অং সান সু চি জান্তাদের উচ্ছিষ্টভোজী মাত্র
অং সান সু চি বর্তমানে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর (রাষ্ট্রের মুখপাত্র) হিসেবে জবাব দিচ্ছেন হেগে আন্তর্জাতিক আদালতে তার দেশে সংঘটিত গণহত্যার পক্ষে। মিয়ানমারের সংঘটিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একুশ শতকের জঘন্যতম গণহত্যার সঙ্গে জড়িত সরকারের অপরাধের পক্ষে সাফাই দিচ্ছেন তিনি।
আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গাম্বিয়ার উত্থাপিত মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগের জবাবে সু চির বক্তব্য উপস্থাপন গোটা বিশ্ব তো বটেই, আমাদের বাঙালিদের জন্যও এক লজ্জাকর অভিজ্ঞতা।
মানবতার এত বড় লাঞ্ছনা, এত বড় অবমাননা সত্যি নজিরবিহীন ঘটনাই বটে। শান্তির জন্য যাকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছিল, এমন এক নেত্রী- যার মুক্তির জন্য আমরা বাঙালিরা পর্যন্ত আমাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সময় দাবি জানিয়েছি বিশ্ব মানবতার কাছে- সেই নেত্রী আজ সরাসরি দাঁড়িয়েছেন মানবতার বিরুদ্ধে, মানবতা হত্যাকারীদের সমর্থক মুখপাত্র হিসেবে।
তাই হেগে বিক্ষোভকারীরা যে ফেস্টুন বহন করেছে- ‘শেইম অন ইউ সু চি’- সেই লজ্জা যেন আজ গোটা পৃথিবীর। সেই লজ্জা যেন আমাদের বাঙালিদেরও। সু চিকে দেয়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার যারা দিয়েছিলেন, তারা অনেকেই তা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
তার সঙ্গে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া আট বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিও গণহত্যার দায় স্বীকার করে বর্বরতার অবস্থান থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তার প্রতি- এ সবই সেই লজ্জা অপনোদনের প্রয়াস মাত্র।
‘হেগ’-এ আদালতে সু চি নির্বিকার চেহারায় উত্থাপিত অভিযোগ শুনেছেন যেমন, তেমনই আমরা এটা অন্তত বুঝি সেরকম নির্বিকারভাবেই সাফাই গাইছেন তিনি তার ‘সামরিক পার্টনার’দের পক্ষে। যারা তাকে শর্তসাপেক্ষে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব প্রদান করেছে মাত্র।
‘গণহত্যা’ কাকে বলে, সেটা আমরা হাড়েমজ্জায় জানি। কারণ ১৯৭১-এ আমাদের ওপর সেটা সংঘটিত হয়েছিল। একটি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য যে অমানবিক বর্বরতা ও নৃশংসতা, এর প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমরা।
এ রকম বর্বরতা, নৃশংসতার ঘটনা পৃথিবীতে নানা লাভ-লোকসানের হিসাব-নিকেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্টতায় আজও চলমান। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর সংঘটিত গণহত্যা তারই অংশ। একুশ শতকে রুয়ান্ডার গণহত্যা, বসনিয়ায় সার্বীয়দের চাপিয়ে দেয়া গণহত্যা- এসবই সংঘটিত হয়েছে ধর্মের দোহাই দিয়ে। ধর্মীয় বাতাবরণে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে সু চিও ২০২০-এর নির্বাচনে তার দলে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সমর্থন টানার প্রয়াস পাচ্ছেন।
মূলত ক্ষমতার উদগ্র বাসনা কিংবা স্বাদ সু চিকে আজ নতুন অভিধায় চিহ্নিত করার বাস্তবতায় নিয়ে এসেছে। ফলে মার্কিন কূটনীতিক বিল রিচার্ডসন পর্যন্ত এ কথা বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘তিনি এমন একজন নারী, যিনি ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে অন্ধ হয়ে গেছেন। আর সে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্যই তিনি মানবাধিকার লঙ্ঘনের পথে হাঁটছেন।’
সু চির উদ্দেশ্য সম্পর্কে মার্কিন আইনজীবী আফাদজ পাসিপান্দো জানান, ধর্ষণের অপরাধ অস্বীকার করতে স্টেট কাউন্সিলর সু চি বলেছেন, ‘সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর কেউ নোংরা বাঙালি মেয়েকে ছোঁবে না। ওরা আকর্ষণীয় নয়।’ ফেসবুকে ‘ফেক রেপ’ নামে যে পেজ খোলা হয়েছে, সেটির নিয়ন্ত্রক হচ্ছে স্টেট কাউন্সিলরের দফতর। এগুলোতে গণহত্যার উদ্দেশ্যের প্রতিফলন ঘটেছে।
আন্তর্জাতিক আদালতে অকাট্য সাক্ষ্যপ্রমাণ নিয়ে হাজির হয়েছে পৃথিবীর মানবতাবাদী মানুষ এবং সংগঠনগুলো। সু চি দাঁড়িয়েছেন বার্মার সব বর্বরতা, নৃশংসতার পক্ষ নিয়ে। যার প্রয়াত পিতা বার্মার গণতন্ত্রের জন্য প্রাণ দিয়েছেন।
যিনি নিজে বছরের পর বছর গৃহবন্দি জীবন কাটিয়েছেন। আজ ক্ষমতার সামান্য অংশীদার হয়ে তিনি নিজেই দানবে পরিণত হয়েছেন। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে তিনি স্বীকার করে নিতে পর্যন্ত পরাঙ্মুখ- তাদের ‘বাঙালি’ বলে গালি দিচ্ছেন ‘বর্বর’, ‘অসভ্য’ এবং ‘কুৎসিত’ ভাষায়! তিনি নিজে কেবল নষ্টদের দলে ভিড়ে যাননি, তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে শান্তিপ্রিয় ধর্মের মানুষকে পর্যন্ত কালিমালিপ্ত করতে প্রয়াস পাচ্ছেন।
যে ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা- ‘পৃথিবীর সব প্রাণী সুখী হোক’ এই প্রার্থনায় গোটা জগৎকে উজ্জীবিত করেছিলেন, যে ধর্মের শাসক সিদ্ধার্থ রাজপ্রাসাদ ছেড়ে চলে এসেছিলেন মানুষের পর্ণকুটিরে, সেই ধর্মের মানুষের দোহাই দিয়ে তিনি জাতি হত্যার পাপে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন।
যে ধর্মের প্রবর্তক সর্বাগ্রে বলেছেন এই বাক্য যে, ‘জীব হত্যা মহাপাপ।’ সেই ধর্মের মানুষের ঘাড়ে তিনি তুলে দিচ্ছেন একটা গোটা জাতি হত্যার অপরাধ তথা পাপকে। ক্ষমতার স্বাদ মানুষকে কেবল অন্ধই করে না, বিবেকহীন মনুষ্যত্ববর্জিত জীবেও পরিণত করে। আমাদের সামনে তার জাজ্বল্যমান উদাহরণ- অং সান সু চি।
২.
