পরশের ছোঁয়ায় হোক যুবলীগের নতুন যাত্রা
কোনো রাজনৈতিক দল টানা ক্ষমতায় থাকলে তার এবং তার অঙ্গ সংগঠনগুলোর ঘুণে ধরা অবস্থা হয়। আমরা আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারতীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন বামজোট ক্ষমতায় থাকার করুণ পরিণতি দেখেছি। সাধারণ মানুষ থানায় মামলা করতে গেলেও বাম জোটের স্থানীয় ক্যাডারদেরকে টাকা দিতে হতো। না হয় থানায় মামলা নিত না।
মহল্লায় মহল্লায় কোনো গৃহস্থ তাদের ঘরবাড়ি তৈরি করতে গেলেও সিপিএমের ক্যাডারদেরকে মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হতো। কোনো ঠিকাদার কোনো কাজ করতে গেলে ইট, কাঠ, রড, সিমেন্ট সাপ্লাই করতো সিপিএমের স্থানীয় ক্যাডাররা। বিয়েতে পর্যন্ত নাকি টাকা দিতে হতো। জ্যোতি বসুরা এ সমস্ত ব্যাপারে বেখেয়াল ছিলেন। যার কারণে বামেরা তুলে মূলে উচ্ছেদ হয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গ থেকে। পশ্চিমবঙ্গের দিকে নজর পড়েছে এখন কেন্দ্রের সাম্প্রদায়িক হায়নাদের।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২০০৯ সাল থেকে টানা ক্ষমতায়। চাঁদাবাজির সেই সংস্কৃতি বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবস্থা টের পেয়ে শুদ্ধি অভিযানের এক ব্যাপক আয়োজন করেছেন। এখন পর্যন্ত অন্য কারো প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে নিজের দল এবং নিজের দলের অঙ্গসংগঠন গুলোতেই শুদ্ধি অভিযান সীমাবদ্ধ রেখেছেন। অনেককে গ্রেফতার করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই কড়া ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন রয়েছে এবং সাধারণ মানুষ চায় যে শুদ্ধি অভিযান দীর্ঘায়িত হোক।
পত্রিকার পাতায় ছাত্রলীগের নানা নেতিবাচক সংবাদ আসতো। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যুবলীগই সবচেয়ে বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। ক্যাসিনোকাণ্ড, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে যুবলীগ একটি মহাআতঙ্ক হিসেবে দেখা দিয়েছে। সমগ্র ঢাকা শহরটা ছিল তাদের ‘পুদিনা ক্ষেত’। যখন যেখানে ইচ্ছা সেখানে দিয়েছে সেখান থেকে টাকা এনেছে। টাকা না দিতে চাইলে এলাকায় এলাকায় প্রতিষ্ঠিত টর্চার সেলে এনে উপযুক্তভাবে শায়েস্তা করেছে। এই ব্যবস্থা তাদের প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব প্রশাসনিক ব্যবস্থা।
সম্রাট নাকি আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের কাছে ২০ কোটি টাকা চাঁদা চেয়েছিল। সেটিই কাল হয়েছে তার। প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার গেছে। আর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় প্রেসিডেন্ট- সেক্রেটারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে উন্নয়নের জন্য প্রদত্ত টাকার পাঁচ শতাংশ চাঁদা দাবি করেছিল। সেটিও গেছে প্রধানমন্ত্রীর কানে। রাজনৈতিক দলগুলো অঙ্গসংগঠন তৈরি করে সুশৃঙ্খলভাবে স্তরে স্তরে নেতাকর্মী তৈরি করে মূল সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য, যেন জাতিকে সুন্দর অভ্রান্ত নেতৃত্ব দেওয়া যায়। তাদের আচরণ যদি এই হয় তবে জাতি তো ডাকাতদের কবলে পড়ে বিপর্যস্থ হয়ে যাবে।
তাই হতে যাচ্ছিল। ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রীকে। তিনি সব অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতৃত্বে পুনর্বিন্যাসের ব্যবস্থা করে জাতিকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করার উদ্যোগ নিয়েছেন। বিপ্লব ঘটতে আড়ম্বর লাগেনা। দৃঢ় হস্তে সবকিছু পরিচালনা করে নীরব বিপ্লব করা যায়। আমরা আশা করি সব জঞ্জাল পরিষ্কার করে প্রধানমন্ত্রী একটি সাংগঠনিক বিপ্লব আনবেন এবং তার অব্যাহত পাহারার ব্যবস্থা করবেন।
কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগে সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক পদে নতুন মুখ দেওয়া হয়েছে। একই ধারাবাহিকতায় যুবলীগেও নতুন সভাপতি (চেয়ারম্যান) এবং সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করা হয়েছে। অঙ্গ সংগঠনগুলোর সম্মেলনের ধারাবাহিকতায় গত ২৩ নভেম্বর ঢাকায় সর্বশেষ যুবলীগের সম্মেলন হল। যুবলীগের অস্থিত্ব পাকিস্তানের সময়ও ছিল। আবার পাকিস্তান আমলেই যুবলীগের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে গিয়েছিল। অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোহারা এক সময় যুবলীগের নেতৃত্বে ছিলেন। তখন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। যুবলীগ ছিল বাম ঘরানার লোক দ্বারা পরিচালিত সংগঠন। যুবলীগের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক কিরূপ ছিল তা আমার জানা নেই।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর পরামর্শে শেখ ফজলুল হক মনি ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর পুনরায় যুবলীগ গঠন করেন ‘বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ’ নামে। তিনি দেশব্যাপী সংগঠনটি গড়ে তুলেছিলেন। দুই বছরের মাথায় কংগ্রেসে শেখ মনিই যুবলীগের প্রথম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে শেখ মনি নিহত হওয়ার পর ১৯৭৮ সালে যুবলীগের পুনর্জাগরণে সংগঠনটির চেয়ারম্যান হন আমির হোসেন আমু। এরপর তৃতীয় কংগ্রেসে মোস্তফা মহসিন মন্টু, চতুর্থ কংগ্রেসে শেখ ফজলুল করিম সেলিম, পঞ্চম কংগ্রেসে জাহাঙ্গীর কবির নানক যুবলীগের চেয়ারম্যান হন।
২০১২ সালে ষষ্ঠ কংগ্রেসে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান ওমর ফারুক। সংগঠনটি যে উদ্দেশ্যে গঠন করা হয়েছিল, শেখ ফজলুল হক মনির পরে তার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি। ভ্রান্ত নেতৃত্বের কারণে যুবলীগ লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। আর ওমর ফারুক চৌধুরী ও সম্রাটদের কবলে পড়ে সংগঠনটির অবস্থা করুণ হয়েছে। এর আগেও যুবলীগের আরেক আলোচিত চেয়ারম্যান মোস্তফা মহসিন মন্টুকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল সন্ত্রাসের অভিযোগে।
এবারের সম্মেলনে শেখ ফজলুল হক মনির জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ ফজলে শামস পরশকে চেয়ারম্যান করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছেন মাইনুল হোসেন খান নিখিল। পঞ্চাশোর্ধ্ব পরশ কখনও রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। লেখাপড়া করেছেন, উচ্চ ডিগ্রি নিয়েছেন তারপর গত ১৭ বছর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন। রাজনীতিতে যোগদান করেই বিধ্বস্ত যুবলীগের পুনঃগঠনের দায়িত্ব পেয়েছেন পরশ।
রাজনীতি বিমুখ তরুণ প্রজন্মকে পরশ রাজনীতিতে যুক্ত করতে চান। আমরা তাকে অভিনন্দন জানাই এবং তার সফলতা কামনা করি। শিক্ষক মানুষ সাধারণত সহজ সরল হয়। তিনিও হয়তো এমনই হবেন। আমরা অধ্যাপক সাহেবকে অনুরোধ করব তিনি যেন সব সময় সচেতন থাকেন কারণ দুষ্ট লোকের অভাব নেই। তার হাতে কল্কি রেখে গাজা টানার চেষ্টা করা লোক তার পেছনে এখন থেকেই সারিবদ্ধ হবে।
প্রধানমন্ত্রী তাকে অগ্নিপরীক্ষায় ফেলেছেন। ইঞ্জিন বদলালেই সব হয় না। তার সঙ্গে সঙ্গে বগিও বদলাতে হবে। না হলে যাত্রা নিরাপদ হবে নিশ্চয়তা নেই। বগি বদলানোর কাজটি পরশকেই করতে হবে। দলের মধ্য থেকে সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজদের বের করতে হবে। ক্লিন ইমেজের যুবকদের আনতে হবে নেতৃত্বে। বলা হয়ে থাকে পরশ পাথরের স্পর্শে সীসা ইত্যাদি ধাতু সোনা অথবা রূপায় পরিণত হয়। পরশের স্পর্শে এসে যুবলীগের নেতা কর্মীরা সোনা-রূপা হয়ে উঠুক। দেশের কল্যাণে আসুক। আশা করি তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবেন।
প্রধানমন্ত্রী একবার ঢাকার ট্যানারি মাঠে পরশের ছোট ভাই শেখ ফজলে নূর তাপসের নির্বাচনী সভায় বলেছিলেন, পরশ আর তাপসকে নাকি ঘাতকদের হাত থেকে রক্ষা করেছিল শেখ মণিদের কাজের মেয়ে। ঘাতকদের বলেছিলেন তারা তার সন্তান। না হয় ১৫ অগাস্টের কাল রাত্রিতে বাবা-মার সঙ্গে তাদেরও মৃত্যু হতো। পরশ সাহেবকে বলব আপনারা ভাগ্যের ফেরে ঘাতকদের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছেন। অবশিষ্ট জীবনটা মহৎ কাজে ব্যয় করুন।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]
এইচআর/জেআইএম