‘মানুষ ছাড়া খ্যাপারে তুই মূল হারাবি’
দেশ নির্বিশেষে বিশেষভাবে আমাদের দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধি ও সংকটের ব্যাপারে মানুষ খুবই স্পর্শকাতর এবং তা রাজনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। নিন্মবিত্ত গরীব মেহনতী মানুষের খাদ্য সংকট ও মূল্যবৃদ্ধিতে সরাসরি আঘাত করে এবং দিশেহারা হয়ে পড়ে। মধ্যবিত্তরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাদের দুশ্চিন্তা বাড়ে। ধনী ও উচ্চবিত্তদের সরাসরি আঘাত না করলেও মানসিকভাবে তাদেরও প্রতিক্রিয়া হয়। সার্বিকভাবে পাগলা ঘোড়ার মতো খাদ্য সংকট ও মূল্যবৃদ্ধিতে শ্রেণী-পেশা নির্বিশে মানুষ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। উৎপাদনে ঘাটতি থাকা বা উৎপাদন কোনো প্রাকৃতিক কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পণ্যের ঘাটতি হলে মানুষ যতটা ক্ষুব্ধ হয়, তা প্রচণ্ডভাবে বেড়ে যায় যদি এর সাথে অসৎ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কোনো সংযোগ আর সেই সাথে ঘাটতি মোকাবিলায় সরকারের আগাম আমদানী পরিকল্পনায় বা ব্যবস্থাপনার কোনো সমস্যা থাকে। বলাই বাহুল্য এই ক্ষুব্ধতা হয় সরকারের ওপর এবং তা রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়।
এটা সাধারণভাবে সকলের জানা এবং পূর্বেও এই কলামেও বলা হয়েছে যে, রাজনৈতিক সংকট আসে দৈনন্দিন জীবনের অর্থনৈতিক সংকটের পিছু পিছু। প্রসঙ্গত রাজনৈতিক সংকট যদি সুপ্ত বা ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে আর অর্থনৈতিক সংকট দানা বেধে ওঠে; তবে তা রাজনৈতিক সংকটকে জাগ্রত করতে পারে। তখন এক সংকট আরেক সংকটের সাথে মিলে দেশকে অশান্ত-অস্থির-অরাজক করে তোলার সম্ভাবনা যোগায়। আমরা যদি আমাদের অতীত ইতিহাসের দিকে তাকাই তবে দেখতে পাব, কিভাবে আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসকে জনজীবনের অর্থনৈতিক সংকট আবার উল্টোদিকে অর্থনৈতিক সংকট রাটজনীতিকে প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিতম করে বিভিন্ন মোড় পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে।
আগস্ট ’৪৭-এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পরই ভাষা, নির্বাচন, জাতীয় স্বাধীকার ও শাসনতন্ত্র নিয়ে রাজনৈতিক সংকট গভীরতর হয়। এরই মধ্যে খাদ্য সংকট ক্রমেই বাড়তে থাকে। এরই প্রতিক্রিয়ায় ‘সাধের পাকিস্তান’ প্রতিষ্ঠার দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে মুসলিম লীগের অভ্যন্তর থেকেই বিরোধী দল হিসাবে মাওলানা ভাসানী, শামসুল হক ও শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। দলটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পরই যে ইস্যু সামনে আসে তা হলো খাদ্য সংকট ও মূল্যবৃদ্ধি। মাত্র ৪ মাস পর নব প্রতিষ্ঠিত এই দলের উদ্যোগে আরমানিটোলা ময়দান থেকে গভর্নর হাউস অভিমুখে ভুখা মিছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সংঘটিত হয়। ওই মিছিলের পর পরই প্রথমে গ্রেপ্তার হন মাওলানা ভাসানী এবং শেখ মুজিবুর রহমান। ওই যে গণআন্দোলন শুরু হয়েছিল তা আর শেষ হয় না। ধারাবাহিকভাবে জোয়ার-ভাটার মধ্য