এত অধৈর্য কেন আমরা?
আমরা বাঙালি সম্ভব রকমের আবেগী এক জাতি। সম্ভব বললাম কারণ আমাদের দ্বারা এটা সম্ভব হয়েছে ইতিমধ্যেই। আমাদের আরেকটি গুণ হচ্ছে ধৈর্যের অভাব। আমরা হাজার বছরের জঞ্জালকে সইতে রাজি কিন্তু কেউ জঞ্জাল পরিষ্কারের দায়িত্ব নিলে তাকে উপযুক্ত সময়টা দিতে রাজি নই। ভাবছেন কেন বলছি এই কথা? এই যে ধরেন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ১৯৭১ সালে। এখন ২০১৯ সাল। মাঝের ৪৮ বছর গেলো। এর থেকে সাড়ে তিনবছর বাদ দিলে থাকে ৪৪ বছরের মত।
স্বাধীনতার পর যখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান জঞ্জাল সাফের কাজে হাত দিয়েছিলেন তখনকার ইতিহাস আমরা জানি। আর এতবছর পর যখন তাঁর কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবার হাতে ঝাঁটা তুলে নিলেন তখন এই আমরাই এতটা অধৈর্য হয়ে যাচ্ছি যে কাজটি করার জন্যও যে কিছু টাইমিং এর হিসাব থাকে সেটিকে স্বীকার করতে চাইছি না। শেখ হাসিনা তার পরিকল্পনার কথা সাম্প্রতিক অনেকগুলো বক্তৃতায় পরিষ্কার করে বলেছেন। তিনি কেন, কাদের বিরুদ্ধে এবং কেমন করে আগাবেন সেটিও বলেছেন। এখানে লুকানো ছাপানোর কোন ইস্যু দেখি না। জঞ্জাল পরিষ্কার করতে হলে আগে শুরু করতে হয় ঘর থেকেই আর তিনি সেটিই শুরু করেছেন। অথচ আমরা দিনের পর দিন সে কাজটির প্রশংসা না করি অন্তত দর্শকের ভূমিকাতেও নামতে নারাজ।
যারা আজকে কেন একে ধরা হচ্ছে না, তাকে ধরা হচ্ছে না বা এসব কেবলি “আই-ওয়াশ” বলে গলা ফাটাচ্ছেন তারা এতদিন কোথায় ছিলেন? ৭৫ এর পর থেকে যদি হিসেব করি তাহলে এর আগে আরও অনেকগুলো সরকার এসেছে গিয়েছে। তখন কেন তারা তাদের ধৈর্যের চ্যুতি ঘটান নি? কেন তারা রাস্তায় নামেন নি দুর্নীতি মানিনা বলে? অথচ আজকে যখন কেউ একজন সে দায়কে মিটানোর শপথ নিয়ে মাঠে নেমেছেন এবং এই লড়াইয়ে তিনি সম্পূর্ণ একক সেনাপতি সেটাও আমরা জানি তখন সমালোচনার ঝড়ে একেকজনের মুখে ফেনা উঠে যাচ্ছে। কেন? ৪৮ বছরের জঞ্জাল আপনি দশদিনেই কেন সমাধান চান? যেখানে আমাদের দেশে দুর্নীতিরোধে আন্তরিক মানুষের অভাব সেখানে যিনি দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছেন তাকে বরং সমস্তরকম সহযোগিতা করাই কি নাগরিক হিসাবে আমাদের দায়িত্ব নয়? যে যেই দায়িত্বে আছি আমরা যদি সেখান থেকেই নিজের চাওয়াটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি তবেইতো এই প্রচেষ্টার গতি দ্রুত হতে পারে। অন্যথা একসাথে সকল জায়গায় হাত দিয়ে লেজেগোবরে হওয়া ছাড়া কাজের কাজ কিছু হবে কি?
