মেঘমুক্ত নির্মল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পাওয়া সম্ভব?
আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয় কেমন হওয়া উচিত? কি ধরনের কর্মকাণ্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পূর্ণতা দিতে পারে? সংজ্ঞা আছে কী? আসলে সংজ্ঞা দেয়ার চেয়ে দৃষ্টান্ত সহজ বলে মনে হতে পারে। যেমন ধরুন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা সাভারের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় হয়তো আজকের যুগের আদর্শ প্রতিষ্ঠান। এই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা, উপাচার্যপন্থী শিক্ষকরা বা তাদের লালিত পালিত বাহিনী সবাই হয়তো অনুকরণীয়।
এই তিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরাই শিক্ষক, অভিভাবক এবং প্রশাসক হিসেবে এমন মান নির্ধারণ করেছেন যা তাদের আগে যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে আসীন হয়েছেন তারা ভাবতেও পারেন নি এবং পরবর্তীতে যারা আসবেন, তাদের জন্য এগুলো সবই বুনিয়াদী প্রশিক্ষণ উপাদান। গোপালগঞ্জের উপাচার্য শিক্ষার্থীদের পেটানোসহ নানা কর্ম করেও টিকতে পারেন নি, পালিয়েছেন। জাহাঙ্গীরনগরের উপাচার্য ফারজানা ইসলাম এর মধ্যেই প্রাথমিক সাফল্য অর্জন করেছেন, দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষক আর শিক্ষার্থীদের মার দিতে পারায় ছাত্রলীগের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। আর পাবনার উপাচার্য এখন পর্যন্ত বলেই চলেছেন যে, চাকুরী প্রার্থী থেকে তিনি ঘুষ নেননি।
নিশ্চয়ই একটা পর্যায়ে গিয়ে সব আন্দোলনের মত এইসব আন্দোলনও যৌক্তিক পরিণতির দিকে যাবে, বা মিইয়ে যাবে। নিশ্চয়ই আলোচনা চলতেই থাকবে কেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন উপাচার্যই টিকতে পারেন না, কোন না কোনভাবে আন্দোলনের মুখে পড়েন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক এবং ছাত্র রাজনীতি ছিল এবং এখনও আছে। কিন্তু শিক্ষকদের স্তরে নৈতিকতার এমন পতন সম্ভবত গণতন্ত্রেরই উপহার। বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন উপাচার্যরা ছাত্রদলকে ব্যবহার করতেন, এখনকার উপাচার্যরা করছেন ছাত্রলীগকে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য উন্নয়ন প্রকল্প থেকে স্থানীয় ছাত্রলীগকে চাঁদা দিয়েছেন এবং তার ‘ন্যায্য হিস্যা’ চাইতে গিয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকের পদ হারিয়েছেন শোভন ও রাব্বানি। কিন্তু উপাচার্য পদে ঠিকই বহাল আছেন ফারজানা ইসলাম এবং তিনি আবারও ছাত্রলীগকে ব্যবহার করেছেন পদ দখলে রাখার জন্য।
প্রশ্ন উঠে এমন একটা পরিবেশে লেখাপড়া বা জ্ঞান চর্চা হয় বা হতে পারে? যদি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসকদের দর্শন এমনটা হয় তাহলে বলতেই হবে, আমরা আসলে অন্যায়ের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য, নির্লজ্জ লোভ, আর বিশুদ্ধ সুবিধাবাদকেই মেধার মানদণ্ড হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে বিশাল এক ফাঁপা মানবসম্পদ তৈরি করছি। এই শিক্ষার্থীরাই পেশাগত জীবনে অল্প পরিশ্রমে অনেক অর্থ রোজগারের ধান্দা করবে, দুর্নীতিতে ডুবে থাকবে।
আদর্শ শিক্ষক – এমন একটা ভাবনা মাথায় এলে একজন সৌম্যদর্শন, জ্ঞানী ও শাসন-আদরের মিশেলে তৈরি একজন মানুষের অবয়ব ভেসে ওঠে আমাদের মনোজগতে। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের যুগোপযোগী, জীবনোপযোগী শিক্ষা দেবেন, তাকে জ্ঞানের পথ দেখাবেন, আলোর পথের যাত্রী হিসেবে গঠন করবেন। মানসিক ও শারীরিক দু’ভাবেই তারা যাতে ভবিষ্যৎ জীবনের উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারে শিক্ষক হবেন সেই পথের দিশারী। একজন ভাল মানুষ, সুনাগরিক গঠন করবার দায়িত্বও তো শিক্ষকের উপরেই বর্তায়। কিন্তু এসব কথা কী এখন মানায় কিছু কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের দেখলে?
অত্যন্ত পরিতাপের সাথে বলতে হয়, যাদের নিজেদের শিক্ষা বহুলাংশে অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে, তাদের উপরেই যদি ন্যস্ত হয় দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে সমাজের সব স্তরের নেতৃত্ব নেয়ার ভার, তার পরিণাম উদ্বেগজনক। আমাদের রাজনীতি, প্রশাসনসহ সমাজ ও জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্র আজ কেন এত অপরিণত তা হয়তো আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এখনকার অবস্থা থেকে কিছুটা হলেও বুঝতে পারছি। দুর্নীতিপরায়ণ ও অপরাধপ্রবণ রাজনীতিক, ফাঁকিবাজ ও অদক্ষ আমলা, পক্ষপাতদুষ্ট প্রশাসনিক কর্মকর্তা, নিপীড়ক পুলিশ ও উচ্ছন্নে যাওয়া কর্মসংস্কৃতি— এ সব কিছুর পেছনে হয়তো এমন শিক্ষারই অবদান।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পাবলিক তথা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকারের প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হবে। পঠনপাঠন, গবেষণা, ডিগ্রি, মূল্যায়ন প্রভৃতি শিক্ষা পরিচালনার সামগ্রিক বিষয়টি দেখবহালের দায়িত্বে থাকবেন শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত শিক্ষক-শিক্ষাবিদ-গবেষকরা। অর্থাৎ, শিক্ষা প্রদানের আর্থিক দায়িত্ব সরকারের, কিন্তু পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন শিক্ষক-শিক্ষাবিদরাই। আর এ জন্যই এসেছিল ১৯৭৩-সালের গণতান্ত্রিক অধ্যাদেশ। কিন্তু ক্যাম্পাস গণতন্ত্র যদি এমন এক পরিবেশ তৈরি করে যা চলছে এখন বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে, তাহলে কী পড়বে, কে পড়াবে এবং কাকে পড়ানো হবে এসব নিয়ে নতুন ভাবনা শুরু হবেই। ক্যাম্পাসে গণতন্ত্র থাকবে নাকি, প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার নতুন পথ উন্মোচিত হবে সেটা কবে হবে জানা নেই।
তবে জানা আছে যে, এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুকিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে বহিরাগত শক্তি। রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসী থেকে কাজ করা এক জিনিস, আর পেশিশক্তির প্রয়োগে যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় থাকা আর এক জিনিস। এই দ্বিতীয় অশুভ প্রবণতাটি নিয়ে খুব কমই আলোচনা হচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ন ভাবে এই নৈরাজ্যকর রাজনীতি থেকে নিয়ন্ত্রণমুক্ত না করতে পারলে মেঘমুক্ত নির্মল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পাওয়া অসম্ভব।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
এইচআর/এমএস