আওয়ামী লীগের সম্মেলন : যেই লাউ সেই কদু
আওয়ামী লীগের কাউন্সিল মানেই সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে স্পেকুলেশন, প্রশ্ন, জিজ্ঞাসা, কৌতূহল। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর এ পর্যন্ত নয়টি কাউন্সিল হয়েছে। সভাপতির পদ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। শেখ হাসিনা যতদিন বেঁচে থাকবেন, তিনি যতই বিদায়ের কথা বলুন, কেউ শুনবে না। আওয়ামী লীগ মানেই শেখ হাসিনা। শুধু দল নয়, দেশ পরিচালনায়ও শেখ হাসিনা নিজেকে অপরিহার্য করে তুলেছেন। তাই আওয়ামী লীগের কাউন্সিল এলেই সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে সাধারণে কৌতূহল আর দলে ব্যাপক তদ্বির চলে। অন্যান্য পদ নিয়েও দলের ভেতরে ব্যাপক কানাঘুষা, আলোচনা হয়। কিন্তু পুরো আলোচনাটাই অর্থহীন, আঁধারে ঢিল ছোড়ার মত। কারণ কমিটির ব্যাপারে শেখ হাসিনা ছাড়া আর কেউ কিছু জানেন না।
২১তম সম্মেলনে ঘোষিত আওয়ামী লীগের নতুন কমিটিতে একমাত্র চমক শাজাহান খান। সাবেক এই জাসদ নেতা জীবনে প্রথম আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ঢুকলেন। তার প্রথম পদ সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, জীবনভর আওয়ামী লীগ করে আসা অনেকের কাছে যেটা স্বপ্ন। সদাবিতর্কিত শাজাহান খানের একমাত্র যোগ্যতা যখন তখন দেশ অচল করে দেয়ার ক্ষমতা। আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সভাপতিমণ্ডলীতে তার অন্তর্ভুক্তি প্রমাণ করে ব্ল্যাকমেইল করতে পারা আসলেই অনেক বড় ক্ষমতা।
শাজাহান খানের অন্তর্ভুক্তি ছাড়া আওয়ামী লীগের নতুন কমিটিতে বড় কোনো চমক নেই। তবে সরকার থেকে দলকে আলাদা রাখার একটা চেষ্টা আছে। মন্ত্রিসভায় থাকা অন্তত ৭ জন বাদ পড়েছেন দলের বিভিন্ন পদ থেকে। সরকারে নেই, সংসদেও নেই; এমন নেতারা সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে এসেছেন। ক্ষমতা ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু রাজনীতিতে টিকে থাকতে দরকার শক্তিশালী সংগঠন। এটা যদি সত্যি আওয়ামী লীগ বুঝে থাকে, তবে আখেরে মঙ্গল। মন্ত্রিসভার বাইরে থাকা নেতা, বিশেষ করে সংসদের বাইরে থাকা মানে গত নির্বাচনে মনোনয়ন না পাওয়া নেতারা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেয়েছেন।
মনোনয়ন না পাওয়া জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হয়েছেন, বাহাউদ্দিন নাছিম প্রমোশন পেয়ে সাংগঠনিক সম্পাদক হয়েছেন। মন্ত্রিসভায় না থাকা শাজাহান খান সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হয়েছেন। সাবেক প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম সাংগঠনিক সম্পাদক হয়েছেন। ফলে মন্ত্রিসভা, এমনকি সংসদের বাইরে থাকা নেতারা দলকে অনেক বেশি সময় দিতে পারবেন। সংগঠনকে তৃণমূল থেকে গোছাতে পারবেন। দলের সাধারণ সম্পাদককেও আরো ফ্রি করে দিলে ভালো হয়। তাকে দপ্তারবিহীন মন্ত্রী করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে তিনি আরো নিবিড়ভাবে সংগঠন গড়ে তুলতে পারবেন।
বাংলাদেশের অন্য সব দলের মত আওয়ামী লীগের ভেতরেও গণতন্ত্রের চর্চা নেই বললেই চলে। তবে নিয়মিত কাউন্সিল, তৃণমূল পর্যন্ত সংগঠনের বিস্তৃতি, কেন্দ্রের সাথে প্রান্তের যোগাযোগ আওয়ামী লীগকে অন্য সংগঠনের চেয়ে আলাদা করেছে। তাই শত ঝড়েও তাদের উপড়ে ফেলা যায় না। তবে সারাদেশের নেতাদের ডেকে এনে দুই বেলা খাওয়ানো, এক বেলা বক্তৃতা আর কিছু গান শোনানো হলে; তাকে কাউন্সিল না বলে দলীয় পিকনিক বলাই ভালো। এবারের দিকনির্দেশনা বা কমিটিতে কোনো নতুনত্ব নেই, কোনো সৃষ্টিশীলতা নেই। আগের কমিটির একটু অদলবদল মাত্র।
