রেল কবে চলবে?
কোন দুর্ঘটনাই নিছক দুর্ঘটনা নয়, যেমনটি ছিল না ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মন্দবাগ স্টেশনে ঘটে যাওয়া সেই মন্দ ঘটনাটি। গত মঙ্গলবার ভোররাত সোয়া তিনটার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার মন্দবাগে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী তূর্ণা নিশীথা এবং সিলেট থেকে চট্টগ্রামগামী উদয়ন এক্সপ্রেসের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ১৬ জন নিহত হয়েছেন। এতে আহত হয়েছেন আরও অর্ধশতাধিক যাত্রী।
কার কতটুকু দায় সেই তথ্য বের হেয়ে আসছে। রেলওয়ে স্টেশন, প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় লোকজন গণমাধ্যমকে বলেছেন, তূর্ণা নিশীথা ট্রেনটিকে মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশনের আউটারে থামবার জন্য সংকেত দেওয়া হয়। আর উদয়ন এক্সপ্রেস কসবা রেলওয়ে স্টেশন ছেড়ে মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশনে প্রবেশ করবার পথে ট্রেনটিকে মেইন লাইন ছেড়ে ১ নম্বর লাইনে আসবার সংকেত দেওয়া হয়। কিন্তু উদয়নের ছয়টি বগি প্রধান লাইনে থাকতেই তূর্ণা নিশীথার চালক সিগন্যাল অমান্য করে ট্রেনটির মাঝামাঝি ঢুকে পড়ে। এতে উদয়নের তিনটি বগি দুমড়ে-মুচড়ে যায়।
নিয়মানুযায়ী তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় এবং বহু ক্ষেত্রেই তদন্তের ফলাফল আর জানা যায় না। এই ক্ষেত্রেও দুর্ঘটনা তদন্তে রেলের পক্ষ হতে মোট চারটি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসনের পক্ষে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রশ্ন হল, দুর্ঘটনার কারণগুলি ঠিকভাবে চিহ্নিত করে যদি প্রতিকারের ব্যবস্থা নেওয়ার কাজটি যথাযথভাবে পালন করা হয়—তা হলে একই ধরনের দুর্ঘটনা বারবার ঘটে কী করে?
দুর্ঘটনা ঘটেছে বলেই রেলকে সমালোচনা করতে হবে বিষয়টা ঠিক তা নয়। সেবার মান, রেলের ভেতর গড়ে উঠা দুর্নীতির সংস্কৃতি, ট্রেন ও দেশব্যাপী স্টেশনগুলোর নোংরা পরিবেশ আমাদের বলতে বাধ্য করে যে, বাংলাদেশ রেলওয়ে বহুযুগ ধরে সীমাহীন অপদার্থতার দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। উঠছে। সেবা প্রদানে, পরিবেশ রক্ষায়, দুর্ঘটনা প্রতিরোধে এই সংস্থায় কর্তব্যে গাফিলতি মারাত্মক পর্যায়ে রয়েছে বহুদিন ধরে।
ঈদের সময় আমরা শিডিউল বিপর্যয় ঘটে, মানুষজন সীমাহীন দুর্ভোগে পড়ে। এর বাইরে সারাবছরই নানা অনিয়মের আলোচনা আছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায যে ঘটনা ঘটল, আমরা হয়তো দেখব কিছুটা নিন্দা হবে, খানিক সমালোচনার ঝড় বইবে, তার পর ধীরে ধীরে সব থিতিয়ে আসবে।
সত্যি বলতে কী, বিষয়টিকে হালকা করে ফেলা হবে পরিকল্পনা করেই। এতগুলো মানুষের প্রাণ যাওয়া, পরিবারগুলোর সর্বনাশ হয়ে যাওয়া, কার অপদার্থতা এবং গাফিলতির কারণে? এটি যে একটা গুরুতর অপরাধ সেই দায় যে নিতে হবে এই সংস্থার উচ্চ পর্যায় থেকেই, সে ধরনের ভাবনা কোন কালেই ছিল না।
