মূল-মুলায় বিকল্প খান: পেঁয়াজে চাপ কমান
বেশি করে আলু খান, ভাতের ওপর চাপ কমান-এমন একটি স্লোগান ছিল ওয়ান ইলেভেন আমলে। চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় শাসিতদের প্রতি তখনকার শাসকদের এ আহ্বানটি নিয়ে সমালোচনা কম হয়নি। আহ্বানটির গোড়া পত্তন বিএনপি জমানায়। তখন স্লোগান রূপে না এলেও বিএনপি আমলে প্রচুর আলু উৎপাদন হওয়ায় এটি দেয়া হয়েছিল পরামর্শের ধাঁচে।
বাঙালি সমাজে ‘বান্দর কম দুঃখে গাছে ওঠে না’- মর্মে একটি প্রবাদ রয়েছে। আবার ‘বেশি লায় দিলে বান্দর গাছে ওঠে ’-এই প্রবাদের কথাই বা বাদ যাবে কেন? নানা ঘটনাচক্রেই ভর করতে হয় এ ধরনের প্রবাদে। আরো আগে একবার বিএনপি আমলে রমজানে বেগুনি নিয়ে চলেছিল নানান ছন্দবদ্ধ কথাবার্তা। বেগুনির নাম পাল্টিয়ে করা হয়েছিল পেঁপেনি। বেগুনের দাম বেড়ে যাওয়ায় পাতলা করে পেঁপে কেটে সেটা দিয়ে তৈরি আইটেমটির নাম দেয়া হয়েছিল পেঁপেনি। তখন কুমড়া কেটেয়েও বেগুনি তৈরির রাস্তা বের করা হয়েছিল। তবে, কুমড়ানি নাম দেয়া হয়নি।
আসলে পণ্যের বিকল্প হয় না। একটা দিয়ে আরেকটার কাজও চালানো যায় না। পারা যায় একেবারে বাদ দিয়ে দিতে। যা এখন চলছে পেঁয়াজ নিয়ে। কেউ কেউ পেঁয়াজ খাওয়া বাদ দিয়েছেন। কেউ কেউ বিকল্প খুঁজছেন। মুলা কুঁচিকুঁচি করে কেটে পেঁয়াজের স্বাদ খোঁজার চেষ্টাও থেমে নেই। এতে পেঁয়াজের স্বাদ মিলছে বলে সাফাই মিলছে। স্বাধীনতার পর চুয়াত্তর-পঁচাত্তরের অভাবের মৌসুমে এ দশা হয়েছিল লবণ নিয়ে।
নানা কারণে এবার পেঁয়াজের সংকটে বাংলাদেশ। তা-ও যেনতেন সংকট নয়। এক বিশ্রিকর অবস্থা। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে জানিয়েছেন তিনি নিজেই পেঁয়াজ খাচ্ছেন না। গণভবনে বেশ কিছুদিন থেকে পেঁয়াজ ছাড়া রান্না হয়। সেই রান্না বেশ সুস্বাদু বলেও জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রতিদিন নয়, সকাল-সন্ধ্যায় লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বেড়ে এই নিত্যপণ্যটি এখন নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। বাধ্য হয়ে অনেকে ৪৫ টাকা কেজিতে পেঁয়াজ কিনতে টিসিবির ট্রাকের জন্য লাইনে ভিড় করছেন। কখনো কখনো ট্রাক আসার আগেই সিরিয়াল দেন। কখনো কখনো ট্রাক আসেও না। এরপরও ঘন্টার পর ঘন্টা কাঠফাঁটা রোদে দাঁড়িয়ে হাতে পেঁয়াজ পেলে পরম তৃপ্তি। বেদম খুশি। প্রকাশ্য রাস্তায় এ যুদ্ধে পরিচিত কাউকে দেখলে লজ্জায় মুখ লুকিয়ে ফেলেন পেঁয়াজ প্রার্থীরা।
মুলা-গাজর যেটা দিয়েই হোক সমস্যার মূলে যেতে হবে। বিকল্প আবিষ্কার বা উৎপাদন বাড়ানো ছাড়া পেঁয়াজ সংকট কাটবে না। আমদানিতেও এ সংকটের স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। মোটকথা নিজের ওপর ভরসা নিশ্চিৎ না হওয়া পর্যন্ত সংকট পিছু ছাড়বে না। পেঁয়াজের জন্য বাংলাদেশকে ভারতসহ বিদেশের ওপর নির্ভর করতেই হবে। কার্যকর উদ্যোগ নিলে সম্ভব। যেমন সম্ভব হয়েছে পশু উৎপাদনের ক্ষেত্রে। বছর কয়েক আগেও মনে করা হতো ভারত থেকে গরু না আনলে বাংলাদেশের মানুষের কোরবানি দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। হাজার টাকা কেজিতেও মিলবে না গরুর মাংশ। ধারণা নয়, এটা ঠেকেছিল বিশ্বাসের পর্যায়ে। এখন কোথায় গড়িয়েছে পরিস্থিতি?
চার-পাঁচ বছর আগেও গরু-ছাগলের চাহিদার বড় অংশ মিটত প্রতিবেশী দুই দেশ ভারত ও মিয়ানমার থেকে আমদানি করে। ২০১৪ সালে ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশে গরু আসা বন্ধ করে দেয়। এতে বাজারের চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশে গবাদিপশুর লালন-পালন ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। ফল মেলে দ্রুত। দেশ গরু-ছাগলে এখন প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। স্থানীয় সুন্দর-সুশ্রি গরুতেই বাংলাদেশের মানুষ কোরবানি দিচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে। ছোট-বড় মিলিয়ে এখন খামারের সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। গত তিন বছরে দেশে গরু-ছাগলের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ২০ লাখ। বাড়ছে ভেড়া-মহিষ উৎপাদনও। গরু-ছাগলের উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে স্বাভাবিকভাবে এ খাতে এসেছে বাংলাদেশের বৈশ্বিক অবস্থানের উন্নতি। পেঁয়াজ, রসুন, আদার মতো অন্যান্য মশলা নিয়েও ভাবা যায়। বিকল্প আবিষ্কারের ভাবনাই বা বাদ থাকবে কেন?
আশা জাগানিয়া খবর হচ্ছে, পেঁয়াজের বিকল্প খুঁজছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা। এরইমধ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট-বারি মসলা গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পেঁয়াজের বিকল্প হিসেবে ‘চিভ’ নামে এক মসলার জাত চাষের চেষ্টায় বেশ এগিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটির আঞ্চলিক মশলা গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. নূর আলম চৌধুরী তার সহযোগী ড. মোস্তাক আহমেদ, ড. আলাউদ্দিন খান ও মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানকে নিয়ে সাফল্যের পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন। উদ্ভাবন করেছেন বছর জুড়েই চাষ ও ফলনের উপযোগী বারি চিভ-১ নামের একটি জাত। এতে একসঙ্গে মিলবে পেঁয়াজ-রসুনের স্বাদ। গুণাগুণও। এতে বাড়তি হিসেবে থাকছে ক্যান্সার প্রতিরোধী গুণ। আপৎকালীন সময়ে এ উদ্ভাবনটি উম্মোচন করতে পারে নতুন দিগন্ত।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/পিআর