জয় হোক সুশিক্ষার
বিদ্বানের কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও দামী! কী মূল্যবান কথা! কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সব বিদ্বানের কলমের কালি কি শহীদের রক্তের চেয়েও দামী? বিদ্যা সবসময় পূজনীয়। না এখানে একটু ভুল হলো। এটা হওয়া উচিত সুবিদ্যা সবসময় পূজনীয়। দেশে সাক্ষরতার হার সন্তোষজনক ভাবে বেড়েছে। এটা সত্য। কিন্তু সত্যিকার অর্থেই কি দেশে সুশিক্ষিত ভালো মানুষের সংখ্যা বাড়ছে? এ বিষয়টি গভীরভাবে ভাবা প্রয়োজন। শুরু করতে চাই একেবারে শুরু থেকে।
১. শিক্ষিত ডাক্তাররাই আমাদের "সি-সেকশন" শিখিয়েছেন, মায়েরা শিখেছেন কৌটার দুধ সম্পর্কে, আমরা করছি অতিরঞ্জিত অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার । আমাদের দেশে রেলওয়ে পুলিশ আছে, হাইওয়ে পুলিশ আছে, টুরিস্ট পুলিশও আছে কিন্তু দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সুস্বাস্থ্য সুরক্ষিত করার জন্য প্রয়োজন "স্বাস্থ্য পুলিশ"। যারা স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্ত জায়গায় অতন্দ্র প্রহরীর মতো কাজ করবে। আগে সুস্থ থাকতে হবে তারপর বাকি ভাবনা। গাড়ি আছে, বাড়ি আছে সুস্থতা নেই। শেষ! সব সুখ শেষ!
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট সবিনয় অনুরোধ থাকবে খাদ্য পরিদর্শকদেরকে পুলিশের এর মত ক্ষমতায়ন করতে এবং পাশাপাশি পর্যাপ্ত সংখ্যা বাড়াতে।
২. বিদ্যালয়গুলোতে সচরাচর সকাল আটটায় শিশু শ্রেণি, কেজি এবং নার্সারি এদের পাঠ শুরু হয়। ঘুম থেকে উঠে চোখ ডলতে ডলতে কার খেলতে ভালো লাগে, পড়তে ভালো লাগে? এত বিদ্যা দিয়ে আসলে হচ্ছেটা কী? দরকার তো সুবিদ্যার এবং সুস্থ মস্তিষ্কের। আমরা সবাই জানি সকালের নাস্তা শরীরের জন্য, ব্রেনের জন্য সর্বোপরি সুস্থতার জন্য অনেক বেশি জরুরি। সেটা অনেক সময় শিশুরা ঠিক মতো খেতে পারে না শুধু এই তাড়াতাড়ি বিদ্যালয় শুরু হওয়ার কারণে। কথা হচ্ছে সকাল আটটার পরিবর্তে শিশুদের বিদ্যালয় যদি একটু দেরিতে শুরু হয় তাহলে কি অসুবিধা হবে? অন্যদিকে বড় শ্রেণির সময় কিন্তু একটু দেরিতেই। এবিষয়ে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। এভাবেই বিরক্তি নিয়ে শিশুরা আস্তে আস্তে বড় হয়। অন্যদিকে বাবা-মায়ের চাপ তো আছেই।
৩. সবাইকে সোনা পেতে হবে। সোনা ছাড়া বাকি সব ফিকে, অচল! যাই হোক, এভাবে শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। লক্ষ্য একটাই চাকুরি।যদিও শত রকমের বিষয় কিন্তু পরীক্ষার পদ্ধতিটা অনেকটা একরকম। কেমন যেন অসামঞ্জস্যপূর্ণ! যাইহোক, গন্ডণ্ডগোলটা এইখানেই। যারা পুরা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে খুব মনোযোগের সাথে, নিজ বিষয় পড়াশোনা করে তারা চাকুরি ক্ষেত্রে অনেকটা অসহায় হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে কি হয় যখন এই মেধাবী ছেলে মেয়েরা আশানুরূপ ফল পায় না তখন তারা অনেক সময় ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতে উদ্যত হয়। এগুলো একদিকে যেমন পারিবারিক, সামাজিক, এবং জাতীয় অর্থের অপচয় অন্যদিকে তাদের নৈতিক স্খলন।। কি দরকার তাহলে এসব বিদ্যার?