খুব সহজে চালককে দায়ী করা যায়। এ ক্ষেত্রেও দায়ী করা হল চালককে। কিন্তু ট্রেনের চালকরাতো একটা সিস্টেমের অংশ। সিস্টেম অকার্যকর, অকর্মণ্য হলে দুর্ঘটনা ঘটবেই। চালকের পাশাপাশি গার্ড, স্টেশন মাস্টার, পয়েন্টম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের দায় এড়াবার কী সুযোগ আছে? সিগন্যাল অমান্য করার মতো ভুল ছাড়াও লাইনে পাথর না থাকা, সিগন্যাল ব্যবস্থার ত্রুটি, লাইন ক্ষয়, স্লিপার নষ্ট, লাইন ও স্লিপার সংযোগস্থলে লোহার হুক না থাকা— এমন অসংখ্য কারণ আছে যেগুলো দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে।বিষয়টি রেল কর্তৃপক্ষ জানে। কিন্তু পরিচালন ব্যবস্থায় দক্ষতা আর দায়িত্ববোধের অভাব আছে বলেই এই বিষয়গুলোতে গুরুত্বসহকারে নজর দেওয়া হয় না।
রেলের উন্নয়ন নিয়ে কথার গতি যত রেলের নিজস্ব গতি নেই তত। বিপুল বিনিয়োগ, কিন্তু মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছে না সেবা সংস্থাটি। গত নয় বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা খরচ করেও গতি বাড়েনি রেলের। সেবা না বাড়লেও দফায় দফায় ভাড়া ঠিকই বেড়েছে। কিন্তু এর লোকসান কমে না। সম্প্রতি জানা গেল, রেলের ৩৮টি উন্নয়ন প্রকল্পের অগ্রগতি হতাশাজনক। ১২টি মেগা প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ২১ শতাংশ। বাকি প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি ২৩ শতাংশেরও কম। প্রকল্পগুলোর কোনো কোনোটি চলছে প্রায় ১০ বছর ধরে। প্রকল্পের ধীরগতি মানেই ব্যয়বৃদ্ধি এবং সংশ্লিষ্টদের দুর্নীতির সুযোগ। এ ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে। কোনো কোনো প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে ১০ গুণেরও বেশি। এতে পোয়াবারো হয়েছে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের।
রেলের দ্রুত উন্নয়নের দাবি সর্বস্তরের মানুষের। বিশ্বের প্রায় সর্বত্র যেখানে রেলব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে, সেখানে আমাদের দেশে রেল চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। অনেক দেশে যখন ঘণ্টায় ৩০০ থেকে ৪০০ কিলোমিটার গতিতে চলছে ট্রেন, তখন আমরা ১০০ তো দূরের কথা, গতিবেগ ৬০ কিলোমিটারের উপরেই তুলতে পারছি না। ঘন্টায় ১০০ কিলো গতিবেগ তুলতে পারলে, অনেক মানুষ প্রান্তে নিজের গ্রামের বাড়িতে বাস করে ঢাকায় অফিস করে ফিরে যেতে পারতেন। ফলে রাজধানীসহ বড় শহরগুলোতে জনচাপ কমত, যানজট কমে আসত, মানুষের আয় ব্যয়ের একটা ভারসাম্য থাকত।
মঙ্গলবার পার হয়ে বৃহস্পতিবার আসতেই আবার দুর্ঘটনা। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় ঢাকা থেকে রংপুরগামী রংপুর এক্সপ্রেসের তিনটি বগিতে আগুন ধরে যায়, ৬টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এরকম ছোটখাট ঘটনা লেগেই আছে সারা বছর। ন্যূনতম যাত্রী-সুরক্ষা ও সেবা নিশ্চিত করতে পারছে না যে সংস্থা তার পেছনে কেন খরচ হবে হাজার হাজার কোটি টাকা?
যোগাযোগ ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় রেলব্যবস্থা। সাশ্রয়ী ও কম ঝুঁকিপূর্ণ বলে সাধারণ মানুষের চলাচল ও পণ্য পরিবহনের জন্য এ খাতের কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে বর্তমানে দেশের সড়কপথগুলো খুব বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠায় রেলই হতে পারে সাধারণ মানুষের চলাচলের ভরসার স্থল। রেলকে সম্পূর্ণ নূতন স্তরে নিয়ে যেতে হবে। যাত্রী পরিষেবার মান উন্নত করা, রেলের নিরাপত্তা বৃদ্ধি, রেলকে লাভজনক করে তুলবার পথ রেলমন্ত্রী সন্ধান করতে পারবেন কিনা জানি না। পেলে আমাদের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
এইচআর/এমএস