রেমিট্যান্সে হুন্ডির থাবা লাভের লোভে প্রবাসীরা
নানা টানাপড়েনের মধ্যেও অর্থনীতির শিরায় রক্ত সঞ্চালন করে চলছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। নানা শঙ্কার মধ্যেও রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিতে সম্ভাবনা দেখাচ্ছে। প্রতিটি বর্তমান মাসেই রেমিট্যান্স বাড়ছে গত মাসের চেয়ে। এই সুসংবাদটিকে পেছন থেকে খাবলে ধরছে হুন্ডি। রেমিট্যান্স বাড়ার পাশাপাশি হুন্ডি কমলে তা হতো বেশি জাগানিয়া। কিন্তু, হুন্ডিও বাড়ছে। বেশি লাভের মোহে হুন্ডিতেও ঝুঁকছে প্রবাসীরা।
হুন্ডির কারণে প্রবাসীদের উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা প্রকারান্তরে প্রবাসেই থেকে যাচ্ছে। সাময়িক সুবিধার কারণে ব্যাংক এড়িয়ে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানোর প্রবণতা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়া প্রবাসীদের ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠানোয় গরজ কম। এরপরও যথাযথভাবে যা আসছে সেটাও বিশাল। রেমিট্যান্স ছাড়া অর্থনীতির অন্য প্রায় সব সূচকেই দুরবস্থা। গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি কমে গেছে। অর্ডার আসছে না আগের মতো। সামনে সেটা আরো কমার শঙ্কা।
রপ্তানি আয়ে কমতির ধারা অনেকদিন থেকে। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বেশ চাপের মুখে। রাজস্ব আদায়েও ভাটা। মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী। বেসরকারি ঋণ ও বিনিয়োগে মন্দা। এ অবস্থায় ভরসা করার মতো জায়গা কেবল প্রবাসীদের আয়। রেমিট্যান্স নামের এই আয় এখনো তেজোদীপ্ত গতিতে। তা ধরে রাখতে সরকারী প্রণোদনায় কিছু ফল মিলছে। ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনা ও ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নে ব্যাংকিং চ্যানেলে এরইমধ্যে রেমিট্যান্সে বাড়তি মাত্রা যোগ হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে এক হাজার ৬৪১ কোটি ৯৬ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স আসে। এই অঙ্ক আগের বছরের (২০১৭-১৮) চেয়ে ৯.৬ শতাংশ এবং অতীতের যেকোনো বছরের চেয়ে বেশি ছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এক বছরে এই পরিমাণ রেমিট্যান্স আসেনি। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেও রেমিট্যান্সে চলছে বাড়তির ধারা। এ অর্থবছরের জুলাইতে ১৫৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা; যা গত অর্থবছরের জুলাইতে ছিল ১৩১ কোটি ৮১ লাখ ডলার। এরপর গত আগস্টে ১৪৪ কোটি ৪৭ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স আসে; যা গত অর্থবছরের আগস্টে ছিল ১৪১ কোটি ১০ লাখ ডলার। সেপ্টেম্বরে আসে ১৪৭ কোটি ৬৯ লাখ ডলার, যা গত অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে ছিল ১১৩ কোটি ৯৬ লাখ ডলার। অক্টোবরে আসে ১৬৩ কোটি ৯৬ লাখ ডলার, গত অর্থবছরের অক্টোবরে এসেছিল ১১৩ কোটি ৯৬ লাখ ডলার। আর সর্বশেষ গত নভেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছে ১৫৫ কোটি ৫২ লাখ ডলার। এটি গত অর্থবছরের একই মাসের চেয়ে প্রায় ৩২ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের নভেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছিল ১১৮ কোটি ডলার।
কেবল বাংলাদেশ নয়, আধুনিক বিশ্বের ধনী অনেক দেশও এখন রেমিট্যান্সের ওপর ভরসা করে। প্রতিবেশি ভারতের রেমিট্যান্স আমদানি প্রচুর। তাদের বাজার অনেক বড়। চেষ্টা করে দক্ষ শ্রমিক বাইরে পাঠিয়ে বেশি রেমিট্যান্স নিশ্চিৎ করতে। পাকিস্তানেও রেমিট্যান্স বাড়ছে। এ লক্ষে দক্ষ শ্রমিক রপ্তানির পাশাপাশি তারা মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াচ্ছে। এক হিসাবে জানা গেছে, ২০১৮ সালে গোটা বিশ্বে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ছিল ৬৮ হাজার ৯০০ কোটি ডলার, যা তার আগের বছরের চেয়ে ৯ শতাংশ বেশি।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা-আইওএমের সর্বশেষ রিপোর্ট বলছে, প্রবাসী আয়ে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে ভারত। বিভিন্ন দেশে বসবাসরত দেশটির নাগরিকরা সাত হাজার ৮৬১ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন নিজ দেশে।দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পর সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আয় করা দেশ পাকিস্তান। গত বছর তাদের প্রবাসীরা দুই হাজার ১০০ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন দেশে। ২০১৫ সালেও প্রবাসী আয়ে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ দশে। ভিয়েতনামের কাছে সেই জায়গাটি হারিয়ে নেমে আসতে হয়েছে এগারোতে। গত বছর বাংলাদেশে মোট এক হাজার ৫৫০ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।
চীন, মেক্সিকো, ফিলিপাইন,মিসর, ফ্রান্স, নাইজেরিয়া, জার্মানিও রেমিট্যান্স বাড়ানোর নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। দিচ্ছে নানা প্রনোদনা। বাংলাদেশও চেষ্টায় কমতি করছে না। বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের ভরসা হাতে গোনা কয়েকটি দেশ। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্র- এই তিন দেশ থেকেই রেমিট্যান্সের প্রায় ৪৫ শতাংশ আসে। এর মধ্যে সৌদি আরব থেকেই সবচেয়ে বেশি আসে সৌদি থেকে। যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, কুয়েত, ওমান ও কাতার থেকেও রেমিট্যান্স আসার গতি ভালো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-অক্টোবর) রেমিট্যান্স এসেছে ৭৭১ কোটি ডলার। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে এসেছে প্রায় ৪৫০ কোটি ডলার, যা এ পর্যন্ত পাঠানো মোট রেমিট্যান্সের প্রায় ৫৮ শতাংশ। আর ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলো থেকে এসেছে ৩২১ কোটি ডলার বা ৪২ শতাংশ। এ সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব থেকে সর্বোচ্চ ১৬১ কোটি ৮৫ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে।
এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ১১০ কোটি ৪৬ লাখ, কুয়েত থেকে ৬০ কোটি ৯৯ লাখ, ওমান থেকে ৫২ কোটি ৭৯ লাখ, কাতার থেকে ৪৫ কোটি ৭৬ লাখ ও বাহরাইন থেকে ১৭ কোটি ৭০ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে। আর ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৮৯ কোটি ৩৭ লাখ, যুক্তরাজ্য থেকে ৬০ কোটি ২৫ লাখ, মালয়েশিয়া থেকে ৫২ কোটি ৯৮ লাখ, ইতালি থেকে ৩৩ কোটি ৪২ লাখ ও সিঙ্গাপুর থেকে ১৮ কোটি ৮০ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে। গত কয়েক বছর ধারাবাহিক বাড়ছে রেমিট্যান্স। তবে অর্থনীতির আকার যে হারে বাড়ছে এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে না এই সূচক। ফলে পরিমাণে বাড়লেও মোট দেশজ উৎপাদন-জিডিপিতে এ সূচকের অবদান কমছে।
প্রবাসীদের টাকার সিংহভাগ ব্যাংকিং চ্যানেলে এলে রেমিট্যান্সের অংকটা বিশাল হতো। সেটা সম্ভব হচ্ছে না হুন্ডির কারণে। এমনিতেই বাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তি পাঠানোয় অন্য দেশ থেকে পিছিয়ে থাকা, উন্নত বিশ্বে জনশক্তি রপ্তানি কমে যাওয়া এবং বিদেশে গিয়ে ভিসা-সংক্রান্ত নানা জটিলতায় পড়ে বাংলাদেশি রেমিট্যান্স যোদ্ধারা বাজারমূল্যের চেয়ে কম মজুরিতে কাজ করে। তাই অন্যান্য দেশের মতো বাড়েনি বাংলাদেশের শ্রমিকদের গড় রেমিট্যান্স। সেই রেমিট্যান্সকেও মার খাইয়ে দিচ্ছে হুন্ডি।
এছাড়া প্রবাসীদের টাকা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে সেভাবে খরচ হচ্ছে না। বেশি ব্যয় হচ্ছে অনুৎপাদনশীল খাতে। ভোগবিলাসে। সিলেটসহ প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকায় গেলে চোখে পড়ে ছোট-বড় অনেক বিলাসবহুল বাড়ি-ঘর। এগুলোর কোনো কোনোটি ফাঁকা পড়ে থাকে। বছরে বা কয়েক বছরে এগুলোতে এলাহিকাণ্ড করে আপ্যায়ন, অনুষ্ঠানাদি হয়। ব্যাংকেও অলস পড়ে থাকছে অনেক প্রবাসীর টাকা। সরকারের দিক থেকে প্রবাসীদের বিনিয়োগে আগ্রহী করার বহু চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু, ফল আসছে না। পাল্টা কথা আছে প্রবাসীদেরও। সুষ্ঠু পরিবেশ ও বিনিয়োগ ফেরতের নিশ্চয়তা পাচ্ছেন না বলে আফসোস তাদের।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/জেআইএম