এনআরসি : কোন পথে ভারত?
ভারত সরকার ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এনআরসি বাস্তবায়নের নামে তথাকথিত 'অবৈধ বাংলাদেশিদের' আটক করছে। ফলে বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বৈধ ভারতীয় বা তাদের ভাষায় 'অবৈধ বাংলাদেশিরা' বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে। গত আগস্টে ভারত এনআরসি'র আড়ালে বিপুল সংখ্যক নাগরিকদের বাদ দিয়ে একটি নাগরিক তালিকা তৈরি করে। এখন সেই এনআরসি কার্যকর করতেই তাদের ভাষায় অবৈধ বাংলাদেশিদের ধরপাকড় করে থানা হাজতে আটকে রাখছে। এই আতঙ্কেই বাংলাদেশের সীমান্ত দিয়ে তাদের ভাষায় 'অবৈধ বাংলাদেশিরা' বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে।
এই অনুপ্রবেশ ঠেকাতে দেশের সীমান্ত এলাকার মানুষ আমাদের সীমানা পাহারা দিচ্ছে। ভারত থেকে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে রাজশাহীর চরখানপুর সীমান্তে গ্রামবাসীর সহযোগিতা চেয়েছে বিজিবি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে পাহারা দিয়ে এই অনুপ্রবেশ ঠেকানো যাবে কি? যদি যায়ও, সেটা কতদিন? বাংলাদেশ কি তবে আরেকটি নীরব শরণার্থী সমস্যার দিকে অগ্রসর হচ্ছে? রোহিঙ্গা সমস্যারই আজ পর্যন্ত কোনো সুরাহা হয়নি। তারওপর যদি এই ভারতীয়রা এখন বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে তবে তা হবে আমাদের জন্য 'মরার ওপর খাড়ার ঘা'।
গত ৩১ আগস্ট আসামে এনআরসি'র চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পরপরই আশঙ্কা করা হচ্ছিল যে এই অজুহাতে তারা একটি নাগরিক গোষ্ঠীকে ভারত থেকে বিতাড়ন করতে চায়। বিষয়টিকে আমাদের অনেকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করেছে। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে ভারত খামাখা এনআরসির মতো একটি তালিকা করেনি। এর পেছনে তাদের রাজনীতি ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা আছে যা ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী যে উগ্রবাদী জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বিকাশ হচ্ছে ভারতের এনআরসি বা মিয়ানমারের 'রোহিঙ্গা' ইস্যু তারই নজির। বিশ্বব্যাপী অভিবাসীদের তাড়ানোর একটি কৌশল নিয়েছে বিভিন্ন দেশ। শুধু তাই নয়, তারা নিজ দেশের নাগরিকদের মধ্যেও বিভাজন রেখা টেনে দিয়ে কোনো কোনো শ্রেণিকে নিজ দেশেই পরবাসী হিসেবে ঘোষণা করছে। এভাবেই দেশে দেশে উগ্রজাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ ঘটে। রাষ্ট্রীয় এ শ্রেণিভেদের আরেকটি ভিত্তি হচ্ছে ধর্ম।
মানুষ খেদানোর কৌশলটি হয় কখনো পরোক্ষ, কখনো বা প্রত্যক্ষ। মিয়ানমার প্রথমে রোহিঙ্গাদের তাদের নাগরিক তালিকা থেকে বাদ দেয়। পরে প্রত্যক্ষ নির্যাতন করেই তাদেরকে ভিটামাটি ছাড়া করে। তাদের ঘর বাড়িতে আগুন দিয়ে, হত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতন করে দেশ থেকে পালাতে বাধ্য করছে।
ভারতও এনআরসির নামে প্রথমে তাদেরকে নাগরিকত্বের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে। এখন ভারত সেই তালিকা বা এনআরসি বাস্তবায়নের দিকেই অগ্রসর হচ্ছে। প্রথমে তারা রাজ্যে রাজ্যে গ্রেফতার শুরু করেছে। গ্রেফতারের ভয়ে যদি কেউ দেশ থেকে না পালায়, তবে এক সময় তাদেরকে জোর করে দেশ থেকে বের করে দেয়া হবে। এখন পরোক্ষ ভয়-ভীতি প্রদর্শন, পরে কাজ না হলে 'রোহিঙ্গা' পদ্ধতি মানে নির্যাতন করে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হবে যাতে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। এ জাতীয় সমস্যার প্রথম ভিক্টিম হয় পাশ্ববর্তী দেশ। ফলে বাংলাদেশ আজ আরেকটি সমস্যার সম্মুখীন।
মিয়ানমার প্রথমেই কাউকে জোর করে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য করেনি। এক পর্যায়ে প্রাণ বাঁচাতে তারা আমাদের দেশে আসে। যেমন আমরা গিয়েছিলাম ১৯৭১ সালে। তাই জোর করার বিষয়টি এখানে গুরুত্বপূর্ণ না, গুরুত্বপূর্ণ হলো সে রকম পরিবেশ সৃষ্টি করা হলো কি না। এনআরসির আড়ালে ভারত সে পরিবেশ সৃষ্টি করার দিকে এগুচ্ছে কি না সেটি লক্ষ্য রাখতে হবে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম মারফত জানতে পারি, কর্ণাটক রাজ্য থেকে গত কয়েক দিনে দফায় দফায় ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ বলে আটক করে নাগরিকদের কলকাতায় পাঠানো হচ্ছে। জানা যায়, আটককৃতদের শিগগিরই বাংলাদেশে ‘পুশইন’ করা হবে। এটি ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমেরই ভাষ্য। সুতরাং, আমাদের ঘুমিয়ে থাকার সুযোগ নেই। ‘অবৈধ বাংলাদেশি বিতাড়নের’ নামে বৈধ ভারতীয়দের বাংলাদেশে পাঠানোর পাঁয়তারা করে ভারত তার রাজনৈতিক ফায়দাই হাসিল করতে চায় কি না সেদিকেও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।