রুটিন প্রমোশন, নিয়মিত রদবদল ছাড়া কিছু নেই। সামনে থেকে শেখ হাসিনার ভাষণ শুনেছেন, এটুকু সান্ত্বনা নিয়ে নিজ নিজ এলাকায় ফিরে গেছেন নেতাকর্মীরা। অথচ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল মানে সারাদেশের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছে অন্যরকম স্পন্দন। প্রচণ্ড শীত উপেক্ষা করে কুষ্টিয়া থেকে কাউন্সিলে এসেছিলেন ১০৪ বছর বয়সী ইসহাক আলী। লাঠি ভর দিয়ে প্রায় কুজো হয়ে যাওয়া ইসহাক আলীর ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। নিয়মিত হলেও এবারের ত্রিবার্ষিক কাউন্সিল একটা ভিন্ন প্রেক্ষাপটে হয়েছে।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনা এক অভিনব অভিযান শুরু করেছিলেন। সেটা আসলে আত্মশুদ্ধি অভিযান। দুর্নীতি বিরোধী এ অভিযানে মূল টার্গেট ছিলেন দলের নেতারা। শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত উদ্যোগে শুরু হওয়া এ অভিযান দলের ভেতরে-বাইরে দারুণ আশাবাদ সৃষ্টি করেছিল। প্রশাসনিক অভিযানের পাশাপাশি তিনি সাংগঠনিক অভিযানে দলে আতঙ্ক ছড়িয়েছেন। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগের অনেক বাঘা বাঘা নেতা কুপোকাত হয়েছেন এই অভিযানে। অনেকে ক্ষমতা হারিয়েছেন, অনেকে পালিয়েছেন, অনেকে কারাগারে আছেন।
সেই অভিযানের ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনা সংগঠন গোছানোর কাজ শুরু করেন। কৃষক লীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, যু্বলীগের কাউন্সিল হয়েছে। সহযোগী সংগঠনে মোটামুটি ক্লিন ইমেজের নেতারা দায়িত্ব পেয়েছিলেন বলে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল ঘিরেও দারুণ প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। প্রবল প্রত্যাশার বিপরীতে বিপুল হতাশাই মিলেছে শুধু। আওয়ামী লীগের নতুন কমিটিতে কোনো গুণগত পরিবর্তন নেই। নতুন বোতলে পুরোনো মদ। যেই লাউ, সেই কদু।
আওয়ামী লীগে নেতা হওয়ার যোগ্যতা কী? একমাত্র যোগ্যতা শেখ হাসিনার পছন্দ। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন খুব সততার সাথে বিষয়টি তুলে ধরেছেন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে, ‘আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে আবার প্রমাণ হল, উন্নয়ন মাতা শেখ হাসিনাই একক এবং একমাত্র নেতা। তিনি আমাদের প্রতি দয়া বর্ষণ করলেই আমরা নেতা, আমরা কিছুটা ক্ষমতা প্রাপ্ত হই। তাঁর অপরিসীম আলোয় আমরা আলোকিত। আমাদের নিজস্ব কোন আলোকচ্ছ্বটা নেই। কেবলমাত্র তাঁর আলো বর্ষিত হলে সেই আলো আমাদের শরীর থেকে প্রতিফলিত হয়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সমগ্র নেতাকর্মী এবং দেশের জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা কেবলমাত্র জননেত্রী শেখ হাসিনার ওপর। আমাদের ওপর নয়। তিনি না চাইলে আমার বর্তমান পদ অব্যাহত থাকতো না। তাঁর এই দানকে আমার যোগ্যতার প্রাপ্তি বলে অহঙ্কারে মাটিতে পা না পড়লে সর্বনাশ হবে আমার, ধ্বংস হবো আমি। সম যোগ্যতা বা কাছাকাছি যোগ্যতার অসংখ্য নেতাকর্মী আছেন এই বিশাল দলে। তাহলে আমাদের কিসের এতো অহঙ্কার ! কিসের এতো দম্ভ !!’
এটাই কিন্তু সত্য, এটাই বাস্তবতা। তবে ভরসার কথা হলো, দক্ষতা ও যোগ্যতায় শেখ হাসিনা নিজেকে অন্য উচ্চতায় তুলে নিয়েছেন। তাই তাঁর পছন্দের ওপর আস্থা রাখা যায়। তাই দল ও দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য আস্থা রাখতে হবে তাঁর ওপরই। কিন্তু কাজটা করতে হলে তাঁর দলের সাহায্য লাগবে, নেতাদের সাহায্য লাগবে। শেখ হাসিনা তাঁর বাহিনী পছন্দ করে নিয়েছেন। এখন তাঁর কাছে প্রত্যাশা তিনি দলকে পরিষ্কার করবেন। তারপর সেই পরিচ্ছন্ন বাহিনী নিয়ে দেশকে এগিয়ে নেবেন নতুন উচ্চতায়।
এইচআর/পিআর