পূজা এলেই কেনো উদ্বেগ বাড়ে?
আমরা কথায় বলে থাকি, ধর্ম যার যার উৎসব সবার। আমাদের দেশে ধর্মকে ঘিরে যেসব বড় বড় আয়োজন হয়ে থাকে সেসব ক্ষেত্রে আমরা তা দেখেও থাকি। ধর্মীয়ভাবে উৎসবটি হয়তো নির্দিষ্ট একটি সম্প্রদায়ের কিন্তু সেখানে সব ধর্মের মানুষ সামিল হয়ে সেটিকে উৎসবে পরিণত করেছে বা সাফল্যমণ্ডিত করে তুলেছে। একদিকে এটা যেমন ঠিক আবার অন্যদিকে কোথায় যেন একটা সাম্প্রদায়িক বিষবাস্প ছড়িয়ে আছে। কোথায় যেন কিছু মানুষের মধ্যে অসভ্যতা লুকিয়ে আছে। যারা মানুষকে ঠিক মানুষ হিসেবে গণ্য না করে একটা নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে আবদ্ধ রাখতে চান এবং এরা কথায়, কাজে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেটির বহিঃপ্রকাশও ঘটান বেশ কুসিৎতভাবে। এদের কারণেই হয়তো নানা উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় কাটাতে হয় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের। সেটা আমাদের দেশে যেমন ঠিক তেমনি আমাদের এখানে যারা সংখ্যাগুরু কিন্তু অন্যদেশে সংখ্যালঘু তাদের জন্যও ঠিক।
আমাদের দেশে এমনিতে সারা বছরই সংখ্যালঘুদের ওপর নানাস্থানে ছোটবড় হামলা, নির্যাতন হয়ে আসছে। এগুলোর প্রতিকারও হয়। আবার স্থানীয় সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে প্রশাসনও সংখ্যালঘুদের যে সুরক্ষা দেয় না তা নয়, এরপরও অনেক সময় মারাত্মক মারাত্মক ঘটনা ঘটে। তাই হয়তো হিন্দুদের দেয়া খাবার প্রসাদ বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে আবার প্রিয়া সাহার মতো একজন ট্রাম্পের কাছে নালিশ জানায় নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে। আবার একটি বিষয় লক্ষ্য করতে বোঝা যায়, পূজা এলেই বেশি করে বাড়ে উদ্বেগ। এই বুঝি কিছু হয়ে গেলো। এই বুঝি হিন্দুদের বাড়ি ঘরে হামলা হলো, এই বুঝি রাতে দুর্বৃত্তরা মূর্তি ভাঙলো। এই বুঝি পূজা করতে বাধা দিলো। এমনিতে বর্তমান সরকার সংখ্যালঘুদের প্রতি অনেকটাই উদার। কিন্তু এরপরও কেনো এই উৎকণ্ঠা?
পূজা উদযাপন পরিষদ ৩০ সেপ্টেম্বর যে সংবাদ সম্মেলন করেছে সেখানে বলা হয়েছে, এবারে সারাদেশে মোট ৩১ হাজার ৩৯৮টি মণ্ডপে পূজা হচ্ছে। যা গেলো বারের চেয়ে ৪৮৩টি বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে চট্টগ্রামে। সর্বোচ্চ ১ হাজার ৭৭৪টি। সবচেয়ে কম বরিশালে। কিন্তু উদ্বেগের কথা তারা যেটি জানিয়েছে, এরই মধ্যে টাঙ্গাইল, মির্জাপুর, সাতক্ষীরার ঘোষপাড়া, ঝালকাঠি সদর এবং চাঁদপুরের পুরানবাজারসহ ১১টি স্থানে মূর্তি ভাংচুর ও হামলার ঘটনা ঘটেছে। আসলে, প্রতিদিন খবরের পাতায়, অনলাইনে, টিভি চ্যানেলসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে কত-শত খবরই আসে। আবার জীবন পাতার, জীবনঘনিষ্ঠ এমন কত খবরই প্রকাশ পায় না। হয়তো এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে সেসব খবর আমরা পাই। সাংবাদিক মাত্রই জানেন, এমন অধিকাংশ খবর সাধারণত জনগণের খবর হয়ে উঠে না। কারণ অনেকেই মনে করেন, এ ধরনের সংবাদ প্রকাশ হলে তা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। এটা সত্য। তাই মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলো এগুলো প্রকাশ করে না। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ইনবক্স, মুঠোফোনে যেসব ঘটনার বর্ণনা শুনি, তাতে শিউরে উঠতে হয়। কারা করে এসব, কেন করে? কী তাদের লক্ষ্য।
