সুদের দোষে ঋণ: শূকরের দোষে কচু
দোষটাই গুন। অথবা গুনটাই দোষ। যে আক্রান্ত সেই দোষী। নিজের দায় কথার বাহাদুরিতে অন্যের ঘাড়ে চাপানোর চাতুরিও কম নয়। সেটা স্মার্টনেস হিসেবে বিবেচিত মহলবিশেষে। সেইসঙ্গে পরামর্শ দেয়ার চর্চাও বেশ। সেটা পেঁয়াজ, চাল, ডাল, তেল, লবণসহ চলমান সব কিছুতেই। খেলাপি ঋণ নিয়েও কম নয়।
খেলাপি ঋণের জন্য সুদের উচ্চহারকে দায়ী করা হচ্ছিল অনেকদিন থেকেই। ব্যবসায়ীরা এ নিয়ে কান্নাকাটি করে কাহিল হয়ে শেষে বোবার ভূমিকায় চলে গেছেন। ঋণ শোধ দিচ্ছেন না। আবার কান্নাকাটিও থামিয়ে দিয়েছেন। এর ফাঁকে ঋণ নেয়া কিন্তু বন্ধ থাকেনি। ঋণদাতারা নির্দোষভাবে ঋণ দিয়েছেন। গ্রহীতারা নির্মোহভাবে কেবল নিয়েছেন। শোধ করা পরের ব্যাপার। কেউ কেউ ঋণ নেন বা নিয়েছেন সেটা ফেরত না দেয়ার জন্যই। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী রোগটা ধরেছেন বহু আগেই। রোগদৃষ্টে ওষুধের প্রেসক্রিপশনও দিয়েছেন। সরকার থেকে বার বার তাগাদা দেয়া হচ্ছিল সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে আনার। কিন্তু, কাজের কাজ ঘুরছিল কেবল কথার মধ্যে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা কার্যকর করতে অবশেষে ব্যাংক পরিচালক ও শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে হাইপ্রোফাইল বৈঠক করেছেন অর্থমন্ত্রী। এর আগে তিনি বহুবার বলেছিলেন, ঋণখেলাপি বাড়বে না। বরং ধীরে ধীরে কমবে। তারপরও খেলাপি ঋণ কেবল বেড়েছে। এই সত্যতা স্বীকার করে কিছু ব্যাখ্যাও দেন তিনি। খেলাপি ঋণ-সংক্রান্ত সর্বশেষ সার্কুলার প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ঋণ হিসেব নিয়মিত করার উদ্যোগ নিয়েছি, যাতে ব্যবসা বন্ধ হয়ে না যায়। ঋণ কেন বাড়ল, সেটার জবাবে বলেন, এর মূল কারণ সুদের হার। সুদের হার বাড়লে খেলাপি ঋণ বাড়বেই। সুদের হার ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ হলে এটা দিয়ে ঋণগ্রহীতারা কুলাতে পারে না। তাই সুদের হার ৯ শতাংশের নিচে নিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরি। মোটকথা খেলাপি ঋণের যত দোষ তা এর সুদের হারের।
সব কিছু্রই কিছু না কিছু কারণ থাকে। একটার দোষে আক্রান্ত আরেকটা। একের দোষ অন্যের ঘাড়েও বর্তায়। এই কিছুর মধ্যে কচুও সম্প্রতি বেশ প্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। মহামান্য রাষ্ট্রপতির কথার জের টেনে কচুকে সাবজেক্ট বানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যস্ত থাকা আদব-কায়দার ঘাটতিঅলা ব্যক্তিরা ট্রল করছেন। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ মজা করে ক্ষোভ ঝেড়েছিলেন অসাধু ব্যবসায়ীদের ওপর।
