ক্যাসিনোর পেছনে কারা, তারা কি পড়বে ধরা?
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করছে, কই যাস?
- ক্যাসিনোতে, যাবি? হাসতে হাসতে উত্তর দিলো বন্ধুটি। রসিকতায় বলছে, চল্ দেখি, ওদের মতো আমাদেরও কোটি টাকা আসে কি না।
সম্প্রতি চতুর্দিকে চলমান ক্যাসিনো অভিযানে উঠতি তরুণ-তরুণীদের থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সেই এই ধরনের হাস্য-রসাত্মক সাওয়াল-জওয়াব চলছে। আবার কেউ ভ্রু কুঁচকে চোখ ছানাবড়া করে ভাবছে, এতো টাকা কিছু মানুষের হাতে!!
হঠাৎই দেশবাসীর চক্ষু ক্যাসিনোর চড়কের মতোই ঘুরছে। কারণ জুয়ার আসরের কথা প্রায়শই গণমাধ্যমে আসে, কিন্তু এরকম মেট্রোপলিটন সিটির ভেতরে বিভিন্ন ক্রীড়া সংগঠনে জমজমাট ক্যাসিনো ব্যবসার নামে কোটি কোটি টাকার খেলা- সাধারণের তাজ্জব হওয়ারই কথা। অবৈধ হিসেবে বিবেচ্য ক্যাসিনো বাণিজ্য বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানেও নিষিদ্ধ। যদিও পরবর্তীতে এ বিষয়ে আর নতুন কোনো আইন হয়নি। তাই সেই ১৮৬৭ সালের প্রকাশ্য জুয়া আইন দিয়েই চলছে দেশ। তবে মেট্রোপলিটন সিটির জন্য একটি অর্ডিন্যান্সে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া আছে।
পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোর পাশাপাশি আমাদের কাছের দেশ সিঙ্গাপুর, ম্যাকাও, থাইল্যান্ড, এমনকি নেপালেও ক্যাসিনোর জনপ্রিয়তা আছে। তাদের অনুসরণে আমাদের দেশেও হাজার রকমের জুয়া খেলার যন্ত্রপাতির সমাহার না হলেও স্লট মেশিন কম-বেশি সব ক্লাবে পৌঁছে গেছে গত ৫/৬ বছরে। এতে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে- প্রশাসনের নজর এড়িয়ে কিভাবে এটা সম্ভব হয়েছে? আমরা দেখেছি, পুলিশেরই ঊর্ধ্বতনদের কেউ কেউ বিস্মিত হয়ে বলেন, ক্লাবগুলো একেবারে জুয়া খেলার হাউজে রূপান্তর হওয়ার আগেই পুলিশের ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল। তবে পুলিশ বলছে, জুয়া খেলে জানতেন তারা, কিন্তু ক্যাসিনো আছে, সেটা নাকি জানতেন না! আবার অনেক পুলিশ সদস্য এই ক্যাসিনোগুলো থেকে টাকার ভাগ পকেটে পুরে, চোখে ঠুলি পড়ে থাকতেন বলেও জানা গেছে। অবশ্য এরকম তথ্য-প্রমাণ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে বলেও মনে করছেন প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরা।
দুর্নীতি বিরোধী চলমান তৎপরতার প্রথম দিনেই ঢাকার মতিঝিল এলাকায় চারটি অবৈধ ক্যাসিনোতে অভিযান চালিয়েছিল র্যাব। সেই ক্যাসিনোগুলোর অল্প দূরত্বেই ছিল থানা বা পুলিশ স্টেশন- এই বিষয়টি এখন উদাহরণ হিসেবে অনেকেরই মুখে মুখে। এসব ঘটনায় সুশীল সমাজও বলছেন, ঢাকায় ক্যাসিনো চলার বিষয়ে পুলিশ বা প্রশাসনের কেউ কিছুই জানতো না, এমন বক্তব্য আরও প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। কারণ এটা বিশ্বাসযোগ্য নয় যে, এটা পুলিশ বা প্রশাসনের নজরের বাইরে হয়েছে। এখানে পুলিশ প্রশাসনের দায়িত্বে অবহেলার প্রশ্নটাও চলে আসে বৈকি।
২০০০ সালের দিকে, মূলত: তাইওয়ানের একটি দল এদেশে পানশালা-কাম-রেস্তোঁরা চালু করে। এরপর থেকেই এর বিস্তার শুরু এই দেশে। তাই একদিনে যে এর বিকাশ হয়নি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে আশার কথা এই যে, দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এখনও বিভিন্ন ক্লাব এবং অবৈধ ক্যাসিনো বা জুয়া বাণিজ্যের দিকে। পুলিশী অভিযানের পাশাপাশি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সন্দেহভাজন অনেকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছে।
আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের যৌথ অভিযানে বুঝা যাচ্ছে, স্পোর্টস বাদ দিয়ে ক্লাবগুলো মজে আছে জুয়ার এমন আয়োজনে যার আধুনিক নাম ক্যাসিনো। ক্লাবগুলোর নিয়ন্ত্রণের ভূমিকাতেও আর খেলোয়াড় কিংবা সংগঠকরা নেই, আছেন রাজনীতিক বা প্রভাবশালীদের কেউ কেউ, যাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের অভিযোগ আসছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহল থেকেই। রাজনীতিকদের কেউ কেউ এর পক্ষে সাফাই গাইলেও ভিন্ন মত পোষণ করেন সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। গণমাধ্যমে তিনি বলেন, দুর্নীতি বিরোধী অভিযান সাফল্য পাবে না। এর কারণ হিসেবে মেনন জানান, পুরো ব্যবস্থার শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে সর্ব স্তর দুর্নীতির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গেছে।
শুধু মেননই নন, ক্যাসিনো বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন সচিব মুহিবুল হক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। পর্যটন সচিব জানান, বিদেশিদের জন্য পর্যটন এলাকায় বৈধ ক্যাসিনো সুবিধা চালুর চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার। তবে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ক্যাসিনোর বৈধতা দেয়ার বিষয়ে সরকারের উচ্চমহলে কোন আলোচনা বা সিদ্ধান্ত হয়নি। এদিকে, চট্টগ্রামে হুইপ সামশুল হক ক্যাসিনো ব্যবসার পক্ষেই সাফাই গাইলেন। ক্লাব চালানোর জন্য নাকি ক্যাসিনোর আবশ্যকতা আছে।
শুধু কি তাই, ক্যাসিনো ব্যবসার সাথে জড়িত কয়েকজন নেপালীরও সন্ধান মেলে এই অভিযানে। জানা গেছে, নেপাল থেকে প্রশিক্ষিত নারী ও নিরাপত্তা কর্মীও নিয়ে আসে কয়েকটি ক্যাসিনো। যদিও জুয়া খেলা বলতে স্লট মেশিন, বাকারা আর রুলেটই প্রধানত এখানে খেলা হয়। তবে যেটুকুনই হোক, প্রশ্নটা তো ঠিক-বেঠিকের।
সাম্প্রতিক এসব অভিযানে কিছু মানুষকে আটক করা হয়েছে। জব্দ করা হয়েছে ক্যাসিনোর সরঞ্জাম। কিন্তু প্রশ্ন হলো- জুয়া খেলার মেশিনগুলো কারা আমদানির অনুমতি দিয়েছে? কোন আইনে দিয়েছে? খুঁজে দেখা উচিত নয় কি, এই অবৈধ ক্যাসিনোকে চালাতে কারা বৈধতা দিয়েছে বা সহযোগিতা করেছে আর লাভবানই হয়েছে কারা?
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, বাংলাভিশন।
এইচআর/জেআইএম