রাজাকারেও আসল-নকল

মোস্তফা কামাল
মোস্তফা কামাল মোস্তফা কামাল , সাংবাদিক
প্রকাশিত: ১০:০৭ এএম, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯

অতি চাতুরিতে ভেস্তে গেল আরেকটা ভালো উদ্যোগ। মুক্তিযোদ্ধাদের মতো রাজাকারেও খাঁটি-ভেজাল বা আসল-নকল। মুক্তিযোদ্ধা তালিকার মতো রাজাকারের তালিকায়ও জাল-জালিয়াতিসহ কেলেঙ্কারি থাকবে-এমন সন্দেহ ছিল অনেকের। সেটা বাস্তবায়ন হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার ঘোষিত তালিকায়। প্রথম ধাপে ঘোষিত ১০ হাজার ৭৮৯ জন রাজাকারের তালিকায় উঠে এসেছে মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আরো কারো কারো নামও।

না হওয়ার চেয়ে হওয়া বা না থাকার চেয়ে থাকা ভালো- এমন যুক্তিতে এ তালিকা প্রকাশ অবশ্যই ইতিবাচক। মুক্তিযোদ্ধার পাশাপাশি রাজাকারের তালিকার তাগিদ ছিল বিভিন্ন মহল থেকে। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর হলেও তালিকাটি প্রকাশের মধ্য দিয়ে সেই তাগিদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন হয়েছে। কিন্তু, অগোছালো, অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় সমালোচনায় পড়েছে প্রকাশিত তালিকাটি। বেশি সমস্যা ও প্রশ্নের জন্ম হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের রাজাকার তালিকাভুক্ত করায়। রাজাকার-স্বাধীনতাবিরোধীদের মুক্তিযোদ্ধা দাবি করা, মুক্তিযুদ্ধের খেতাব নিয়ে শিনা টান করে ঘোরার ঘটনার সঙ্গে মানুষ পরিচিত বহুদিন থেকেই। এই কষ্ট হজম করে বেঁচে আছেন মুক্তিযোদ্ধারা। তাদের জন্য এবার যোগ হলো আরো বেদনা। তাদের পিঠেই পড়ে গেল রাজাকারের সীল।

তালিকা ঘোষণার দিন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েব পেজ বেশ ভিজিট করেছে রাজাকারের ছা পোনারা। তারা তাদের গাদ্দার বাপকে খুঁজেছে দশ হাজারের পালে। সবাই পায়নি। তবে, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের কেউ কেউ বাপ-দাদার নাম পেয়েছে রাজাকারের পালে। তাদেরই একজন বরিশালের আলোচিত বাসদ নেত্রী ডাক্তার মনীষা চক্রবর্তী।

এ ক্ষেত্রে মনিষার অনুভূতিটি উল্লেখ না করলেই নয়। তার ফেসবুক স্ট্যাটাসটি এমন- মানুষের জন্য নিঃস্বার্থ কাজ করার পুরস্কার পেলাম আজ। ধন্যবাদ আওয়ামী লীগকে। সদ্য প্রকাশিত রাজাকারদের গেজেটে আমার বাবা এবং ঠাকুমার নাম প্রকাশিত হয়েছে। আমার বাবা এড. তপন কুমার চক্রবর্তী একজন গেজেটেড মুক্তিযোদ্ধা,ক্রমিক নং ১১২ পৃষ্টা ৪১১৩। তিনি নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ও পেয়ে থাকেন! আজ রাজাকারের তালিকায় তিনি ৬৩ নাম্বার রাজাকার। আমার ঠাকুরদা এড সুধির কুমার চক্রবর্ত্তীকে পাকিস্থানি মিলিটারি বাহিনী বাসা থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। তিনিও ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত। তাঁর সহধর্মিণী আমার ঠাকুমা উষা রানী চক্রবর্ত্তীকে রাজাকারের তালিকায় ৪৫ নম্বরে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শ্রমজীবী খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য আমার রাজনীতি করার খেসারত দিতে হচ্ছে আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে।

