খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়েও রাজনীতি?

বিভুরঞ্জন সরকার
বিভুরঞ্জন সরকার বিভুরঞ্জন সরকার
প্রকাশিত: ১২:০৬ পিএম, ২৯ অক্টোবর ২০১৯

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে আবার বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে তিনি কারাগারে যাওয়ার পর থেকেই অভিযোগ করা হচ্ছে যে, বেগম জিয়া গুরুতর অসুস্থ। তার উপযুক্ত চিকিৎসা হচ্ছে না। তিনি সরকারি হয়রানি ও রোষানলের শিকার। আর সরকারপক্ষ বরাবর বিএনপির অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। বেগম জিয়া কারাগারে আছেন ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে, এক বছর আট মাস হয়ে গেছে। বিএনপি প্রথম দিকে এমন ভাব করেছিল যেন আন্দোলন করেই খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে আনবে। কিন্তু দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হয়ে বেগম জিয়া জেলে যাওয়ার অল্প দিনের মধ্যেই এটা বিএনপির কাছে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, তাদের নেত্রীর মুক্তির দাবিতে দেশে প্রবল গণআন্দোলন গড়ে ওঠার কোনো সম্ভাবনা নেই। তারপরও বিএনপি একদিকে আন্দোলনের ফাঁকা আওয়াজ দিতে থাকে, অন্যদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতার বিষয়টি সামনে এনে মানুষের সহানুভূতি পাওয়ার কৌশল নেয়। বিএনপি ভেবেছিল, বেগম জিয়া স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছেন, এটা শুনে মানুষ তাকে মুক্ত করার আন্দোলনে পথে নেমে আসবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেত্রী, সাবেক সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতির স্ত্রী, বয়োজ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদ- এতসব কারণে তার অসুস্থতার কথা শুনে সাধারণ মানুষের মধ্যে যতটা আবেগ তৈরি হওয়ার আশা বিএনপি করেছিল, বাস্তবে তা না হওয়ায় বিএনপি নেতৃত্ব হতাশ হয়েছেন।

বেগম জিয়াকে মুক্ত করার জন্য সরকারের সঙ্গে বিএনপির সমঝোতার গুজবও মাঝে মাঝেই ছড়িয়েছে। বেগম জিয়া চিকিৎসার জন্য বিদেশ চলে যাওয়ার তারিখও শোনা গিয়েছিল। কিছু তৎপরতাও লক্ষ করা গিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে শেষ পর্যন্ত তেমন কিছু হয়নি। সম্প্রতি বিএনপির সাত এমপি দুই দফায় বেগম জিয়ার সঙ্গে দেখা করার পরও তার মুক্তির গুজব চাউর হয়েছিল। কিন্তু তিনি জামিনে মুক্তি পাবেন, নাকি প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বিদেশ যাবেন- সেই বিতর্কের সম্মানজনক নিষ্পত্তি না হওয়ার জন্যই সম্ভবত বেগম জিয়ার বিদেশ গিয়ে চিকিৎসা নেয়ার বিষয়টি বিলম্বিত হচ্ছে। বেগম জিয়া জামিনে মুক্তি চান। সরকারের আগ্রহ প্যারোলে।

বেগম জিয়ার মুক্তি ও চিকিৎসার বিষয়টি নিয়ে বিএনপির ভেতরে যেমন মতবিরোধ আছে, তেমনি পরিবারের সঙ্গে দলের মতভিন্নতার কথাও শোনা যায়। কেউ চান যেকোনো উপায়ে তার মুক্তি

বিজ্ঞাপন

সর্বশেষ বেগম জিয়ার পরিবারের কয়েকজন সদস্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পর আবারও তার শারীরিক অবস্থা এবং বিদেশে চিকিৎসার বিষয়টি সামনে আসে। বেগম জিয়ার মুক্তি ও চিকিৎসার বিষয়টি নিয়ে বিএনপির ভেতরে যেমন মতবিরোধ আছে, তেমনি পরিবারের সঙ্গে দলের মতভিন্নতার কথাও শোনা যায়। কেউ চান যেকোনো উপায়ে তার মুক্তি। আবার কেউ তার ‘আপসহীন’ নেত্রীর ইমেজ রক্ষায় ব্যস্ত। দল ও পরিবারের দড়ি টানাটানি প্রভাব যে বেগম জিয়ার মুক্তির ব্যাপারে পড়ছে, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই।

আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে বেগম জিয়ার মুক্তির কোনো সুযোগ আছে বলে সরকার পক্ষ মনে করে না। বিএনপি নেতারা প্রকাশ্যে বলেন, কারও অনুকম্পায় বেগম জিয়া মুক্তি চান না। আবার মানবিক বিবেচনায় তার মুক্তিও দাবি করেন। কেউ আবার বলেন, আন্দোলন করেই তারা তাদের নেত্রীকে মুক্ত করে আনবেন। বাস্তব পরিস্থিতি হলো, খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যাপারে সরকার কোনো চাপে নেই। বিএনপি তাদের বিদেশি বন্ধুদের দিয়ে সরকারের ওপর চাপ দেয়ার চেষ্টা করে সফল হয়নি।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

