শেখ হাসিনা : অসম সাহসী যে নারী
শেখ হাসিনা নামে যে রাজনীতিবিদ, নেতা ও প্রধানমন্ত্রী গত দশ বছর ধরে বাংলাদেশকে আগলে রেখেছেন পরম মমতায় ও এগিয়ে নিয়ে চলছেন হাজারো স্বপ্নের হাত ধরে, তাঁর জন্ম হয়তো ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর হয়নি; হয়তো ঠিক যে দিনটিতে স্বাধীন বাংলার ইতিহাসের পাতা খুললো সেদিনও নয়। হয়েছে ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্টে; সেই ভয়াল রাতে, অনেক মৃত্যুর ধ্বংসস্তূপে! দু'বেনি ঝুলিয়ে ধানমন্ডির মাঠে বাইসাইকেল ছুটিয়ে বেড়ানো, ইডেন ক্যাম্পাসে মিটিং-মিছিল মাতানো, মাত্র একুশ বছর বয়সে উদীয়মান বিজ্ঞানীর হাত ধরে স্বপ্ন দেখা মেয়েটি ঠিক সেই রাতেই বিপথগামী রাষ্ট্রনীতির ছাইস্তুপ থেকে আগুনা-ডানা মেলেছে; সেটি এই বাঙালি না দেখেছে, না ভেবেছে!
আগস্টের কনকনে ঠাণ্ডার রাত্রিতে ইউরোপের রাস্তায় কেঁদে ফেরা, দিল্লির রাজনৈতিক আশ্রয়ে সময়ের অপেক্ষায় থাকা, নিজ দেশে নিশ্চিত অনিরাপত্তা ও জীবন-ঝুঁকির তোয়াক্কা না করা মানুষটিই দীর্ঘ সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে উড়েছেন আলোর দিকে। সেই আলোয় বাংলাদেশ চিনেছে তার মুক্তির পথ। সেনা ও সাম্প্রদায়িক শাসনামলে অবরুদ্ধ হয়ে যাওয়া সমাজতান্ত্রিকতা, ধর্ম নিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ পুনরুদ্ধারের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেড় দশকের বেশি সময় রাজপথে আন্দোলন করে এবং একই সময়কাল রাষ্ট্রীয় প্রধানের ভূমিকায় থেকে দেশের মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির জন্য নিরলস কাজ করে যাওয়া সব হারানো মানুষটিই বাংলাদেশের ইতিহাসে সেই ফিনিক্স পাখিটি যাঁর একাধিকবার জন্ম হয়েছে তাঁকে হত্যা ও ধ্বংসের নীলনকশার ছাই থেকে।
অকল্পনীয় ষড়যন্ত্রে পুরো পরিবার নিহত হওয়ার পর তথাকথিত কাছের মানুষদের বিশ্বাসঘাতকতার সময়ে যে কোনো ব্যক্তিই সবার আগে নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা এবং ভবিষ্যৎ সুরক্ষার কথাই ভাবতো। অসম সাহসী পিতার কন্যা ভাবলেন দেশে ফেরার কথা, বাবার মৃত্যুর বিচার করা, ও দেশের মানুষের অধরা স্বপ্ন পূরণের কথা। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর অপেক্ষা করেছেন দেশে ফেরার জন্য, হারানো স্বজনের স্মৃতির অধিকার পাওয়ার জন্য, পিতৃ পরিচয়ে দেশের মানুষের কাছে আসার জন্য; তাদের সুখ-দুঃখের কথা শুনার জন্য। দৌড়ে গিয়েছেন মানুষের দুর্যোগে ও বিপদে। ভাবেননি নিজের সন্তানদের পড়াশোনা ও দেখভালের কথা, নিজের ব্যক্তিগত জীবনের সুখ-দুঃখের কথা। শুধু ক্ষমতার জন্য এতো আত্মত্যাগ দরকার হয় না। যে জীবন মানুষের, যে জীবন দেশের; সে জীবনে রাজনীতি ভোগেরও নয়, বিলাসিতারও নয়; বরং দায়িত্ব ও ভালোবাসার।
শুধু পরিবারই নয়, ১৯৮১ তে দেশের ফেরার পর থেকে তাঁকে হত্যা চেষ্টা হয়েছে সব মিলিয়ে ঊনিশ বার। কি না করেছে দেশি ও বিদেশী অপশক্তি স্বাধীনতার স্থপতির শেষ রক্ত বিন্দুটুকু বাংলার মাটি থেকে মুছে দিতে? প্রতিটি হত্যা চেষ্টা শেষে রূপকথার ফিনিক্স পাখির মতো নতুন করে জন্ম নিয়েছেন দেশকে নিয়ে আরো একটু এগিয়ে যাওয়ার জন্য। পঁচাত্তরে ভাগ্য জোরে বেঁচে যাওয়া সেই মেয়েটি আরো একবার জন্মেছে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট, গুলিস্তানে পার্টি অফিসের সামনে দুর্ধর্ষ গ্রেনেড হামলায় বয়ে যাওয়া রক্ত গঙ্গায়। এলো ২০০৭; সামান্য ভুলের জন্য