যারা বলছেন এসব হচ্ছে আই-ওয়াশ তারাই বা কেন বলছেন এসব? আমাদের মধ্যে কি নেতিবাচক দৃষ্টির লোকের সংখ্যা বেশি না সবকিছুতেই শেখ হাসিনার দোষ ধরা একটি ছোঁয়াচে রোগের লক্ষণ? বাস্তবে যারাই এই অভিযানে সন্দেহ প্রকাশ করছেন তাদের কেউই কিন্তু বিকল্প কোন রাস্তার কথা বলছেন না। অর্থাৎ, সমস্যার সমাধান চাইছেন কিন্তু যিনি সমাধান করার উদ্যোগ নিয়েছেন তার উপর আস্থা রাখতে চাইছেন না আবার নিজেরাও পথ বাতলে দিচ্ছেন না।
আমি একবার আম্মার সাথে রাগ করে রাতে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমার আম্মাও আর আমাকে আল্লাদ করে ডাকেননি ভাত খেতে। জিদ ছিলো দেখিয়ে দিব না খেয়ে। শেষমেষ ভোর রাতের দিকে আর না পেরে নাকে মুখে পান্তা ভাত আর ফ্রিজ থেকে বের করে ঠাণ্ডা তরকারি খেতে শুরু করলাম। ফলাফল সকাল থেকে আমার লুজ মোশন শুরু হয়েছিলো।
গল্পটা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, সঠিক সময়ে ভাত না খাওয়ার ফলে আমার পেটের ক্ষুধার পরিমাণ ছিলো অকল্পনীয়। সেই ক্ষুধা একবারে একসাথে মিটাতে গিয়ে বাধালাম পেটের পীড়া মানে বদহজম হয়েছিলো। বিষয়টা এমনি। সময়ের কাজ সময়েই করতে হয়। সেখানে মান অভিমানের কিছু নেই। আবার অসময়ে হলেও পরিমাণ ও হজমের শক্তি সামর্থ বিবেচনা করেই তবে পদক্ষেপ নিতে হবে না হয় বদহজম হয়ে পুরো প্রক্রিয়াটাই ভেস্তে যাবার সম্ভাবনা হতে পারে। আমি যখন ফেসবুকে দুর্নীতি বিরোধি অবস্থান জানিয়ে একটা পোস্ট দিলাম তখন দেখলাম নানাব্যঞ্জনের কমেন্ট আসা শুরু হলো। কেউ বললেন আমি তেলবাজি করছি, কেউ বললেন যতই শ্লোগান দেন লাভ হবে না। আবার কেউ বললেন এসব ধোঁকাবাজি, আপনি বোকা তাই এখনও আশা করেন।
এই যে একটা পোস্টের এত ধরনের কমেন্ট। এটাই হচ্ছে আমাদের মানসিকতা। আমি অবাক হয়ে দেখি কেবল। বাস্তবে আমরা সবাই চাই দুর্নীতি দূর হোক কিন্তু কেউই ধৈর্য রেখে অপেক্ষা করতে রাজি নই। কেন? পাল্টা প্রশ্ন যদি করা হয় যে আপনারা যারা হতাশা দেখাচ্ছেন তারা কি যার যার জায়গায় যথেষ্ট প্রতিবাদ নয় নিদেনপক্ষে নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্যটুকু ঠিকভাবে পালন করছেন?
জানি উত্তর আসবে এটা দেখার দায়িত্ব সরকারের বা অনেকে আবার বলবেন আমি একা ভালো হলেই কি দেশ ভালো হবে? আমাদের প্রতিটা জায়গায় দুর্নীতি ঢুকে আছে। এসব উত্তরের একটাই ক্লু আর সেটা হচ্ছে নিজের জায়গাটুকুকে বাদ দিয়ে অন্যের জায়গা ক্লিন করতে চাই আমরা। এভাবে কি একটা দেশ দুর্নীতিমুক্ত হয়? কোন দেশেই দুর্নীতি ১০০ ভাগ মুক্ত করা যায়নি। ছোট বড় অনেকধরনের অবস্থান নিয়েই দুর্নীতি অবস্থিত। আমি নিজেই যখন স্বার্থের জায়গায় নিজেকে সঠিক মনে করছি সেটাও একপ্রকারের দুর্নীতি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভয়েস অব আমেরিকার সাথে সাক্ষাৎকারে বলেছেন আমরা মসজিদের গিয়েও ফুটানি দেখাই। মানুষ যত বড় হয় তত হাম্বল হয়, নত হতে শিখে আর আমরা উলটো দেখাই। যার যত পয়সা তার তত গরম। প্রধানমন্ত্রীর কথাটুকুকে কয়জন আমরা মিথ্যা প্রমাণ করতে পারবো? কয়জন আমরা নিজেকে জাহির করা থেকে বিরত থাকি?
সুতরাং, আগে যেখানে শুরুটাই ছিলো না তখন শুরুটাই আমাদের জন্য দরকার ছিলো। আজকে রিক্সাওয়ালা থেকে হেলিকপ্টারওয়ালা সবাই দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। একজন রিক্সাওয়ালাও বিদেশী কাউকে পেলে ভাড়া নিয়ে ঠকাতে ছাড়ছে না। এটা চরিত্রের মধ্যে ঢুকে গেছে। এর থেকে পরিত্রাণ একদিনে হবে না। দুর্নীতি কেবল টাকা মেরে দিলেই হয় না। এটা যখন সংস্কৃতিতে রূপ নেয় তখন একজায়গা থেকে শুরু করা লাগে। দুই একটা রুই কাতলার শাস্তি হলে ভয়ের জায়গাটা শুরু হবে। কিছু দুর্নীতি প্রাকৃতিক নিয়মে নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায় যখন দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পায়। তাই এই মুহূর্তে দরকার আইনের শাসন ও দুর্নীতি বিরোধী একটা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের যেখানে কেউই কোন প্রকার দুর্নীতিকে আশ্রয় প্রশ্রয় দিবেনা বলে প্রতিজ্ঞা করবে।
অধৈর্য হলে সমাধান আসবে না বা হতাশাও সমাধান আনে না। যিনি শুরু করেছেন তার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রেখে নিজের জায়গাটুকুকে পরিষ্কারের শপথটাই পারে আমাদেরকে সমাধান দিতে।
লেখক : কলামিস্ট।
[email protected]
এইচআর/এমএস