বিএনপি যতই বলুক না কেন যে, বেগম জিয়া ক্ষমতাসীন সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার, কিন্তু বিদেশিদের কাছে সেটা বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা সহজ নয়। কারণ দুর্নীতির মামলায় তিনি দণ্ডিত হয়েছেন দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই। বেগম জিয়ার তরফ থেকে আইনি সুবিধার সবটুকু গ্রহণ করছে। রায় নিজেদের পক্ষে না এলে সেটাকে প্রভাবিত রায় বলার যে এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা আমাদের দেশে চালু হয়েছে, তা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসার কৌশল রপ্ত করতে হবে। বিএনপি দেশের মধ্যে প্রবল জনমত গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপি কী করতে পারে এবং কী করতে পারে না- সেটা সরকারের পরিমাপ করা আছে। ফলে বেগম জিয়ার কারামুক্তি বিএনপির শর্তে হওয়ার সম্ভাবনা কম। সরকারের শর্তে রাজি হলেই কেবল বেগম জিয়ার মুক্তি সম্ভব। বিএনপি এ ব্যাপারে যতদিন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগবে ততদিন সম্ভবত কেবল পাল্টাপাল্টি কথার তুফান চলবে, আর কিছু অগ্রগতি হবে না।

গত ২৭ অক্টোবর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অবস্থা ‘অত্যন্ত সংকটাপন্ন’ বক্তৃতা করেছেন। খালেদা জিয়ার জীবনের হুমকি দেখা দিয়েছে বলে উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, তার সুস্থ অবস্থায় ফিরে না আসার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মির্জা ফখরুল বলেছেন, এখন তিনি (খালেদা জিয়া) বিছানা থেকে উঠতে পারেন না, নিজের খাবার খেতে পারেন না, তিনি একপা হাঁটতেও পারেন না। হাসপাতালে তার যথাযথ চিকিৎসা হচ্ছে না বলেও মির্জা ফখরুল অভিযোগ করেছেন।

অভিযোগগুলো গুরুতর সন্দেহ নেই। বেগম জিয়ার মুক্তির দাবিতে গণআন্দোলন না হলেও কারাগারে থাকা অবস্থায় তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়বে। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থা যতটা খারাপ বলা হচ্ছে, আসলে তা ঠিক নয় বলে তার চিকিৎসক এবং বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেছেন। তারা বলেছেন, সাত মাস আগে হাসপাতালে যে অবস্থায় তিনি ভর্তি হয়েছেন, তার থেকে অবস্থার একটুও অবনতি হয়নি। তার শারীরিক সমস্যা আছে। কিন্তু সেটা মারাত্মক কিছু নয়। চিকিৎসার জন্য তার বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই বলেও চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।

চিকিৎসক এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সংবাদ সম্মেলনের পর এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে রাজনীতি করছে বিএনপি

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

চিকিৎসক এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সংবাদ সম্মেলনের পর এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে রাজনীতি করছে বিএনপি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বলেছেন, ‘বেগম জিয়ার দলের নেতা ও স্বজনরা তার অসুস্থতার যে চিত্র তুলে ধরছেন, চিকিৎসকদের অবজারভেশন তেমন নয়। বিএনপি খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে চায়। এটি নিয়ে তাদের দুরভিসন্ধি রয়েছে’।

অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিএনপির নেত্রী অন্য বন্দিদের চেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা লাভ করছেন। বেগম জিয়ার ইচ্ছানুযায়ী একজন গৃহপরিচারিকাকে কারাগারে তার সঙ্গে রাখা হয়েছে। কারাগারের ইতিহাসে বা কোনো দেশে এমন নজির নেই যে, কোনো নিরপরাধী গৃহপরিচারিকা একজন বন্দির সঙ্গে কারাগারে অবস্থান করে। কিন্তু খালেদা জিয়া সেই সুবিধা ভোগ করছেন।

বেগম জিয়ার মুক্তি, জামিন, চিকিৎসা ইত্যাদি প্রশ্নে সরকারের মনোভাব বা অবস্থান প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে। এখন বিএনপিকেই তাদের কৌশল বা কর্মপদ্ধতি ঠিক করতে হবে

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘বিএনপি বলছে বেগম জিয়া অসুস্থ। তারা তার মুক্তির দাবিকে আন্দোলনের ইস্যু বানাতে এটা বলছে। কিন্তু বিএনপি তার মুক্তির আন্দোলন বা জনমত গঠন করতে পারেনি। সে ক্ষেত্রে আমরা কী করতে পারি’?

বিজ্ঞাপন

বেগম জিয়ার মুক্তি, জামিন, চিকিৎসা ইত্যাদি প্রশ্নে সরকারের মনোভাব বা অবস্থান প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে।

এখন বিএনপিকেই তাদের কৌশল বা কর্মপদ্ধতি ঠিক করতে হবে। বিএনপি এই ইস্যুতে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদেরই ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামাতে পারেনি। সাধারণ মানুষ তাদের কথায় মাঠে নামবে কেন?

লেখক : যুগ্ম সম্পাদক, আমাদের নতুন সময়।

বিজ্ঞাপন

এইচআর/বিএ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।