যেন রাজনৈতিক মৃত্যুর আয়োজন করে তৎকালীন সেনা সরকার। মিথ্যে হত্যা ও দুর্নীতি মামলা দিয়ে প্রথমে কারাগারে ও পরে বিদেশ পাঠিয়ে চেয়েছিলো আরেকবার বাংলাকে নেতৃত্বশূন্য করে ক্ষমতার পালাবদল, দখলদারিত্ব ও রক্তের রাজনীতি ফিরিয়ে আনতে। বারবার মৃত্যু ও ষড়যন্ত্রকে কাছ থেকে দেখে শেখা মানুষটির রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ততদিনে বেড়েছে বহুগুণ। পড়াশুনা শেষ করে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়া ছেলেমেয়েদের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গঠনমূলক তৎপরতায় আরেকবার রাজনীতিতে পুনর্জন্ম হলো তাঁর।
সেই শুরুটি দিয়ে আজ অব্দি দেশকে নিয়ে নিজের বাবার দেখা স্বপ্ন ও যুগের প্রয়োজনের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে চলেছেন অবিচল ভাবে। চলার সবটুকু পথ মসৃণ ছিল না। পঁচাত্তর পরবর্তী সেনা শাসনকালে এদেশে দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা ও বিদেশী শক্তির ওপর নির্ভরতা এতগুণ বেড়েছে যে এগিয়ে যাওয়ার পথে অসংখ্য বাধা-বিপত্তি ও মৃত্যুর হুমকি সামলাতে হয় প্রায় প্রতি মুহূর্তে। তবুও থেমে নেই ষড়যন্ত্রকারী ও খুনিরা। মৃত্যুকে তোয়াক্কা না করে, বিদেশী পরাশক্তির রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে দেশকে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করে চলেছেন; দেশকে ভালোবাসার দায়িত্ব যেন তাঁর একারই! প্রতি মুহূর্তেই শঙ্কা; তাঁর অনুপস্থিতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও বিদেশী অপশক্তির অন্ধকার করালগ্রাস হয়তো আবার দেশকে আচ্ছন্ন করবে।
এমনই একাকী এক নারী সত্তার নির্মোহ ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক উত্থান, চড়াই-উৎরাই ও সফলতা-ব্যর্থতা শুধু দেখবার, বলবার বা শুনবার বিষয় নয় বরং অনুধাবন করার। আমাদের সমাজে প্রতিটি বঞ্চিত ও পীড়িত নারীর জন্য অনুসরণীয় এক আখ্যান। খুব ছোটবেলায় মা ও বেশ ক'বছর পর বাবাকে হারানো আমার ব্যক্তিগত জীবনেও তিনিই আদর্শ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ২০০৩ সালের ১৭ ই মে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে পল্টন ময়দানে তাঁকে দেয়া ছাত্রলীগের সংবর্ধনায় আমি তাঁর জীবনী পাঠ করেছিলাম! একই মঞ্চে খুব কাছ থেকে দেখা ও কথা বলার সুযোগ হয়েছিল সেদিন। "শুধু দুষ্টুমি করলে হবে না, খুব ভালো করে পড়াশোনা করতে হবে, নামকরা কেউ হতে হবে।"
শুনে মনে হয়নি দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধীদলীয় নেত্রী বলছেন; মায়ের মতো করেই বলা, যেটুকুর অভাব আমারই ছিল! এই কথাটুকু আমার সারাজীবনের অনুপ্রেরণা! গেলো বছর টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স প্রোগ্রামে "জেন্ডার ইক্যুইটি ইন ক্লাসরুম" কোর্সে 'লোকাল উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট' বিষয়ে বক্তৃতা করতে গিয়ে দেশের অর্থনীতিতে নারীশ্রমের অবদান ও সরকার প্রধানের ভূমিকার অবতারণা করলে আমার সহপাঠীদের উচ্ছসিত প্রতিক্রিয়া ছিল, "তাহলে তো তোমাদের প্রধানমন্ত্রী নিজেই সমগ্র নারী জনগোষ্ঠীর জন্য অনুপ্রেরণা! সেই তোমাদের নেতা!" আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি তিনিই আমাদের নেতা; তাঁর জীবনী হোক এদেশের সকল অবহেলিত, অসহায় ও স্বপ্নদ্রষ্টা নারীর শক্তি।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/জেআইএম