দিয়ে চলতে থাকে। কেননা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুই সংকটই ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে ছিল। বায়ন্নর ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন ও ষাটের দশকের গণজাগরণে উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে তাই চাল-লবণ-তেল প্রভৃতির লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি ও খাদ্য সংকট যেমন, তেমনি পাটসহ কৃষিজ দ্রব্যের মূল্য হ্রাস ভূমিকা রেখেছে।
‘আমরা বাঙালি ভূট্টা খাই না’ কিংবা ‘কেউ খাবে তো কেউ খাবে না/তা হবে না তা হবে না’ স্লোগান এমনি এমনি জনপ্রিয় হয় নাই। ৬ দফা-১১ দফাকে মানুষ মুক্তি সনদ বা প্রাণের দাবি মনে করেছে পেটে ভাত ছিল না বলেই। সর্বোপরি দিন আনা দিন খাওয়া কিংবা না খাওয়া গরীব ও মেহনতি মানুষ ঢাকা শহরে গভীর রাতে কারফিউ ভেঙে সেনা-পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে দিয়েছে তীব্র অর্থ সংকটের কারণেই। দৈনন্দিন অর্থ সংকট তথা অন্ন-বস্ত্র-চিকিৎসা-বাসস্থান-কাজ তথা জনজীবনের মৌলিক প্রাপ্তি বা অধিকার নিশ্চিত ছিল না বলেই স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘এ স্বাধীনতা আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না খায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এ দেশের মানুষ যারা আমার যুবক শ্রেণী তারা চাকুরি না পায় বা কাজ না পায়।’ বঙ্গবন্ধুর এই উক্তিটি এখনও প্রাসঙ্গিক বলেই শাসক দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮-এর শুরুতেই তা স্থান পেয়েছে।
উল্লিখিত আলোচনা থেকে এটা সুস্পষ্ট, পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক আমলে রাজনৈতিক সংকটের সাথে জনজীবনের দৈনন্দিন অর্থনৈতিক সংকট মানুষের মনে যে হতাশা ও ক্ষুব্ধতা জাগ্রত হয়েছিল, তাতে বাঙালি জাতি লাভবান হয়েছিল। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে ছিনিয়ে এনেছিল হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা। কিন্তু স্বাধীনতার পর জনজীবনের সেই খাদ্য সংকট ও লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিই পরিণামে তীব্র হতাশা ও ক্ষুব্ধতা সৃষ্টি করে রাজনৈতিক সংকটকে গভীরতর করেছিল। ‘চাটার দল’, ‘রাতের বাহিনী’-র সাথে উগ্র বাম-ডান শক্তি গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে পরিস্থিতিকে অশান্ত অস্থির ও অরাজক করে তুলেছিল। যার পরিণতিতে জাতি সংসদীয় গণতন্ত্রে থাকতে পারেনি, একদল বাকশাল হয়েছিল। পরিণামে জাতির পিতা ও জাতীয় চার নেতাকে আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি। ক্ষমতার রাজনীতির পটপরিবর্তনের মাধ্যমে পাকিস্তানি তথা সাম্প্রদায়িক প্রত্যক্ষ পরোক্ষ সামরিক শাসনের ধারা ফিরে এসেছিল।
অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে অতীতের দিকে তাকাই তবে দেখতে পাবো, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে খাদ্য ঘাটতি ও সংকট আর সেই সাথে অবকাঠামো না থাকা ও সার্বিক অর্থনৈতিক সংকট থাকা সত্ত্বেও ১৯৭১ ও ’৭২ এই দুই বছর বঙ্গবন্ধুর সরকার সবটা সামালই কেবল দেয় নাই, রাজনৈতিক সংকট সমাধানে দেশের ইতিহাসে প্রথম সংসদীয় গণতন্ত্র ও চারনীতি সংবলিত সংবিধান দিয়ে রাজনৈতিক সংকট সমাধান করতে প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু অবাধ গণতন্ত্র দিয়ে রাজনৈতিক সংকট সমাধান করতে গেলে দেশি-বিদেশি পরাজিত শক্তি ও কায়েমী স্বার্থবাদীরা গণতন্ত্রকে ব্যবহার করেই নতুন ধরনের রাজনৈতিক সংকটের আমদানি করেছিল। সরকারবিরোধীদের থানা-ফাড়ি লুটসহ হত্যা-খুন-অগ্নিসংযোগ বিভিন্ন ধরনের নাশকতামূলক কাজ আর সেই সাথে প্রশাসন ও সরকারি দলের চাটারদলদের কম্বল চুরি, রেশন চুরি, মজুতদারি-মুনাফাখোরি-কালোবাজারি আর আমদানির লাইসেন্স বিক্রি প্রভৃতি অপকর্ম-দুষ্কর্ম অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সংকটকে একসাথে করে পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পটভূমি সৃষ্টি করেছিল।
প্রসঙ্গত যতটুকু মনে পড়ছে, বঙ্গবন্ধুর সরকার সাংবিধানিক স্থিতিশীলতার আগেই ১৯৭৩ সালের শেষ দিকে প্রথম কৃত্রিমভাবে সংকট সৃষ্টি করা হয় লবন নিয়ে। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিতে জড়িয়ে পড়ে প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দল। ১৯৭৪ সালে প্রথম দিকে লবণ সংকট এতটাই মারাত্মক হয় যে, মূল্য কোনে কোনো এলাকায় প্রতি সের ৫০/৬০ টাকা কিংবা প্রাপ্তি দুরূহ হয়ে ওঠে। শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু লবণ সংকট সমাধানে তৎপর হয়ে ওঠেন। তখন জানা যায় পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য লবণ মওজুদ রয়েছে চট্টগ্রামে। রেল ওয়াগনের কারণে তা বাজারে আসা সম্ভব হচ্ছে না। বঙ্গবন্ধু সেই সমস্যার সমাধান করেন। কিন্তু ইতোমধ্যে যা বিরূপ প্রতিক্রিয়া জনগণের মধ্যে হবার তা হয়ে যায়। জনগণের এই মনোভাবের প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি রাজনীতির অঙ্গনে প্রকাশ্যে বের হয়ে পড়ে এবং তারা উগ্রবামের মধ্যে নিজেদের স্থান করে নেয়। তখন প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দলের উঠতি পড়তির মধ্যে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু জাতির চরম দুর্ভাগ্য! তখনই আঘাত হানে প্রকৃতি, চুয়াত্তরের সর্বগ্রাসী বন্যা ও ফসলহানী পরিস্থিতিকে বেসামাল করে তোলে।
এরই সুযোগ নেয় দেশি-বিদেশি পরাজিত শক্তি ও জাতিবিরোধী কায়েমী স্বার্থবাদী মহল। রাজনৈতিক সংকট গভীরতর করতে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে খাদ্য নিয়ে। প্রসঙ্গত বলতেই হয়, তখন ভারতেও খাদ্য সংকট ও বিশ্ব বাজারে মূল্য বৃদ্ধি চলছিল আর সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষেও এতটা ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হচ্ছিল না। দেশে ছিল বিদেশি মূদ্রা সংকট। যতটুকু জানা যায়, তবুও পরিস্থিতি মোকাবেলায় মার্কিন যুক্তরষ্ট্রের বাজার থেকে খাদ্য কেনা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাতিল করায় তা আর আসে না। এদিকে আমেরিকা পিএল-৪৮০ অধীনে খাদ্য আসা বন্ধ করে বা খাদ্য জাহাজ অন্যত্র সরিয়ে নেয় কিউবাতে পাট রপ্তানির কারণে। সংকট আরো গভীর করার জন্য বঙ্গোপসাগরে চাল ফেলে দেওয়া হয়েছিল বলেও তখন নানা সূত্র থেকে জানা যায়।
