উত্তেজনা দেশে-দেশে সোনা-ডলারে সংঘর্ষ
রাজনৈতিক-সামাজিক নানা অস্থিরতার মধ্যে মন্দায়ও আক্রান্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। এশিয়া, ইউরোপ এমন কি যুক্তরাষ্ট্রেও মহামন্দার পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন বোদ্ধারা। ধনীদের কারো কারো ঘরে মন্দার তোড় তুলনামূলক বেশি। আবার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাস্তানাবুদ অনেকে। কয়েকটি দেশে ঝরছে প্রচুর প্রাণও। সরকারবিরোধী আন্দোলন সামলাতে কাহিল ক্ষমতাসীনরা। এই মন্দা-উত্তেজনার জেরে বর্তমান-ভবিষ্যৎ চিন্তায় অর্থনীতিতে নানা কৌশল নিচ্ছে দেশগুলো।
ইরাক, লেবানন, স্পেনের কাতালোনিয়া, চিলি, বলিভিয়া, চীনের হংকংসহ কয়েকটি দেশ, প্রদেশ ও অঞ্চলের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ভয়াবহ। কোথাও কোথাও সামলানোর অবস্থা নেই। মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ইরাকে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ তুঙ্গে। সহিংসতা নিত্যনৈমত্তিক। লাশের সংখ্যা অগুণতি। আফগানিস্তানে হতাহতের ঘটনা ঠেকেছে মামুলি পর্যায়ে। মসজিদে বোমা হামলাও আফগানিস্তানে এখন আর ঘটনার মধ্যে পড়ে না। আন্দোলনের মুখে মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়েছেন চিলির প্রেসিডেন্ট সেবাস্তিয়ান পিনেরা। স্বাধিকারের দাবিতে অগ্নিগর্ভ কাতালোনিয়া। বন্দি প্রত্যর্পণের বিল আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিলের পরও শান্ত হয়নি হংকং। নিরিবিলি এগিয়ে চলা চীনকে ভোগাচ্ছে হংকংয়ে রাজনৈতিক স্বাধীনতার দাবিতে চলা এ আন্দোলন।
এ মাসে শুরু হওয়া প্রধানমন্ত্রী আদেল আবদুল মাহদি সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে রাজধানী বাগদাদসহ ইরাকের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনী ও মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোর সংঘর্ষে লাশের স্তুপ কেবল উঁচু হচ্ছে। লেবাননে জ্বালানি, তামাক ও হোয়াটসঅ্যাপ কলের ওপর নতুন করারোপ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আন্দোলনের সঙ্গে যোগ হয়েছে অর্থনৈতিক সমস্যা, বৈষম্য ও দুর্নীতির অভিযোগও। প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ আল-সিসির সরকার তা কঠোর হাতে দমাতে থাকলেও অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ভয়াবহ।
ভেনিজুয়েলা, চিলি, ইকুয়েডর, বলিভিয়াসহ লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশও আন্দোলনগ্রস্ত। জ্বালানি তেল, দ্রব্যমূল্য, পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি ইস্যুতে উত্তাল দেশগুলো। অর্থনৈতিক অবস্থা উদ্বেগজনক। বিশ্বময় খবরদারির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিও টানাপড়েনে ভুগছে। চাকরির সংস্থান কমে গেছে দেশটিতে। জার্মান ফ্যাক্টরিতে চাকরির অধোগতির কারণে নতুন করে পণ্য তৈরির কারখানাগুলোকে সচল করার লক্ষ্যে ফের স্টিমুলাস বা প্রণোদনা চালুর জন্য অর্থনৈতিক পুঁজি বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ বাড়ছেই। ইউরোপীয় ব্যাংকগুলো ও আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক নতুন করে এ নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে। এতে বিনিয়োগকারীরা শঙ্কিত। তারা শঙ্কিত অনুন্নত বিশ্বের বিনিয়োগ নিয়েও। কারণ অনুন্নত বিশ্বে রেমিট্যান্স একটি প্রধান আয়ের উৎস।
বিনিয়োগকারীরা ইউরোজোন ও আমেরিকার মুদ্রানীতি আরো সহজ করার ওপর জোর দিয়েছে। চীনও আগেভাগে তার নিজস্ব কায়দার স্টিমুলাস বা প্রণোদনা অর্থ সংকুলান করতে ঋণ প্রদানে ব্যাংকের ওপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার ঘোষণা দিয়েছে। চীন বলেছে, তারা আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে লিপ্ত। আমেরিকা ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে আরো অনেক দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাণিজ্য সংঘাত বেড়ে চলছে। তাদের মধ্যে নতুন করে করারোপের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফলে ল্যাটিন আমেরিকার আর্জেটিনায় এ কারণে নতুন করে মুদ্রাসংকট দেখা দিয়েছে।
এদিকে, চীন থেকে আমদানিতে আমেরিকার ক্রয় বৃদ্ধি, আমেরিকার জন্য উৎপাদনে সংকট ঘনীভূত হওয়ায় বিশ্বের এই অর্থনৈতিক শক্তিশালী রাষ্ট্রের মধ্যে উদ্বেগ বৃদ্ধি পেয়েছে। পণ্য উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দিলেও বিশ্বে সার্ভিস সেন্টারে ক্রমাগত তেজিভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমেরিকা-চীনের বাণিজ্য সংলাপ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উৎসাহ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ নিয়ে এখন পর্যন্ত উদ্বেগ প্রকাশ্য না হলেও শঙ্কার কিছু বিষয় রয়েছে।
অর্থনৈতিক ধকল কাটাতে দেশগুলো যার যার সাধ্য ও বাস্তবতা মতো কৌশল নিচ্ছে। এর অংশ হিসেবে সোনার ওপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে কেউ কেউ। ডলার উপেক্ষা করে সোনার রিজার্ভ বাড়াচ্ছে পরাশক্তি চীন ও রাশিয়া। বর্তমানে বিশ্বের সর্বোচ্চ সোনার রিজার্ভের অধিকারী চারটি দেশ চীন, জাপান, সুইজারল্যান্ড ও রাশিয়া। সার্বিয়া, পোল্যান্ড ও ফিলিপাইনের মতো দেশও হাঁটছে এ পথে।
একদিকে অর্থনৈতিক মন্দার শঙ্কা, অন্যদিকে ট্রাম্প নেতৃত্বাধীন আমেরিকার প্রতি রয়েছে চীন, রাশিয়া, সিরিয়া, ফিলিপাইন, ভেনিজুয়েলা, জার্মানিসহ অন্যান্য দেশের ঋণাত্মক অনুভূতি। এটিও এই দেশগুলোকে ডলারের বিকল্প হিসেবে সোনার প্রতি আগ্রহী করে তোলার রহস্য। ডলারের বিকল্প হিসেবে সোনার রিজার্ভ বাড়ানো বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন নয়। সম্প্রতি নতুন করে এতে বাতাস দেয়া হচ্ছে। সোনা-ডলারকে মুখোমুখি করার পেছনে কাজ করছে বিশ্বরাজনীতির গতিপ্রকৃতি।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/জেআইএম