আবার জেগে উঠি

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ১০:০৭ এএম, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯

বুদ্ধিজীবী কে? জাঁ পল সার্ত্রে বলেছেন, জ্ঞানচর্চার জগতে পেশাদার যাঁরা, এক অর্থে তাঁরাই বুদ্ধিজীবী। কিন্তু এটুকুই যথেষ্ট নয়। বলতে পারি বুদ্ধিজীবীরা রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সব ক্ষেত্রে সমাজের শুভচিন্তক। একজন বুদ্ধিজীবী সত্যের সাধক। তিনি তাঁর পরিপার্শ্বের সঙ্কটকে নিজের মধ্যে, নিজের পেশাদারি জ্ঞানচর্চার মধ্যে ছায়া ফেলতে দেখেন এবং তাকে নিবিড় ভাবে অনুভব করে বিচলিত হন।

আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে দখলদার পাকহানাদার বাহিনী ও তার দোসর রাজাকার আল-বদর, আল-শামস মিলিতভাবে বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ধরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরেরা এ দেশের মানুষের ওপর যে গণহত্যা ও নৃশংসতা চালিয়েছে, তার নজির ইতিহাসে খুব বেশি নেই। কিন্তু সেই নয় মাসের নৃশংসতা ছাপিয়ে গেছে যে মর্মান্তিক ঘটনা, তা হলো বিজয়ের প্রাক্কালে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করা। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যরা রাতের অন্ধকারে লেখক-বুদ্ধিজীবী-শিক্ষাবিদ-চিকিৎসক-সাংবাদিক-প্রকৌশলীদের ধরে নিয়ে হত্যা করে।

১৪ ডিসেম্বরকে আমরা বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস হিসেবে পালন করলেও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের এমন একটি দিন নেই- যেদিন কোনো না কোনো বুদ্ধিজীবীর রক্ত ঝরেনি। কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক-শিল্পীদের অপরাধ- তারা বাঙালি জাতিকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা সারাদেশে খুঁজে খুঁজে সত্যের পক্ষে, নিপীড়নের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া বিবেকবান শিক্ষিত মানুষকে হত্যা করেছে। ২৫ মার্চের কালরাত থেকেই অন্যদের সঙ্গে বুদ্ধিজীবীরাও হত্যার শিকার হয়ে আসছিলেন। একাত্তরে সহস্রাধিক বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪২ জন আইনজীবী, ১৬ জন শিল্পী-সাহিত্যিক রয়েছেন। ২৫ মার্চ কালরাতে যে হত্যাকাণ্ডের শুরু তা চলে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এমনকি স্বাধীনতার পরও পাকিস্তানি বাহিনীর বশংবদ বিহারীদের হাতে জহির রায়হানের মতো প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবীকে প্রাণ হারাতে হয়।

একটি জাতিকে মেধাগত দিক থেকে এগিয়ে নেন বুদ্ধিজীবীরা। পাকিস্তানিরা এবং তাদের বশংবদরা এটিকে অপরাধ বলে ভেবেছিল। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীরা ছিল তাদের প্রতিহিংসার শিকার। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আজ আমরা সেই মহান সন্তানদের স্মরণ করছি। শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। কিন্তু কিভাবে তাদের মনে রাখছি এবং জাতি হিসেবে আমাদের করণীয কী, সেটা জানা প্রয়োজন। যাঁরা নিজেদের জ্ঞান-মনীষা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে জাতিকে পথ দেখিয়েছেন, আলোকিত করেছেন, তাঁদের বছরের একটি দিন স্মরণ করলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। তাঁদের শিক্ষাকে অন্তরে ধারণ করতে হবে, নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে কেন তাঁরা জীবন দিয়েছেন।