নিতান্ত অন্ধ ও উদ্দেশ্যবাদীরা ছাড়া এটা বোধকরি এখন সকলেই স্বীকার করবেন যে, তখন মানুষ বাঁচানোর জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা সম্ভব হয় নাই। এই সময়েও চলতে থাকে মজুতদারি-মুনাফাখোরি-চোরাচালিন অপতৎপরতা এবং প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য, সরকারের ভেতর ও বাইরে থেকে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির নানামুখী অপতৎপরতা। বন্যার আগে আগে সূর্যসেন হলে সেভেন মার্ডারের আসামীকে গ্রেপ্তার ও চার্জশিট দেওয়া, তৎকালীন সাংসদ মমতাজ বেগমকে চোরাচালানের দায়ে গ্রেপ্তার করার পর দলীয় চাপে ছেড়ে দেওয়া এবং প্রশাসনে দুর্নীতিবাজদের ছাটাই করার পটভূমিতে প্রশাসন ও সরকারি দলে নানামুখি প্রতিক্রিয়া চলছিল। বন্যার পর দেশ যখন চরম খাদ্য সংকটে তখনও সরকারি প্রশাসন ও দলের চাটারদলদের অপতৎপরতা থামে না।
এখন খবর ঘেটে জানা যায়, সেপ্টেম্বর ’৭৪-এর প্রথম সপ্তাহে ২০৪ মণ লবণ উদ্ধার ও চার জন গ্রেপ্তারের খবর। কি করেছিল প্রশাসন ও সরকারি দলের লোভী ও স্বার্থপররা, তা ওই প্রজন্মের কারোই অজানা নয়। উল্টোদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়িতে জাসদের সশস্ত্র আক্রমণ, পুলিশের গুলিতে মৃত্যু ও গ্রেপ্তারের পটভূমিতে জাসদ ও ভাসানী ন্যাপের বাড়াবাড়ি তখনও চলছিল। গণবাহিনী, রাতের বাহিনী, শান্তি বাহিনী, সুপ্ত রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের বিভিন্ন পরিচয়ে উত্থান প্রভৃতি তো ছিলই। বস্তুতপক্ষে এইসব অনভিপ্রেত ও চরম ক্ষতিকর ঘটনা প্রবাহের ভেতর দিয়েই আমাদের জাতির বিয়োগান্তক ও করুণ ইতিহাস রচিত হয়েছে। এইজন্য দায়ী কি জাতি হিসাবে আমরা সবাই নই, আমাদের প্রজন্ম নয়! এখন আমরা কথায় কথায় বলি এই জন্যই কি স্বাধীনতা চেয়েছিলাম, মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম? সবচেয়ে আগ্রহউদ্দীপক বিষয় হচ্ছে, আমাদের প্রজন্মের সরকারি দল কিংবা বিরোধী দলের অনেকেই এখন অনেক কথা বলে, উপদেশ দেয় কিন্তু অতীতের আয়নায় নিজের দিকে তাকায় না।
বর্তমান দিনগুলোতে যখন ক্যাসিনো কাণ্ড প্রকাশ পায়, পেঁয়াজের দাম পাগলা ঘোড়ার মতো বাড়ে, মজুত থাকা সত্ত্বেও হঠাৎই চালের বাজার অস্থিতিশীল হয়, সবসময় সব সম্ভব হবে এটা হয় না। কৃষক যখন ফসলের ন্যায্য দাম পায় না; তখন ওই সব দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। বিগত ১৭ নভেম্বর ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’-এ দুটো হেডিং ‘সবখানে সিন্ডিকেট’ ও ‘চারদিকে ষড়যন্ত্রের গন্ধ’ সংবাদ পাশাপাশি পড়লাম। ঘরপোড়া গরু এখন সিঁদুর দেখলে ভয় পাচ্ছে। সেখানের লেখা হয়েছে, ‘বাজার অস্থিতিশীল করতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে মূল্য বৃদ্ধি করা হচ্ছে। ছোটখাট ঘটনায় বড় বড় প্রতিক্রিয়া দেখানোও ষড়যন্ত্রের অংশ বলে মনে করেন অনেকে। বিরোধী রাজনৈতিক দল ও জোটের পাশাপাশি আর্থিক খাতের দুর্নীতিবাজরাও এসব ষড়যন্ত্রে ইন্ধন জোগাচ্ছে বলে অভিযোগ আছে।’