নতুন বিষয় খোলা বা নতুন বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেয়ার ব্যাপারে আরো বেশি সিলেক্টিভ হওয়া প্রয়োজন। এই ধরুন রেডিমেড গার্মেন্টস সেক্টর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনেক ভূমিকা রাখছে কিন্তু দেশে কয়টি টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় আছে?
৪. ধরে নেয়া হয় দেশের সবচেয়ে ভালো ছাত্র ছাত্রীরা দেশের বাইরে পড়াশোনা করতে যায়। তাদেরকে কি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সুযোগ দেয়া যায় না? এমন হলে শিক্ষার গুণগত মান বাড়বে না কমবে? নিশ্চয়ই কমবে না।
কিন্তু চিন্তা তো ভিন্ন মনে হচ্ছে। আমদানি নীতিমালা। আমরা তো সবাই জানি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বয়ংসম্পূর্ণ নীতিতে বিশ্বাসী। আমদানি নীতিমালা নয়। যা আমরা অনেক ক্ষেত্রেই দেখেছি।
মাতৃভূমিকে ভালবাসে না এমন মানুষ আছে নাকি? সুযোগ দিলে তারা অবশ্যই দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। হোক না তাদের বয়স ৩৫ বা ৪০।
৫. সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাজ কী এই প্রশ্ন নিয়ে অনেক কিছু হয়ে গেল। এ প্রশ্নও তো অবান্তর নয় যে একজন শিক্ষকের কাজ কী? দুঃখজনকভাবে দেখা যায় অনেক সময় একজন শিক্ষক তার দায়িত্বের বা নীতির বাইরে গিয়ে উল্টাপাল্টা কাজ করে বসে। কিছুদিন আগে একটা নাটক দেখলাম, হ্যাশট্যাগ যেখানে শিক্ষক দ্বারা সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট দেখানো হয়েছে।
এই থিম নিয়ে মনে হয় আগে তেমন নাটক হয় নাই কিন্তু এখন গণমানুষের সামনে এগুলো দেখানো হচ্ছে বিষয়টা একজন শিক্ষক হিসেবে আমাদের জন্য খুবই লজ্জাস্কর। এমন কেন হচ্ছে? আমরা কেন শিক্ষক হয়ে থাকতে পারছিনা? কেন এমন নৈতিক অবক্ষয়? কেন আমরা ভালো গল্পের উপকরণ হতে পারছিনা?
অন্যদিকে, যদি রাজনীতির কথা বলি তাহলে কোন শিক্ষক যদি কোন রাজনৈতিক ছাতার নিচে থেকে রাজনীতি করতে চান তাহলে তো তাকে শিক্ষা ও গবেষণা পরিষদের জায়গায় রাজনীতি করা উচিত। নীল দল, সাদা দল, সবুজ দল, বা ফোরাম শিক্ষকদের জন্য কি খুব বেশি প্রয়োজন? একজন নবীন শিক্ষক যখন দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি করলে ভালো জায়গা বা পদ পাওয়া যায় তখনই আসলে সর্বনাশ এর সূত্রপাতটা হয়। যে পেশাটি সবচেয়ে বেশি শুভ্র এবং বিশুদ্ধ হওয়া প্রয়োজন সেটা হচ্ছে শিক্ষকতা পেশা যা কিনা সমস্ত প্রক্রিয়া বা পদ্ধতির সূতিকাগার।
৬. সম্প্রতি একজন শিক্ষক বলেছেন ছাত্রদের "তুমি" করে বলা নাকি যৌন নিপীড়নের চাইতেও বড় নির্যাতন। কথাটা শোনার পর থেকে কেমন যেন দ্বিধান্বিত হয়ে যাচ্ছি। আমাদের দেশের সংস্কৃতি অনুযায়ী তো আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের কে স্নেহ করে তুমি বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি এবং ছাত্র-ছাত্রীদের কাছেও এটা শ্রুতি মধুর লাগে বলে মনে করি ।
কেন ছাত্র-ছাত্রীদেরকে আপনি আপনি বলে শিক্ষক এবং ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে দূরত্ব তৈরি করতে হবে? এগুলো আসলে কিসের প্রতিফলন ? আমাদের নৈতিকতার জায়গায় কি আমরা ঠিক থাকতে পারছি না? নাকি আমরা ছাত্রছাত্রীকে দূরে রাখতে চাচ্ছি? এই দুইটার কোনটাই তো শুভকর মনে হচ্ছে না।
৭. এই যে দেশে ভেজাল খাদ্যের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে তা হচ্ছে বিশুদ্ধ খাদ্যের জন্য, সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য। তেমনি কি কুশিক্ষকের বা ভেজাল বা দূষিত শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযান বা মিশন দরকার নেই?
