চালকের যাবজ্জীবন রাস্তায় আর চাই না মরণ
শহিদ রমিজ উদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আব্দুল করিম রাজীব ( ১৭) ও একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দিয়া খানম মিম (১৬) জাবালে নূর পরিবহনে পিষ্ট হয়ে নিহত হয়। নিহতের ঘটনায় জাবালে নূর পরিবহনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। সেই মামলার রায় হয়েছে গত ১ ডিসেম্বর ২০১৯। মামলার রায়ে জাবালে নূর পরিবহনের দুই চালকসহ তিনজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
কোন অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় জাবালে নূর পরিবহনের মালিক জাহাঙ্গীর আলম ও হেলপার এনায়েতকে খালাস দেন আদালত। রবিবার ১ ডিসেম্বর ২০১৯,ঢাকা মহানগর দায়রা জজ ইমরুল কায়েস এ ঘোষণা দেন। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পাশাপাশি ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ছয়মাসের কারাদণ্ডের আদেশ জারি করেন আদালত। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামীরা হলেন দুই চালক মাসুম বিল্লাহ, জুবায়ের সুমন এবং তাদের সহকারী কাজী আসাদ।
গত ১৪ নভেম্বর রাষ্ট্র ও আসামীপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণার জন্য ঢাকা মহানগর দায়রা জজ ১ ডিসেম্বর দিন ধার্য করেন। মামলাটিতে মোট ৪১ জন সাক্ষীর মধ্যে মোট ৩৭ জন সাক্ষ্য দেয়। মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায় ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকায় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে জাবালে নূর পরিবহনের রেষারেষিতে বাসচাপায় নিহত হন রাজীব ও মিম। ঘটনার দিনই নিহত মিমের বাবা জাহাঙ্গীর আলম বাদী হয়ে ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলা করেন। অভিযোগপত্রে বলা হয় ঘটনার দিন দুপুরে চালক ও তাদের সহকারীরা বেশি লোক উঠানোর জন্য যাত্রীদের কথা না শুনে এবং তাদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা না করে জিল্লুর রহমান উড়াল সড়কের ঢালের সামনে রাস্তা ব্লক করে দাঁড়ান। এ সময় আরেকটি বাসের চালক মাসুম বিল্লাহ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শহিদ রমিজ উদ্দীন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের ১৪-১৫ জন শিক্ষার্থীর উপর গাড়িটি তুলে দেন।
ঘটনাস্থলেই দুই শিক্ষার্থী মারা যান।এ দুর্ঘটনায় আহত হন ৯ জন। এ ঘটনার জন্য মামলায় আসামি করা হয় ছয়জনকে। তাদের মধ্যে জাবালে নূর পরিনহনের মালিক জাহাঙ্গীর আলম, দুই চালক মাসুম বিল্লাহ ও জুবায়ের সুমন এবং সহকারী এনায়েত হোসেন এখন কারাগারে। জানা যায়, জাবালে নূর পরিবহনের আর এক মালিক শাহাদাত হোসেন জামিনে রয়েছেন। তারপক্ষে মামলা উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে। চালকের সহকারী কাজী আসাদ এখনও পলাতক।
রাজীব-দিয়ার নির্মম মৃত্যুর প্রতিবাদে ঢাকাস্থ সকল স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রী রাস্তায় নেমে আসেন। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা মিছিল, মিটিং ও বিক্ষোভ করেন। ঢাকা শহরের প্রধান প্রধান সড়কগুলো অবরোধ করেন তারা। এমনকি কীভাবে সড়কের শৃঙ্খলা ফেরাতে হয় সেটিও দেখিয়ে দেন তারা। ঐ সময় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অন্যতম দাবিগুলোর মধ্যে ছিল দুই শিক্ষার্থীকে হত্যার দায়ে বেপরোয়া চালকের ফাঁসি, সড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলতে না দেওয়া, শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া এবং নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা।
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাসকৃত সড়ক পরিবহন আইনে উল্লেখ করা হয় ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে প্রাণহানি ঘটালে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়। এছাড়া কোন ব্যক্তির বেপরোয়া ও অবহেলাজনিত গাড়ি চালানোর কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে এবং সেই দুর্ঘটনায় কেউ আহত বা নিহত হলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড, পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ডের বিধান রয়েছে।
এক বছরের বেশি সময় আগে সংসদে পাস হওয়া নতুন সড়ক আইন গত ১৭ নভেম্বর ২০১৯ থেকে কার্যকর করা শুরু হলে এই সড়ক আইনের ১২৬টির মধ্যে ৯ টিতে শ্রমিকদের আপত্তি ছিল। বিআরটিএ (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থা) আইনটি প্রয়োগ শুরু করলে এ আইন বাতিলের দাবিতে ঢাকাসহ সারাদেশে শুরু হয় পরিবহন ধর্মঘট। টানা দুইদিন দেশের ৩৩ টি জেলায় কোনপ্রকার যানবাহন চলতে দেয়া হয়নি। ঢাকা থেকে দেশের প্রতিটি জেলায় যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে বিপাকে পড়ে সাধারণ মানুষ ও পিইসি পরীক্ষার্থীরা।
যে কোনো ধরনের পরিবহন বন্ধ থাকায় তা ঢাকায় সরবরাহ করতে না পারায় সবধরনের তরিতরকারি ও সবজির দামও কয়েকগুণ বেড়ে যায়, যার ফলে নানারকম দুর্ভোগ পোহাতে হয় সাধারণ মানুষের। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে চিন্তা করলে সড়কে বিশৃঙ্খলা রোধ করতে সড়ক আইন ও তার যথাযথ প্রয়োগের বিকল্প নেই। সড়ক আইন না মেনে নৈরাজ্য সৃষ্টি করলে সড়কের নিরাপত্তার বিষয়টিতে প্রশ্ন থেকে যায়। তাই নতুন আইনের প্রতি শ্রমিক, মালিক ও জনগণের আস্থা রেখে চলতে হবে। তবেই সড়ক দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
শহিদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীকে রেষারেষির জের ধরে বাসচাপা দিয়ে মারার অপরাধে গত ১ ডিসেম্বর ২০১৯ মামলার রায়ে প্রমাণিত হলো সড়কে ইচ্ছেমতো গাড়ি চালালে এবং তাতে মানুষ মৃত্যুর ঘটনা ঘটলে তারা কেউই আইনের আওতা থেকে পার পাবে না। এ বিচার সড়ক আইনে আরও একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। একের পর এক সুবিচার সাধারণ মানুষের আইনের প্রতি আস্থা বাড়িয়ে তুলছে।
অন্যায় ও বিশৃঙ্খলভাবে গাড়ি চালালে তার খেসারত দিতে হতে পারে আজীবন। তাই সড়কে সচেতন ভাবে এবং আইন মেনে গাড়ি চালাতে হবে চালককে এবং জনগণকেও সড়ক আইন বুঝে চলতে হবে। মনে রাখতে হবে জীবনের আগে জীবিকা নয়, তাই ধৈর্যের সাথে সকলকে পথ চলতে হবে। সকলেই যদি সড়ক ও আইন মেনে চলে এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারে তাহলেই প্রতিদিনের অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পাবে মানুষের জীবন।
লেখক : কবি ও শিক্ষক।
এইচআর/জেআইএম