আটচল্লিশ বছরের বাংলাদেশ জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনেকটাই হয়তো এগিয়েছে, কিন্তু সভ্যতায়, সমাজ বিনির্মাণে, মানুষের জানমালের নিরাপত্তায় ততটাই পিছিয়েছে বৈকি! কয়েকমাস আগে জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ দাবি করে, চলতি বছরের প্রথম চার মাসে (জানুয়ারি থেকে এপ্রিল) বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর ২৫০টি হামলা, নির্যাতন ও হত্যাসহ নানা ধরনের হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে। ২০১৮ সালে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে ৮০৬টি। ফলে এটি স্পষ্ট যে, চলতি বছরের শুরু থেকেই সংখ্যালঘু নির্যাতন বাড়ছে। এই চার মাসে হত্যার শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ২৩ জন। হত্যাচেষ্টার শিকার হয়েছেন ১০ জন। হত্যার হুমকি পেয়েছেন ১৭ জন এবং শারীরিক আক্রমণের শিকার হয়েছেন ১৮৮ জন। ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ৩ জন এবং সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৫ জন। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়ি ঘরে লুটের ঘটনা ঘটেছে ৩১টি, বাড়ি ঘর ও জমি জমা থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন ১৬২ জন, দেশত্যাগের হুমকি পেয়েছেন ১৭ জন। এর বাইরে অপহরণ, মন্দির দখল, মূর্তি চুরি, জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করার ঘটনাও ঘটেছে।
ঐক্য পরিষদ আরও জানাচ্ছে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার ঘটনা ঘটেছিল ১ হাজার ৪৭১ টি। ২০১৭ সালে তা কমে হয়েছিল ১ হাজার ৪টি। ২০১৮ সালে আরো কমে ৮০৬টি। কিন্তু চলতি বছরের শুরু থেকে তা আবারও বাড়তে শুরু করেছে। কেন এমনটি হচ্ছে? যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশের স্বপ্ন মুক্তমনা মানুষ দেখে এসেছে, বক্তৃতা, বিবৃতিতে যে চেতনার কথা আমরা বলি বা স্বয়ং রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান যেটির স্বপ্ন দেখান, আশ্বাস দেন সেই চেতনা থেকে মনে হচ্ছে আমরা ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছি। এতে করে হয়তো সাময়িক লাভবান হচ্ছে কেউ কেউ। কিন্তু সভ্যতার সংকটের দিকে যে এগিয়ে যাচ্ছি তা কখনও পূরণ হওয়ার নয়। যারা এসব করছে তারা কিন্তু অনেক গভীরভাবে ভেবে এসব করছে। এর অর্ন্তগত তাৎপর্য রয়েছে। কাজেই বিষয়টি হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। এই দুর্গাপূজা এলেই আমরা বলি, প্রশাসন নিরাপত্তার ব্যপারে সর্বোচ্চ আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু কথা হলো প্রশাসনের আশ্বাস লাগবে কেনো? নিজেরাই যদি অন্ধ আর কূপমণ্ডুক না হই তবেতো অন্য ধর্মের ওপর আঘাত করার কথা নয়। তাহলে দেশে এসব ভণ্ডদের সংখ্যাই বাড়ছে। সেটিই কি তাহলে সবসময় সত্য, ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম।’
তবে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন এসবের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ। সেটি হলে সরকার বা রাজনীতিবিদরা বিষয়টি নিয়ে ভাবতে বাধ্য হতো। এ কথা তো ঠিক যে, যাদের সংখ্যাগুরু ভাবা হচ্ছে তাদের বেশিভাগই ভালো। এদেশে দীর্ঘদিন ধরে তো সব ধরনের মানুষ একসঙ্গে বাস করে আসছে। ধর্মীয় সম্প্রীতি তো আমাদের দেশে ছিলই। তাই বলতে হয়, ভালো মানুষের সংখ্যাই বেশি। এদের সময়ে অসময়ে দাঁড়াতে দেখেছি সংখ্যালঘুদের পাশে। কাজেই নিজেরা সংগঠিত হতে পারলে, নিজেদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হতে পারলে সমর্থন পাওয়া যাবে তাদেরও। তবে আবার এমনটি ভাবাও ঠিক হবে না যে, প্রবল প্রতাপে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা অত্যাচারিত হয়ে আসছে। বরং এলাকাভিত্তিক বাদ দিলে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য উদাহরণ বেশি। তাই একদিকে পূজা মণ্ডপের সংখ্যা বাড়ায় উৎসবের আমেজ যেমন আমাদের আনন্দ জোগায় তেমনি আবার উৎকণ্ঠা বাড়ে। সব মণ্ডপে পূজা হবে তো? কেউ আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবে না তো? এই উদ্বেগ দূর করার দায়িত্ব কিন্তু সরকারের। তবেই সনাতন ধর্মের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হবে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার আনন্দে কাটানো সময়।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।
এইচআর/পিআর