বিরানব্বইয়ে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী- শ্রদ্ধা অতল
‘হাসিনা এ ডটার’স টেল’-এর প্রিমিয়ারে আমন্ত্রণ পাওয়াটা ছিল আমার কাছে সাম্প্রতিক সময়ে বড় প্রাপ্তিগুলোর একটি। একজন মহিয়সী কন্যা, তার ততোধিক মহিয়ান পিতা আর সুযোগ্যতম বোনের এক অনন্য উপাখ্যান উপভোগ করে সপরিবারে সিনেপ্লেক্স থেকে অশ্রুসজল প্রস্থান আমাদের। হাতে ধরা প্যাকেট ভরা পপকর্নগুলো সুবিচারের প্রত্যাশায় ড্যাব-ড্যাব করে তাকিয়ে। মনের গহিনে তখন চতুর্থ যে ব্যক্তিটির জন্য শ্রদ্ধার অনুরণন তিনি হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। বারবার মনে হচ্ছিল সেদিন যদি আমাদের ‘আপাদের’ পশ্চিম জার্মানিতে আনার ব্যবস্থা না করতেন, যদি না ইন্দিরা গান্ধীর সাথে যোগাযোগ করে রাজনৈতিক আশ্রয়টা পাকাপোক্ত করতেন তাহলে? তাহলে হয়তো কিছুই হতো না! ইতিহাস হয়তো ইতিহাসকে ঠিক-ঠিকই নিয়ে আসত আজকের বর্তমানে, কিংবা হয়তো না!
স্বীকার করতে দ্বিধা নেই আমার প্রজন্মের আরো অনেকের মতই হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সম্বন্ধে আমার জানার পরিধিটা খুব ব্যাপক নয়। আমার অকাল প্রয়াত দুই সিএসপি মামার অগ্রজ সিএসপি কর্তা ছিলেন তিনি। ছোটবেলায় মামাদের মুখে তার নাম শুনেছি কি শুনিনি। তবে ‘সিলেটের’ হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী জাতীয় সংসদের স্পিকার নির্বাচিত হওয়ায় আঞ্চলিকতার দোষে সৃষ্ট আর দশজন বাঙালির মত আমিও যে সিলেটি হিসেবে কিছুটা উদ্বেল হয়েছিলাম এটা বেশ মনে আছে। ব্যস, ঐ পর্যন্তই।
ব্যাক্তিকে নিয়ে আমি সাধারণত লিখি না। গত ক’বছরে আমার যে দেড় শতাধিক প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে তার মধ্যে ব্যক্তিকে নিয়ে লেখা আছে কি নেই! ব্যতিক্রম শুধু বঙ্গবন্ধু আর তার দীপ্তিময় পরিবার। কাজেই আজ যখন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে নিয়ে লিখছি তখন এই আমি আমার কাছেই অচেনা। আমি নিঃসন্দেহে সংগঠনবাজ। সেই কোন ছেলেবেলায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগে হাতেখড়ি। সেই থেকে লিভার বিশেষজ্ঞদের একের পর এক সংগঠন থেকে শুরু করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, সম্প্রীতি বাংলাদেশ, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আরো কত কি। কিন্তু হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী স্মৃতি সংসদের সাথে আমার সংশ্লিষ্টতা আমার কাছেই আমার জন্য বেমানান। তবে এও ঠিক যে এই একটি সাংগঠনিক সংশ্লিষ্টতা আমার কাছে পরম তুষ্টির। কারণ এর সাথে যুক্ত না হলে একজন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী আমার কাছে অচেনাই থেকে যেতেন। তাকে আমি চিনতাম একজন ডিপ্লোম্যাট কিংবা একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে। খুব বেশি হলে হয়তো ভাল লাগতো একজন ‘সিলেটি কুট্টি’ হিসাবে আরেকজন ‘কুট্টি সিলেটির’ সাফল্যে। তার বেশি কিছু নয়।
হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী স্মৃতি সংসদের উদ্যোক্তাদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতা অসীম। তারা সদয় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বলেই একজন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর বহুমাত্রিকতায় আজ আমি একজন বিমুগ্ধ ভক্ত। কারণ সেই বহুমাত্রিকতা এমনই যা ব্যক্তি হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর ব্যাপ্তিকে সিলেট তো বটেই এমনকি বাংলাদেশের পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের ব্যাপ্তি ছাপিয়ে নিয়ে গেছে আন্তর্জাতিকতার অসাধারণ উচ্চতায়।
পনের আগস্টের পর তার যে অনন্য অবদান, এমনি সাহসিকতার স্বাক্ষর তিনি তার কীর্তিময় জীবনে রেখেছেন বারবার। তিনি তৎকালীন পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেইসব হাতেগোনা কয়েকজন কর্মকর্তার অন্যতম যিনি পররাষ্ট্র দপ্তরের লোভনীয় চাকুরীর প্রলোভনকে পাশে ঠেলে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই নয়া দিল্লীর পাকিস্তান হাইকমিশনে কর্মরত থাকা অবস্থায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশের দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন।
পাশাপাশি সেসময় বিদেশী গণমাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে তিনি সোচ্চার ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তিনি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে তৎপর হন। তার কূটনৈতিক দক্ষতায় খুব অল্প সময়ের মধ্যেই চৌত্রিশটি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। তার কূটনৈতিক দক্ষতার অনন্য স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন যার দ্বিতীয় কোন উদাহরণ বাংলাদেশের সবুজ কোন পাসপোর্টধারীর নেই।
জাতীয় সংসদের স্পিকার হিসেবেও তিনি ছিলেন অসম্ভব সফল। তার আগে তিন দশকেও কোন আওয়ামী লীগ সাংসদ জাতীয় সংসদের এই পদটিতে নির্বাচিত হননি। জাতীয় সংসদকে গতিশীল করা আর জবাবদিহিতার আওতায় আনায় তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। পাশাপাশি সংসদের প্রচলিত রীতিনীতি আধুকিনায়ন এবং সংস্কারেও তিনি স্মরণীয় ভূমিকা রাখেন।
কৃতজ্ঞ জাতি হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে সম্মানিত করেছে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে। আর তার অনুজরা হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী স্মৃতি সংসদ গঠনের মাধ্যমে একজন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর উদাহরণকে উদাহরণ হিসেবে ছড়িয়ে দিতে চায় কোটি বাঙালির মাঝে। বিরানব্বইতম জন্মদিনে এই অকুতোভয় মহান বাঙালিকে বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে অশেষ শ্রদ্ধা।
লেখক : চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সহ সভাপতি, হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী স্মৃতি সংসদ।
এইচআর/পিআর