সাহসী মিথিলা! আমরা কে কোথায়?
হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন
পরিচিত, পছন্দের কিছু মানুষসহ অনেকেই অভিনেত্রী ও মডেল মিথিলাকে সাহসী হিসেবে রীতিমতো গ্লোরিফাই করার চেষ্টা করছেন। দেশে এই মুহূর্তে অনেক বড় বড় ঘটনা ঘটছে। সেসব ছাপিয়ে এক মডেল অভিনেত্রীর সঙ্গে এক নাট্যনির্মাতার বিবাহবহির্ভূত অন্তরঙ্গ সম্পর্কের ছবি আর ভিডিও নিয়ে সয়লাব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এই ছবি-ভিডিও আবার নিজেদেরই তোলা, প্রকাশ কে করেছে তা এখনও পরিষ্কার নয়। একদিন চুপ থাকার পর মিথিলা সাইবার ক্রাইম আইনে মামলা করেছেন। তার আগে এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে কিছু ‘সাহসী’ কথা বলেছেন। কী বলেছেন তিনি? নির্মাতা ইফতেখার ফাহমির সঙ্গে তিনি ডেটিং ও সম্পর্কের মধ্যে ছিলেন, সম্পর্ক থাকলে মানুষ ঘনিষ্ঠ হয়, ছবি তোলে, নিজেদের মধ্যে শেয়ার করে। এই সম্পর্কের জন্য তিনি লজ্জিত নন। যারা ‘হ্যাক’ করল ও ভাইরাল করল, লজ্জা তাদের জন্য।
মিথিলা কী করলেন, কী বললেন তা নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নাই। সমাজ ভাঙছে, পরিবারগুলো সংকটে পড়ছে, ব্রোকেন ফ্যামিলির শিশুরা অনেকেই স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারছে না, অন্ধকার জগতে হারিয়ে যাচ্ছে কেউ কেউ। রূপালি জগতের মানুষদের কেউ কেউ (সবাই নয়) দ্রুত উপরে উঠতে নিজেরাই স্ক্যান্ডালের জন্ম দেয়। এখন আবার নিজের দেশ পেরিয়ে টালিউড, বলিউড, হলিউডের হাতছানি অনেককে তাড়িত করে।
উচ্চশিক্ষিত ও প্রতিভাধর মিডিয়া জুটি তাহসান-মিথিলার এসবের প্রয়োজন পড়ার কথা নয়। আমার অত্যন্ত প্রিয় দুজনেই। তাহসান এগিয়ে গানে, মিথিলা অভিনয়ে। প্রাণবন্ত মেধাবী অভিনেত্রী। গান, মডেলিং, অভিনয়ের পাশাপাশি জুটি ও দম্পতি হিসেবেও জনপ্রিয়তার শীর্ষে দুজন। তরুণদের কাছে তো বটেই, আমরা যারা আব্দুল্লাহ আল মামুন-ফেরদৌসী মজুমদার, আফজাল/ফরিদী-সুবর্ণা জুটি দেখে বড় হয়েছি, তাদেরও ভালো লাগার জায়গায় ছিল এই জুটি। আদর্শ জুটি। উচ্চশিক্ষিত, নিজ নিজ পেশায় সুপ্রতিষ্ঠিত।
২০১৬ সালে তরুণ শিক্ষার্থীদের এক অনুষ্ঠানে মিথিলাকে কেউ প্রশ্ন করেছিল। তাহসান ভাইয়ার ছবি অনেকে মোবাইলে রাখে, আপনার ঈর্ষা হয় না? মিথিলা জবাব দিয়েছিলেন, ওরা মোবাইলে রাখে, আর আমি তাহসানকে রাখি আমার হৃদয়ে। ২০১৭ সালে তাদের ডিভোর্স হয়ে গেল। এখন জানা গেল, ২০১৭-২০১৮ সালে ফাহমির সঙ্গে তার অন্তরঙ্গ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, যার ছবি আর ভিডিও এখন ভাইরাল। এরই মাঝে জন আর ভিনদেশি সৃজিতের সঙ্গে সম্পর্কের গুঞ্জন! আরেক অভিনেত্রী নাবিলার সঙ্গে এক টিভি প্রোগ্রামে মিথিলাকে নিজেই ফাহমির সঙ্গে সম্পর্ককেও কয়েকবার বলতে দেখলাম, এটা গুঞ্জন!
গত দুদিন প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে সামাজিক মাধ্যম থেকে পাওয়া কিছু তথ্য এখানে উল্লেখ করলাম। মানুষের খেয়ে দেয়ে কোনো কাজ নেই? একজন অভিনেত্রী আর নির্মাতা কী করল, কী ছবি তুলল, তা কেন প্রচার করতে হবে? দুনিয়াতে হরেক কিসিমের মানুষ আছে, কত বিচিত্র মানসিকতা! আপনার ভালো লাগতে পারে, নাও পারে। খারাপ লাগতে পারে, রাগ লাগতে পারে। আপনি কি সবাইকে আপনার মতো দেখতে, বানাতে পারবেন? নোংরামি এড়িয়ে চললেই তো হয়!
এখন আসি মূল কথায়। আমি কেন লিখছি এ নিয়ে! প্রিয় তারকা জুটির সংসার ভাঙার খবরে মন খারাপ হলেও ভেবেছি, সম্পর্কে জটিলতা হতে পারে। সংসার ভাঙতেই পারে। দুজনেই নতুন সংসার পাততে পারেন। কেউ বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক করতে পারেন, যদি তার কাছে এটা নীতিহীন মনে না হয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক মেনে নেয়ার মতো প্রগতিশীল নই। কিন্তু এটা তো আর আমি করছি না! আমার কী করার আছে এখানে!