প্রগতিশীল, সামাজিক উদারবাদী, পরিবেশবাদী, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী একটি শিক্ষিত শ্রেণি আমাদের প্রয়োজন যারা বৃহদর্থে সমাজের নিচের ধাপের, ক্ষমতাহীন সামাজিক-অর্থনৈতিক শ্রেণিগুলোর পক্ষে সংগ্রামের পথে থাকবেন। অর্থাৎ, তাঁদের অবস্থানটা হল বিদ্যমান ক্ষমতাকাঠামোটার সাথে সেই লড়াইটা করা যাতে সামাজিক-অর্থনৈতিক বঞ্চনাগুলো দূর করা যায় এবং বঞ্চিতরা নিজস্ব সক্ষমতা বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে কাঙ্খিত জীবনমান পেতে পারেন।

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে দেশবাসী গভীর শোক ও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে সেসব মানুষের স্মৃতি, যাঁরা ছিলেন দেশপ্রেম ও মননশীলতায় অগ্রণী এক প্রজন্ম। স্বাধীনতাসংগ্রামের সূচনা থেকে শুরু করে চূড়ান্ত বিজয়ের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত আমরা হারিয়েছি অধ্যাপক জি সি দেব, মুনীর চৌধুরী, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, রাশীদুল হাসান, ড. আনোয়ার পাশা, সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, নিজামুদ্দীন আহমদ, গিয়াসউদ্দিন আহমদ, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরী, সেলিনা পারভীনসহ আরও অনেককে। তাঁরা সবাই ছিলেন চিন্তা ও মানবতার দিশারি। জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে সেই শূন্যতা আমরা আজও অনুভব করে চলেছি। তাঁদের হারিয়ে বাংলাদেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। তাঁদের স্বজনেরাও বয়ে চলেছেন এক খণ্ডিত জীবনের ভার। আমরা তাঁদের শোকের সমব্যথী, আমরা তাঁদের ত্যাগের উত্তরাধিকারী।

বিলম্বে হলেও এই বুদ্ধিজীবী হত্যায় জড়িত কয়েকজন শীর্ষ ঘাতকের বিচার ও শাস্তি কার্যকর হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার দাবি নিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণ আমরা দেখেছি। বেশ কয়েকজন বড় মানবতাবিরোধী অপরাধীর শাস্তি হয়েছে। এটি সম্ভব হয়েছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজস্ব দৃঢ়তায়। তিনি রাজনৈতিক বড় ঝুঁকি নিয়েই। বিচারের কাজ করছেন। কিন্তু আদালতের রায়ে শাস্তিপ্রাপ্ত চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের মত আলবদর কমান্ডারদের দেশে ফিরিয়ে এনে সেই দণ্ড কার্যকর করা সম্ভব আজও হয়নি। মঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যে ও আশরাফুজ্জামান যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক। তাদের ফেরত আনার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারকে যেমন কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে, তেমনি সংশ্লিষ্ট দেশ দুটিও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে সেই প্রত্যাশা করতে পারি। আদালতে দণ্ডিত মানবতাবিরোধী অপরাধীদের আশ্রয় তারা কেন দিয়ে রাখতে সেই প্রশ্ন করতে পারি।

এবারের বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবসে আমাদের শপথ হোক বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচার সম্পন্ন করতেই হবে। শপথ হোক শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্বপ্ন একটি গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের। আমরা লড়েছিলাম ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে, রাজনৈতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, ভাষাগত আধিপত্যের প্রতিকূলে, স্বাধীন দেশের স্বপ্ন সফল করতে। আজ আবার জেগে উঠি বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের স্লোগানকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে।

লেখক : প্রধান সম্পাদক জিটিভি।

এইচআর/এমকেএইচ

এবারের বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবসে আমাদের শপথ হোক বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচার সম্পন্ন করতেই হবে। শপথ হোক শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্বপ্ন একটি গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের। আমরা লড়েছিলাম ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে, রাজনৈতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, ভাষাগত আধিপত্যের প্রতিকূলে, স্বাধীন দেশের স্বপ্ন সফল করতে। আজ আবার জেগে উঠি বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের স্লোগানকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।