২০১৩ সালে আদালতের দেয়া আদেশের অজুহাতে ২০১৯ সালে এসে তা পুরো ভারতের জন্য প্রয়োগ করা আইনের রাজনৈতিক ব্যবহারমাত্র। মূলত সংঘ পরিবারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্যই এই মহাপরিকল্পনা। ভারতকে একটি একক ও আধিপত্যবাদী উগ্র জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করাই এর উদ্দেশ্য। ধর্ম এর একটি অনুষঙ্গমাত্র।
উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনার মাধ্যমে খুব সহজেই মেজরিটি গু্রুপের জনপ্রিয়তা অর্জন করা যায়। এজাতীয় সস্তা জনপ্রিয়তার ফর্মুলার জন্য রাজনীতিকদের উদ্দেশ্য হয়তো সাধন হয়, কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় রাষ্ট্র। রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে একটি ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠী চুরান্ত সার্বভৌম নিরাপত্তার মধ্যে বসবাস করতে পারবে। সে কারণেই বহু ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের মানুষ সবাই মিলে একটি রাষ্ট্রে বাস করে। এর ব্যত্যয় হলে রাষ্ট্র তার চরিত্র হারায়। এনআরসি বাস্তবায়তের মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক ভারতবর্ষ অফিসিয়ালি তার রাষ্ট্রীয় চরিত্র বদলের কাজটি শুরু করলো।
কিন্তু সবচেয়ে বড় আফসোসের বিষয় হলো রাষ্ট্র কোনোদিন চাইলেও তার পুরনো আদলে ফিরে আসতে পারে না। কারণ, ততদিনে রাষ্ট্রের নাগরিকদেরও চরিত্র বদল হয়ে যায়। সংখ্যাগুরু নাগরিকগোষ্ঠী ভাবতে শুরু করে ওই রাষ্ট্রের হক শুধু তাদেরই। এই 'তারা' আর 'আমরা'ই আজকের বিভিন্ন রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সমস্যা। Devide and Rule তত্ত্ব দিয়ে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ শাসন করেছে ২০০ বছর। আজ ভারতবাসী নিজেরাই নিজেদের জন্য বেছে নিয়েছে সেই Devide and Rule তত্ত্ব। প্রশ্ন হচ্ছে, সংঘ পরিবার কি ২০০ বছর এই তত্ত্ব দিয়ে ভারতবর্ষের ক্ষমতা আকড়ে ধরে থাকতে পারবে? তারচেয়েও বড় প্রশ্ন- যদি পারেও, সেই ভারতবর্ষ কি রাম-রাবন-জবন, খাজা নিজামউদ্দিন, গরীবে নেওয়াজ, গুরুদুয়ারা এমনকি মাদার তেরেসার দেশই থাকবে? এনআরসি নামে এই লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে ভূস্বর্গের দেশকে কুরুক্ষেত্র বানিয়ে কার কী ফায়দা হলো তা সময়ই বলে দেবে।
আজকের ভারতের ক্ষমতাশালীরা হয়তো ভারতকে শুধুই একটি দেশ হিসেবে দেখছেন। কিন্তু ইতিহাস বলে ভারত শুধু একটি দেশই নয়, এটি একটি সভ্যতা এবং পুরোটা মিলে ভারত নিজেই একটি 'সংস্কৃতি'। এই সভ্যতা ও সংস্কৃতির মূল ভিত্তিই হচ্ছে বহুত্ববাদ। কিন্তু আজ সেই বহুত্ব বাদ দিয়ে রাষ্ট্রীয় একত্ববাদ গ্রহণ করেছে ভারত। এটি ভারতকে কোথায় নিয়ে যাবে?
একাত্ববাদী এনআরসি আজ শুধু আসাম নয় ভারতের অন্য রাজ্যগুলোতেও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কারণ এজাতীয় একত্ববাদী ফর্মুলা আফিমের মতোই একটি কার্যকর নেশা। একত্ববাদ ও জেনেফোবিয়ার ফলই হচ্ছে নাগরিকদের মাঝে বিভক্তিরেখা টেনে দেওয়া। রক্ত দিয়ে পাকিস্তান হাসিল করেও বাঙালি পাকিস্তানি শাসকদের দৃষ্টিতে খাটি পাকিস্তানী হতে পারেনি, মুসলমানতো নয়ই। ফলে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকরা এই বিভক্ত রাষ্ট্রে সব সময়ই 'উইপোকা' হিসেবে আখ্যায়িত হয়। যুগে যুগে, দেশে, দেশে অমিত শাহ'রা শুধু মুসলমান ভারতবাসীদেরকে নয়, মূলত সংখ্যালঘুদেরকে উইপোকা বলেই মনে করে। এই উইপোকাকে সমুদ্রে ফেলে দিলেও কার কী করার আছে? এনআরসি'তে ভারতবর্ষ উইপোকামুক্ত হবে কিনা জানি না, তবে অসাম্প্রদায়িক ভারতের বদলে আমরা হয়তো জানবো ও চিনবো নতুন এক ঘুণে ধরা ভারতবর্ষকে। আমাদের ভয় ও বেদনা সেখানেই।
লেখক : কলামিস্ট।
এইচআর/পিআর