ভেজাল খাদ্য যেমন সমস্ত শরীরে খারাপ জীবাণু বা অসুখের স্তুপ করে তোলে তেমনি কুশিক্ষক বা ভেজাল শিক্ষক বা দূষিত শিক্ষকেরা সমানভাবে সমাজের ভেতর সামাজিক অবক্ষয় এর বীজ বপন করে।
দুঃখ লাগে যখন দেখি একজন শিক্ষক শিক্ষার প্রকৃত মন্ত্রে দীক্ষিত না হয়ে তার নিজের তৈরি কুমন্ত্র বা দূষিত মন্ত্র দিয়ে চলে আবার অনেকে রাজনীতিবিদ কাম শিক্ষক হয়ে যায় তখন আসলে একজন শিক্ষক হিসেবে অস্বস্তি লাগে।
যাইহোক, খাদ্যে ভেজাল যেমন সবাই করে না তেমনি শিক্ষায় ভেজালও সবাই করে না কিন্তু গুটিকয়েক নীতিহীন বিচ্যুত মানুষের জন্য আসলে পুরো সম্প্রদায়ের বা পুরো সিস্টেমটাতেই দাগ লেগে যায়।
এখন প্রশ্ন থাকতে পারে যে শিক্ষকরাও তো মানুষ । ঠিক আছে।
তবে কেউ যদি এই মহান পেশায় আসতে চায় তবে তাকে মানব না "সুপার মানব" হতে হবে। এই মর্মে আগে অঙ্গীকার বা সত্যিকারের ডিভোশন থাকতে হবে তবেই তার শিক্ষকতা পেশায় আসা উচিত। শিক্ষক হবে বিশুদ্ধতার প্রতীক। শিক্ষক নামের মধ্যে থাকবে পবিত্রতার ছোঁয়া।
আমার মেয়ের সাথে রিকশায় করে বাইরে ঘুরতে গিয়েছিলাম। রিক্সাওয়ালার সাথে কথা হচ্ছিল। কথায় কথায় এক পর্যায়ে উনি বললেন আপা ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত না করাই ভালো। কি হবে এত শিক্ষিত কইরা? যত শিক্ষা ততো খারাপী।
আমিতো ভয় পেয়ে গেলাম কারণ আমার মেয়ে কথাটা শুনে ফেলেছে সে আবার খুবই সংবেদনশীল।
মনে মনে ভাবলাম আচ্ছা উনি কি তাহলে উনার সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠাবেন না? শিক্ষিত করবেন না? ভাবা যায় "শিক্ষা" সাধারণ মানুষের কাছে কোন পর্যায়ে চলে গিয়েছে!
আসলেই তো তাই । কুশিক্ষার চেয়ে অশিক্ষাই ভালো। দোয়া করি আমাদের সন্তানেরা যেন শিক্ষিত না হয় হইলে যেন সুশিক্ষিত হয়।
আমরা শিক্ষকেরা কি এই সব সাধারণ মানুষদের কাছে ভালো প্রভাবক হতে পারিনা? শিক্ষার সুগন্ধ, সুবাতাস, সুফল কি আমরা ছড়িয়ে দিতে পারি না সবার মাঝে?
জয় হোক সুশিক্ষার।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ফলিত পুষ্টি ও খাদ্য প্রযুক্তি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।
[email protected]
এইচআর/এমএস