গণতন্ত্র এবং দুর্নীতি’র রাজনীতি
চুপ করে বসে বিশ্বের দিকে একটু উপর থেকে তাকালেই বুঝতে পারা যায়, দুর্নীতির কোন দেশ-কাল-পাত্র ভেদ নেই। দক্ষিণ আফ্রিকার বিগত হয়ে যাওয়া প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা তদন্তের তাওয়ায় ভাজা ভাজা হচ্ছিলেন, কেননা তিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যেতে পারার মতো ভুজিয়াতন্ত্র চালাতেন সেই ২০০৯ থেকে শুরু করে ২০১৮ সাল, অর্থাৎ পুরো দশ বছর ধরে। ব্রাজিলেও সেই ২০০৮ সাল থেকে রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের হাতে হাত রেখে দেশের অর্থ বিদেশে, অর্থাৎ মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে পাচারের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক খুঁজে পাওয়ায় তদন্ত চলছে। স্বয়ং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট যোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রশাসনকে এমন সব কর্মকর্তা দিয়ে চালাতেন, যারা নিজেদের ব্যক্তিগত লাভের খোঁজে অফিসকে ব্যবহার করেছেন বলে জোরসে ধাক্কায় পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন।
দুর্নীতি নিয়ে বৈশ্বিক সত্যটা এ-ই, ধরা না পড়লে চোর হচ্ছে বাপের ব্যাটা। হাতেগোনা অল্পস্বল্প যে সব ঘটনা ধরা পড়ছে, তা-ই আমাদের গলা শুকিয়ে ফেলছে, যদিও সত্যিকারের আকার-আয়তন আমাদেরকে চিরকালের জন্য নির্বাক করে ফেলতে যথেষ্ট। দুর্নীতি কাকে বলে? বৈশ্বিক সত্য বাবাজি দুর্নীতির সংজ্ঞা হিসেবে কেবল ঘুষ খাওয়াকে চিহ্নিত করতে আগ্রহী নয়। জনগণের সেবায় ব্যবহার্য অর্থ হাতিয়ে নেওয়া যেমন দুর্নীতি, জনগণের স্বার্থে পলিসি নেওয়ার ঘোষণা দিলেও যা জনগণের স্বার্থ রক্ষা করে না, তা-ও দুর্নীতি। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দুর্নীতির প্রভাব বেশি ক্ষতিকর হয়, কেননা এই দেশগুলোর বাজেট সীমাবদ্ধ, কিন্তু তুলনায় চাহিদার চেহারা বিস্তৃত।
আমেরিকানরা সোজা সাপ্টা হিসাব বের করে ফেলতে ওস্তাদ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর দুর্নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরিমাণ ২.৬ ট্রিলিয়ন ডলার, এই হিসাব তারা বের করে ফেলেছে। যদিও দুর্নীতির ধারণা সবার কাছে ভয়ানক, যে দুর্নীতিবাজ সে-ও মাথা ঝাঁকিয়ে একমত হয়ে বলে, দুর্নীতি ভালো না রে পাগলা!
কেন দুর্নীতি ভালো না, রে পাগলা?
সোজা সাপ্টা উত্তর দেওয়া কঠিন নয়। দুর্নীতি জনগণের বিশ্বাসকে নড়িয়ে দেয়। তারা বিশ্বাস করতে থাকে যে সরকার বা রাষ্ট্রের উপর কোন ভরসা নেই। এই বিশ্বাসটাই আসলে গোটা বিশ্বজুড়ে দেশে দেশে গণতন্ত্রের ভিতকে নড়িয়ে দিচ্ছে। মানুষ গণতন্ত্রের উপর থেকে আস্থা হারাচ্ছে। কিছু দিন আগে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দুর্নীতির ধারণা সূচক প্রকাশ করেছিল, তাতে প্রকাশ পাচ্ছে বেশির ভাগ সরকার যার যার নিজের দেশের জনগণের কাছে দুর্নীতিবাজ হিসেবে চিহ্নিত। এর ফলে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে গড়ে তোলা সরকারের উত্থানকেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। কেননা জনগণ ভাবছে, কী হবে সরকার বানিয়ে? যে যাবে লঙ্কায়, সে-ই তো হয়ে যাবে রাবণ। উদাহরণ তো এক-ই। দুর্নীতিবাজ প্রতাপশালীদের কুপোকাত করতে পারলে জনপ্রিয়তা পাওয়া যায়। সেই প্রাপ্ত জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে গঠিত সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করতে থাকে এবং জনগণের দৃষ্টিকে অন্য দিকে সরিয়ে দেয়, যাতে ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজেদের পেট ভরানো যায়। এর নাম রাজনীতি? মোটেও না। এ হচ্ছে ‘পলিটিক্স অব করাপশন’, অর্থাৎ এ রাজনীতি দুর্নীতির জন্য, এ দুর্নীতির রাজনীতি।
