অভিনন্দন জানিয়েই রাখা যায়। তবে আমার ধারণা ভিন্ন, ঢাকার দুই সিটির জয়-পরাজয়ে সরকার বদল হবে না। তাই সরকার চাইলে নিজেদের মাঠের সত্যিকারের অবস্থা যাচাই করার জন্য হলেও সরকার একটা সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা দিতে পারে। ওবায়দুল কাদের তেমন আশ্বাস দিয়েছেন। আমি তার আশ্বাসে বিশ্বাস রাখতে চাই। এছাড়া অবশ্য আমাদের কিছু করার নেই। ওবায়দুল কাদেরের আশ্বাস যদি সত্যি হয়, তাহলে ৩০ জানুয়ারি আমরা একটা জমজমাট ভোটের লড়াই প্রত্যাশা করতে পারি।
এইচআর/বিএ/পিআর