পাঠকরা স্মরণ করুন, ’৭৪-এর লবণসহ খাদ্য নিয়ে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি, বাসন্তীকে জাল পড়ানোর ছবি প্রকাশ আর চাটার দলদের কথা। তখনও মানুষ যেমন প্রশাসন ও সরকারি দলের ‘চোর-চোট্টা-বদতমাইশ’-দের কথা, রাতের বাহিনীসহ অন্যান্য অশুভ বাহিনীর ইন্ধনদাতা কে বা কারা মানুষ আড্ডা-গালপল্পের মধ্যে বলতো, এখনও বলে। মোস্তাক গংদের কর্মকাণ্ড কার না জানা ছিল! কিন্তু তার গায়ে কি টোকাটা পড়েছিল! কেন পড়ে নাই, কোন্ ভারসাম্যের নীতি তখন কাজ করেছিল, সেসব প্রশ্নের উত্তর জানা যায় না।
বর্তমান দিনগুলোতে মানুষ আড্ডা ও গালগল্পের মধ্যে সরকারের ক্যাসিনোবিরোধী অ্যাকশনের প্রশংসা করছে। সরকারি দলের সহযোগী সংগঠনের সম্মেলনে যখন দাগী নেতারা বাদ পড়ছে, তখন আনন্দিত হচ্ছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কোন্ দিকে যায়, সেজন্য শংকা ও ভয়ে তেমন সরব হতে পারছে না। এর মধ্যে রাজনৈতিক সংকট তথা ভোট সংসদ ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কখনও কখনও জনজীবনে অর্থ সংকট ও অর্থনৈতিক কেলেংকারি-দুর্নীতি হচ্ছে। আসলে মানুষ সব জানতে ও বুঝতে পারছে না। এমনকি সরকারি দলের সহযোগী সংগঠনগুলোর সম্মেলনে আগত কাউন্সিররা পর্যন্ত বুঝতে পারছেন না কারা হবেন তাদের নেতা। আগপিছ সব যদি মানুষ বা দলীয় নেতা-কর্মীরা না বুঝে তবে কি কখনও উৎসাহিত হয়? প্রসঙ্গত, আমরা যদি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি আর সেই সাথে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির ক্ষমতার পটপরিবর্তনের দিকে লক্ষ্য করি, তবে এটা সুস্পষ্টভাবে পরিদৃষ্ট হবে জনগণ ছাড়া কখনও প্রথম পক্ষ এবং ষড়যন্ত্র-হত্যা-ক্যু ছাড়া দ্বিতীয় পক্ষ কখনও জয়ী হতে পারে নাই।
জনগণকে অন্ধকারে রেখে কাজ করে অন্ধকারের শক্তি আর জনগণকে সাথে নিয়ে কাজ করে আলোর শক্তি। আলো আর অন্ধকারের তফাৎ এখানেই। মানুষ জাতীয় দৈনিক সক্রিয়তার মধ্যে আছে তো সব আছে। মানুষ নাই তো কেউ নাই। মহান বাউল লালনের ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি, মানুষ ছাড়া খ্যাপারে তুই মূল হারাবি’ গানটি রাজনীতিতে স্বতঃসিদ্ধ। যতই লেখা বা বলা হোক মানুষ রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচ, ভারসাম্য, সংকট ইত্যাদি কিছু বুঝতে চায় না। সময় বিশেষে সোজাসাপ্টা রাজনীতি বুঝতে চায়। কলামটা লেখার সময়ে বিশ্বখ্যাত সাংবাদিক অ্যান্থনী ম্যাসকার্নহাস- এর ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ‘রক্তের ঋণ’ বইটা দেখছিলাম। সেই বইয়ের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, “মুজিব মৃত্যুর দশ বছর পরেও আত্মীয় পরিজনদের মতানৈক্যের জন্যে টুঙ্গীপাড়ায় মুজিবের সমাধির উপর একটি সুযোগ্য স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করতে পারেনি বলে, তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা আমাকে জানান। ‘আসলে ক্ষমতায় না থাকলে সকলেই এড়িয়ে চলে’ কথাচ্ছলে শেখ হাসিনা বলেন।” দুর্দিনে আত্মীয়রা না থাকলেও মানুষ কিন্তু শেখ হাসিনার পাশে ছিল। প্রকৃত বিচারে তখন বিপাকে পড়া বঙ্গবন্ধু কন্যার অভিজ্ঞতালব্ধ কথাগুলো চির সত্য। হৃদয়বিদারক ও মর্মান্তিক। বিজয়ের মাস সামনে রেখে এতটুকু বলেই আজকের কলামটার পরিসমাপ্তি টানছি।
লেখক : রাজনীতিক।
[email protected]
এইচআর/এমএস