ছুপা রুস্তমকে চিনতে একটু দেরি হয়, ফলে রাজনীতি আর দুর্নীতির রাজনীতির ফারাকটাও ধরে ফেলে জনগণ। নইলে কেন ইন্দোনেশিয়ার এক সময়ের দুর্নীতিবিরোধী প্রেসিডেন্টের বিপক্ষেই পথে নেমেছে দেশটির জনগণ? একদা জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট দ্বিতীয় বারের মতো যেন ক্ষমতায় না আসতে পারেন, তার জন্য মারমুখো তারই সমর্থকগণ! ছাত্ররা প্রতিরোধ মিছিলের সামনের সারিতে দাঁড়িয়েছে। প্রেসিডেন্ট জোকো উইডোডো নতুন একটি আইন পাস করেছেন, যা ইন্দোনেশিয়ার দুর্নীতি নির্মুল কমিশনকে দুর্বল করে দেবে বলে তারা বুঝতে পেরেছে। পার্লামেন্টে অপরাধী যাচাই বিষয়ক নতুন খসড়া তুলতেই আগুনে ঘি পড়েছিল। পুলিশের সাথে মারামারিতে ছয়জন প্রতিরোধকারী নিহত হয়েছেন। দুইশ’রও বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। সাবেক মিলিটারি জেনারেল প্রাবোদো সুবিয়ান্তো নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। তার পরাজয়ের পর সমর্থকরা ক্ষেপে গেছেন, কেননা প্রেসিডেন্ট জোকোর দুর্নীতির ফলে এই ভদ্রলোককে তারা বিবেচনায় নিয়েছিলেন। আলজাজিরা টেলিভিশনে দেখলাম, লিলি নামের এক নারী লাল টকটকে রাগি মুখে বলছেন, ‘আমরা এখানে, কেননা আমরা এমন একজন প্রেসিডেন্টকে চাই যিনি সৎ এবং পরিষ্কার।’ লিলি আরও অনেকের সাথে সুরাবাইয়া নামের পূর্ব জাকার্তার এক এলাকা থেকে ৮০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন বিক্ষোভে যোগ দিতে।
হাইতির রাজনীতির অস্থিরতার গোড়ায় আগুন ধরিয়েছে প্রেসিডেন্টের দুর্নীতি, সহিংস প্রতিরোধ চলছে সে দেশে। এই আগুন প্রেসিডেন্টকে নামিয়ে ছাড়বে কি না, তা দেখতে অপেক্ষায় আছে বিশ্ব। হাইতির বেশিরভাগ অংশ অচল হয়ে গেছে বিক্ষোভের কারণে, কেননা জ্বালানী সংকট আর সরকারের উচ্চ মহলের দুর্নীতি দেশটাকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে ফেলেছিল। প্রেসিডেন্ট জভেনেল মইজ টেলিভিশন ভাষণে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। তিনি সংলাপে বসতে চান। এরপরও দমানো যায়নি আগুন। বিক্ষোভকারীরা কোন কথা শুনতে রাজি নন, তারা প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ চান।
গণতান্ত্রিক পরিবেশে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ-প্রতিরোধ স্বাভাবিক বিষয়। দুর্নীতি কিন্তু স্বাভাবিক বিষয় নয়। এই অস্বাভাবিক বিষয়টিকে ঠেকানোর উপায় কি? ভাবতে হবে, গনতন্ত্রের মাঝেই কি এমন কোন উপাদান আছে যা শাসক পর্যায়ে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়। জনগণের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় বসে শাসক ‘এই ম্যান্ডেট দুর্নীতি করার ম্যান্ডেট’ বলে ভাবতে শুরু করেন কি? এ-ই যদি হয় স্বাভাবিক স্বভাব, তাহলে দুর্নীতি নির্মূলের উপায় কি? রোমানিয়াতে তো আইনের শাসন জোরদার করা হ’ল, দেশটির সবচেয়ে ক্ষমতাশালী রাজনীতিবিদ লিভিউ ড্রাগনেয়া’কে জেলে পাঠানো হয়েছে দুর্নীতির পাপে, কিন্তু এরপরও তো দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটছে না। মে মাসের ২৭ তারিখে লিভিউ’কে জেলে পাঠানোর রায় ঘোষণা হলে বিক্ষোভকারীগণ তার মুখের উপর হাত নেড়ে আনন্দের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছিলেন। সাড়ে তিন বছরের জেল হয়েছে লিভিউ’র।