খাদ্যে ভেজাল মেশানোতে জড়িত ব্যবসায়ীদের গণধোলাইয়ের মতো শায়েস্তা করার পরামর্শ দেন তিনি। সেইসঙ্গে দেন একটি মজার তথ্য। রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-রুয়েটের পঞ্চম সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতি দেশে কচু ছাড়া বাকি সব খাবারেই ফরমালিন মেশানো হয় বলে মন্তব্য করেন। বলেন, ‘আগে শুধু পকেট মারলেই গণপিটুনি দেওয়া হতো, এখন খাদ্যে ভেজালকারি মানুষকেও গণপিটুনি দিতে হবে। এরা দানব হয়ে গেছে। তাদেরকে এ পথ থেকে না ফেরালে জাতি হিসেবে আমরা পঙ্গু হয়ে যাবো।
এর আগে, বিশ্বিদ্যালয় শিক্ষকদের দলবাজি, সুবিধা হাতানোসহ কিছু দুঃখজনক কাণ্ডকীর্তির সমালোচনা করেছিলেন রাষ্ট্রপতি। এরও আগে গত সপ্তায় রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন, সিন্ডিকেটবাজদের সম্পর্কে। বাজারের চলমান অস্থির দশার জন্য জনগণকে কিছুটা দায়ী করে বলেছিলেন, বিভিন্ন সেক্টর নিজস্ব স্বার্থে সিন্ডিকেট করছে। কিন্তু, জনগণের সিন্ডিকেট নেই। থাকলে জনগণ প্রয়োজনে একমাস পেঁয়াজ না খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে মজুতদাররা জনগণকে ‘বাপ’ ডাকতো। কম দামে পেঁয়াজ ছাড়তে বাধ্য হতো।
কালোবাজিরি বা বাজার সিন্ডিকেট নিয়ে সরকারকে, ক্ষমতাসীন ঘরানার লোকদের দায়ী করার ঘটনা নতুন নয়। রাষ্ট্রপতি মজা করে বললেও এ কথাতো দিবালোকের মতো স্পষ্ট জনগণের মধ্যে ঐক্য বা সিন্ডিকেট না থাকার কুফল সব চেয়ে বেশি ভুগছে জনগণই। তার কথা স্পর্শকাতর মহলগুলোতে সমাদৃত হয়েছে। কিন্তু দলের ভেতর কারো কারো কাছে দাঁড়িয়েছে ভিন্ন অর্থ। যুক্তিও ভিন্ন তাদের। তাদের মতে, জনতার সিন্ডিকেট থাকলে কেবল পেঁয়াজ, চাল, লবণ নয়-আরো অনেক সিন্ডিকেটই খান খান হয়ে যেত। চলমান রাজনীতি, দলবাজি, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা, একতরফা নির্বাচন এমন কি ক্ষমতার চেহারাও পাল্টে যেত। সেটা না থাকাতেই এখন সবকিছুতে কালো হাতের থাবা। এখন পর্যন্ত বাকি রয়েছে কেবল কচুটাই। তা-ও হয় তো সেটা শূকরের খাদ্য বলেই।
কচু কেন শূয়রের খাস পছন্দের খাদ্য-তা নিয়ে বহু কথা এবং প্রবাদ-প্রবচন রয়েছে। এগুলো ভেজালবাজদের মনে দাগ কাটতে পারবে কি-না, কে জানে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে কচুর লতি। জয়দেবপুর, টাঙ্গাইল, সিলেট, কুমিল্লা, রাজশাহী, খুলনার কচু ও লতি গত ক’বছর ধরে গ্রেট ব্রিটেন, আমেরিকা, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, ওমান, বাহরাইন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরে বাজারজাত করা হচ্ছে। এখনও এগুলোতে সেইভাবে শুকুনের চোখ পড়েনি। ফরমালিন বা ভেজালও মেশেনি। রাষ্ট্রের মা=হামান্যের কাছেও রয়েছে সেই তথ্য। বাকিটা এখন ভেজালরাজ্যের দানবদের মর্জি।
শিশুখাদ্য-পশুখাদ্য, রোগীর পথ্যে ভেজাল মেশানোতে যাদের বিবেক বাধে না, শূকরের দোষে যদি তাদের মনে কোনো রহম হয়! যদি শূকরের খাদ্য কচুতে পবিত্র বদন খানি দিতে শরম পায়! রাস্তার পাশে, বাড়ির আনাচেকানাচে, বিভিন্ন পতিত জমিতে অনাদরে-অবহেলায় জন্ম নেয়া বেজন্মা কচুতেও মুখ দিলে কে রুখবে তাদের? জাতের কচুতে কথাই নেই।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/জেআইএম