এমন স্বীকৃতির জন্য সরকারকে ধন্যবাদ দিয়েছেন মনিষা। গত বছর বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বাসদের মনোনয়নে মেয়র পদে প্রার্থী ছিলেন ডা. মনীষা চক্রবর্তী৷ এই ধরনের ছোট-বড় আরো বহু ঘটনা রাজাকারের তালীকায়। অসুস্থ শরীরেও রাজাকারদের বিচার কাজে পরিশ্রান্ত আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌশলী এডভোকেট গোলাম আরিফ টিপুর নামও আছে রাজাকার তালিকায়। ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক একুশের পদকপ্রাপ্ত ভাষা সৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা টিপুও এখন সরকারঘোষিত রাজাকার। আর কী লাগে? রাজাকারের সন্তানদের জন্য শুভবার্তা।

ধাপে ধাপে আরও তালিকা প্রকাশ হবে বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। মন্ত্রী আরও বলেন, যারা ’৭১ সালে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বা স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে পাকিস্তান সরকার কর্র্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং যেসব পুরনো নথি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সংরক্ষিত ছিল, সেটুকু প্রকাশ করা হয়েছে। তালিকা প্রকাশের পরপরই মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ও মুক্তিযোদ্ধারা তালিকার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে থাকেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একের পর এক মুক্তিযোদ্ধার নাম রাজাকারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার তথ্য আসতে থাকে। তালিকায় স্থানীয়ভাবে চিহ্নিত রাজাকারদের নাম না থাকায় বিভিন্ন জেলার মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।

রাজাকারের তালিকা করার মতো কাজটি কাদের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে তার একটা ঝলক তো দেখাই গেল। কাজ আর কথার পাকনামি এক জিনিস নয়। চাতুরি-চালাচি-চাপায় সব কিছু হয় না। যারা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ দিয়েছেন-নিয়েছেন, তারা আবার মুক্তিযোদ্ধাদের রাজাকার তালিকায় ঢুকিয়ে নিজেদের ভুয়া সনদ আলোচনার বাইরে রাখতে সফল হলেন। রাজাকারের তালিকা নিয়ে এ ধরনের কাণ্ডকীর্তির জবাব দিতে গিয়ে বিনোদনের যোগান দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী৷ বলেছেন, রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ঢুকেছে পাকবাহিনীর ভুলে। কোথায় আছি আমরা? পাকিস্তানিদের তৈরি করা তালিকা প্রকাশ করল বাংলাদেশ? নিজেদের কোন উদ্যোগ ছিল না?

নিত্য নতুন ইস্যুর তোড়ে এসব প্রশ্ন তামাদি হয়ে যাবে। চলে আসবে অন্য প্রসঙ্গ। অন্য ইস্যু। রাজাকার তালিকা কেলেঙ্কারিও মানুষ ভুলে যাবে। অথবা সরকারও এক তুড়িতে এটাও ম্যানেজ করে ফেলবে। মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে সবচেয়ে প্রফিটেবল বিজনেস আওয়ামী লীগ দক্ষতার সাথে করে আসছে সুদূর থেকেই। রাজাকার তালিকার কারণে সেটাতে একটু ছেদ পড়ে কিছু সিস্টেম লসের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। অসুবিধা নেই। খুদ-কুড়া দিয়ে কিছুদিনের মধ্যে ঠিক করে ফেলবে। এরইমধ্যে হৈ চৈ ‘নাই’ হতে বসেছে। পরিবেশটা সুন্দর হয়ে আসছে।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/পিআর

রাজাকারের তালিকা করার মতো কাজটি কাদের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে তার একটা ঝলক তো দেখাই গেল। কাজ আর কথার পাকনামি এক জিনিস নয়। চাতুরি-চালাচি-চাপায় সব কিছু হয় না। যারা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ দিয়েছেন-নিয়েছেন, তারা আবার মুক্তিযোদ্ধাদের রাজাকার তালিকায় ঢুকিয়ে নিজেদের ভুয়া সনদ আলোচনার বাইরে রাখতে সফল হলেন। রাজাকারের তালিকা নিয়ে এ ধরনের কাণ্ডকীর্তির জবাব দিতে গিয়ে বিনোদনের যোগান দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী৷ বলেছেন, রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ঢুকেছে পাকবাহিনীর ভুলে। কোথায় আছি আমরা? পাকিস্তানিদের তৈরি করা তালিকা প্রকাশ করল বাংলাদেশ? নিজেদের কোন উদ্যোগ ছিল না?

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।