বুখারেস্টের আদালত পরিণত হয়েছিল পার্টি হাউসে। এরপরও থামেননি অন্য দুর্নীতিবাজরা। প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তায় দুর্নীতি চলছেই। কেনিয়ার অর্থমন্ত্রী হেনরি রটিচ গত জুলাই মাসে হাইড্রোইলেক্ট্রিক ড্যাম প্রজেক্টে দুর্নীতির দায়ে বন্দী হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াত্তা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর, ২০১৩ সালে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর থাকার প্রতীজ্ঞা করেই ক্ষমতাসীন হতে পেরেছিলেন। দেশটির মিডিয়াতে বড়সড় শিরোনাম ঝুলছে সেই তখন থেকেই, প্রেসিডেন্ট বড় কোন পদক্ষেপ নিচ্ছিলেন না। অর্থমন্ত্রীকে আটক করার পর মনে হ’ল, এইবার তিনি বুঝেছেন কঠোর হতে হবে হাতে নাতে, নইলে জনগণ ছাড়বে না। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফলাফল সামগ্রিক বিচারে সামান্যই। কেনিয়াত্তা আর তার ডেপুটি প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটোর ভেতর দূরত্ব তৈরি হয়েছে, যা দুর্নীতি বিরোধী কার্যক্রমের সাফল্য নিয়ে প্রশ্নের উদ্রেক করছে। ২০২২ সালের নির্বাচনে জয়ী হতে হলে তো বটেই, ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলেও কেনিয়াত্তার দরকার রুটোকে। এখন কেনিয়াত্তা কি দুর্নীতি বিরোধী লড়াই থামিয়ে দিয়ে রুটোর সাথে সম্পর্ক জোরদার করবেন? বিশ্ব অপেক্ষায় আছে এই প্রশ্নের উত্তর জানতে।
দুর্নীতি বিরোধী পদক্ষেপগুলো কেন সব সময় একই রকমভাবে জোরালো থাকে না, কেন পিঠে ছুরি বসে যায়, তার কারণ জানতে গবেষণা দরকার। কখনো কখনো দুর্নীতি প্রতিরোধের সাফল্যের মাঝেই জন্ম নেয় এর একান্ত নিজস্ব সমস্যা। দুর্নীতির তদন্তকারীগণ বিশেষ সুবিধার আশায় প্রতিরোধের যুদ্ধে উলটো পথে ঘোড়া দৌড়াতে শুরু করে। প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধালোভী দুর্বলতা জনগণকে বিভ্রান্ত করে ফেলে। গুয়াতেমালার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লাভ খুঁজতে গিয়ে দুর্নীতি-বিরোধী পদক্ষেপগুলোকে দমাতে গিয়ে দুর্নীতি বিরোধী কমিশনকে ডুবিয়ে দিয়ে সম্প্রতি দুর্নীতি-বিরোধী লড়াইয়ে পুরো ইউ-টার্ন নিলেন। সোজা পথে গিয়েও কি লাভ হয়? এল সালভাডোর’র অ্যাটর্নী জেনারেল ডগলাস মেলেন্দেজ সফল দুর্নীতি-বিরোধী পদক্ষেপের কারণে চাকরি হারিয়ে বসেছেন, কেননা দেশটির রাজনীতিবিদরা খুব ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ়-কঠোর থাকার পরও রাজনৈতিক বলৎকারের শিকার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। ভিয়েতনামের দুর্নীতি-বিরোধী ক্রুসেড’কে কি ভালো চোখে দেখা হচ্ছে? ভিয়েতনামের সমাজতান্ত্রিক পার্টিকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে গিয়ে পার্টিপ্রধান গুয়েন ফু ট্রং রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন, ৭৬ বছর বয়সী এই রাজনীতিবিদকে বাতিলের খাতায় পড়তে হয়েছে। সিয়েরা লিওনে দুর্নীতি-বিরোধী কমিশনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ দাঁড় করেছেন বিরোধী দলের রাজনীতিবিদগণ। ২০১৮ সালে নির্বাচিত হয়ে আসা প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস মাদা বাইও সাবেক প্রেসিডেন্ড আরনেস্ট বাই করোমা’র বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত শুরু করার আদেশ দিয়ে বিপাকে পড়েছেন। সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় গত এক বছর বাইও’কে নড়বড়ে চেয়ারে বসেই দেশশাসন করতে হয়েছে। সামনের দিনগুলো কেমন যাবে, কেউ বলতে পারছে না।
এতসব আলাপে কী বুঝলাম? গণতন্ত্রের জোরে ক্ষমতায় যাওয়া যায়, আর ক্ষমতায় গিয়ে দুর্নীতি করা যায়, এই আপ্তবাক্য মেনে নেব? কিন্তু ওদিকে যে গণতন্ত্রই দুর্নীতিবাজকে টেনে নামাতে পথে নামায় জনগণকে, সে কথা ভুলি কেমন করে? বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সৌন্দর্য যেন চলমান দুর্নীতি-বিরোধী লড়াইয়ের সাফল্য এনে দেয়, এই কামনা অন্তরের অন্তস্থল থেকে উৎসারিত হয় আপনাতেই।
লেখক : কথাসাহিত্যিক।
এইচআর/পিআর