আমার ঘোর আপত্তি পুরো বিষয়ে মিথিলাকে যারা সাহসী টাহসী বানিয়ে রীতিমতো মহিমান্বিত করে তুলে ধরছেন, তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে। এদের মধ্যে আমার পছন্দের মানুষ আছেন। তাই আমার এই জড়িয়ে পড়া। আমি জানি, আমাকে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার প্রতিক্রিয়াশীল বলে গালি দিবেন কেউ কেউ। তারপরও আমি মিথিলার স্ট্যাটাস, যা পরে তুলেও নেয়া হয়েছে, তার সাহসী বক্তব্যে অভিনন্দন জানাতে পারছি না।
আমি স্বাগত জানাতে পারছি না। কারণ আমার মা, স্ত্রী, কন্যা- কেউ এই কাজ করলে আমি স্বাগত জানাব না। যা নিজের বেলায় পারব না, তা অন্যের বেলায় দূর থেকে সমর্থন করে প্রগতিশীল সাজতে পারব না। মিথিলারও একটা মেয়ে আছে। বড় হয়ে এসব জেনে ওর কেমন লাগবে? ফাহমির স্ত্রী একজন নারী। তিনি নিশ্চয়ই মিথিলার এই কাজে তাকে সাহসী আখ্যা দেবেন না। জন কবির কিংবা সৃজিতের স্ত্রী- সন্তান আছে কি-না জানি না।
আমি সারাজীবন নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার অধিকারের কথা বলেছি। নিজের জীবন বাঁচানোর স্বার্থে নারীকে কথা বলার সাহস জোগানোর কথা বলেছি। একই সঙ্গে বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক, একাধিক সঙ্গীর সঙ্গে মেলামেশার বিরুদ্ধেও বলেছি। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের পবিত্রতার কথাও বলেছি। আমি জানি কিছু মানুষের ভালো লাগবে না এই কথাগুলো। তবে অগণিত মানুষ, বিশেষ করে নারী, আমার কথা শুনেছে। চিকিৎসক হিসেবে জেনেবুঝেই বলেছি। হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের মতো দুষ্ট জীবাণু কীভাবে ছড়ায় তাও বলেছি।
নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার স্বার্থেই বলতে হবে। কিছু মানুষের অপ্রিয় হওয়ার ঝুঁকি নিয়েই বলতে হবে। স্বাস্থ্যগত, ধর্মীয়, সামাজিক- কোনো দিক থেকেই বহুগামিতা, লাম্পট্য সমর্থনযোগ্য নয়। নারী-পুরুষ কারও ক্ষেত্রেই না। আমি বলছি না, অপমানের অসম্মানের জীবন মেনে নিয়ে নারীকে বিয়ে টিকিয়ে রাখতে হবে। এমন ক্ষেত্রে বরং বিয়ের বন্ধনমুক্ত হতে সাহসী হওয়ার পক্ষে আমি। অবদমিত যৌনতার বিয়ের বন্ধনমুক্ত হলে সেই নারীকেও আমি সম্মান জানাব। নতুন করে জীবন শুরু করতেই পারেন তিনি।
কিন্তু যারা অনৈতিক বহুগামিতাকে দূর থেকে প্রশ্রয় দিয়ে তরুণ প্রজন্মকে প্রকারান্তরে বিয়েবহির্ভূত অনৈতিক পথে উৎসাহিত করছেন, তারা ভাঙা পরিবারের শিশুসন্তানের কথা ভাবুন। মনে করুন, আপনার পুত্রবধূ কারও সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে ঘনিষ্ট হচ্ছেন, ছবি ভিডিও তুলছেন। আপনি তাকে সাহসী বলে বাহবা দেবেন? কিংবা আপনার কন্যার সংসার তছনছ হচ্ছে কোনো সাহসী নারীর কারণে, কেমন লাগবে আপনার?
কিছু মানুষ নানাভাবে অনৈতিক জীবনে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তারা অন্যদের উৎসাহিত করবে নিজেদের পথে। কিছু মানুষ প্রগতিশীল সাজতে অন্যের অনৈতিকতাকে সাধুবাদ জানাবে। কেউ ভাববেন না, এসব ঘটনার জন্য নারীকেই দায়ী করছি। কিছু নষ্ট পুরুষ আছেই নারীকে প্রলুব্ধ করে, নারীর দুর্বলতা ও সরলতার সুযোগ নিতে জাল পেতে থাকে। আবার নারীর অসতর্কতার সুযোগে নিজে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে নারীর অবশিষ্ট সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। এদের প্রতি এক রাশ ঘৃণা!
আমি চাই, মিথিলারা নষ্ট পুরুষদের পাল্লায় না পড়ুক। নিজেদের শিক্ষা ও রুচিবোধের প্রতি সুবিচার করুক। সন্তানের মনোজগতে নিজের ভুলের সম্ভাব্য প্রভাব অনুধাবন করুক। নতুন করে সুস্থ জীবন শুরু করুক। নিজের অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতা কাজে লাগাক নিজের, সন্তানের ও সমাজের জন্য। এভাবেই ঘুরে দাঁড়াক। প্রকৃত অর্থেই সাহসী হোক। অনৈতিকতা ও ভুলের সাফাই গাওয়ার সাহসী নয়। আগাম অভিবাদন।
লেখক, সহযোগী অধ্যাপক
জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট হাসপাতাল।
এইচআর/বিএ/পিআর