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জীবন বাঁচানো অধিকারের পক্ষে আমরা বাঙালিরা শুরু থেকেই আছি। আমরা তাদের আশ্রয় দিয়েছি। তাদের অধিকার পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টায় নিয়োজিত আছি; তা এ জন্য নয় যে, তারা কেবল মুসলিম- তাদের পরিচয় তারা মানুষ- আমরা বাঙালিরা পৃথিবীর সর্বত্র মানবতার পক্ষে দাঁড়াই, পক্ষে থাকি; কারণ মানবতাই সারা পৃথিবীর ধর্ম।
গাম্বিয়া একটি ছোট্ট দেশ, যারা পৃথিবীর নীরবতাকে ভেঙে দিয়ে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ‘গণহত্যা’ বন্ধের দাবি আন্তর্জাতিক আদালতে উত্থাপন করে একুশ শতকে ঘুমিয়ে পড়া মানবতাকে জাগিয়ে তুলেছে।
পৃথিবীর যেসব দেশ তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ভূরাজনৈতিক কৌশলগত কারণের অজুহাতে মানবতাবিরোধী গণহত্যার বিরুদ্ধে নীরবতা পালন করছে, তারাও মানবতার দাবি প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসবেন- এটাই আমাদের কামনা।
নোবেলজয়ী নাট্যকার হ্যারল্ড পিন্টার তার নোবেল ভাষণে বলেছিলেন, ‘এ অবধি সাক্ষ্যপ্রমাণ বলে যে, অধিকাংশ রাজনীতিবিদ সত্যেয়’ আগ্রহী নন বরং ক্ষমতা আর ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে আগ্রহী। এর জন্য মানুষের অজ্ঞ থাকা, সত্য না জানা, এমনকি নিজ জীবনের ব্যাপারেও অজ্ঞ থাকা, একান্ত জরুরি। অর্থাৎ আমরা বিশাল এক মিথ্যার জালে আবৃত, এ মিথ্যাই আমাদের খাদ্য।’ (হ্যারল্ড পিন্টার। নোবেল ভাষণ ২০০৫)
অং সান সু চি হ্যারল্ড পিন্টার কথিত বাস্তবতার সাক্ষাৎ উদাহরণ। ‘ক্ষমতার স্বাদ’, ‘রাজনীতির স্বরূপ’ আর ‘মিথ্যার জাল’ যতই বিস্তৃত হোক, তাকে ছিন্ন করতেই হবে। সত্যের জয়ের স্বার্থে। পৃথিবীর মানুষ সেই লড়াইয়ে শামিল, তা আমরা সু চি বিরোধী ফেস্টুন থেকেই উপলব্ধি করি। ‘শেইম অন ইউ সু চি।’
৩.
আন্তর্জাতিক আদালতে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে সু চি যা বলেছেন, তা কোনো উর্দি পরা সামরিক শাসকও উচ্চারণ করতে দ্বিধাগ্রস্ত হতেন। সু চি বলেছেন, ‘রোহিঙ্গা’দের নিয়ে সবই পশ্চিমা মিথ্যাচার। এমন কিছু বার্মায় ঘটেনি। রোহিঙ্গারা জঙ্গি।’
অর্থাৎ সু চি একটি চমৎকার মাইক্রোফোন মাত্র বার্মার বর্বর শাসনযন্ত্রের। যার মুখ দিয়ে শতাব্দীর এমন ভয়ঙ্কর মিথ্যা ও উদ্গিরণ করিয়ে নেয়া যায়। মহামতি গোয়েবলস্ বেঁচে থাকলে আশীর্বাদ করতেন না মুখ লুকাতেন, সেটা প্রশ্ন বটে!
আমরা আফগানিস্তানে তালেবান জঙ্গিদের দেখেছি বুদ্ধের সুউচ্চ মূর্তি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে আর এই একুশ শতকে সু চি আর তার বার্মার সামরিক ক্ষমতার আত্মীয়স্বজন সম্মিলিত হয়ে কবর দিচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে শান্তিপ্রিয় ধর্মের প্রবক্তা গৌতম বুদ্ধের সুমহান আদর্শকে। সারা পৃথিবী নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের নয় বরং ভয়ঙ্কর জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত করেছে সু চি এবং তার দেশীয় দোসর সামরিক জান্তাদেরই। সু চি আজ যাদের উচ্ছিষ্টভোজী মাত্র।
সাইফুল আলম : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, দৈনিক যুগান্তর
আরএস/জেআইএম