ইলিশ পলিটিক্যাল ফিশ

আমীন আল রশীদ
আমীন আল রশীদ আমীন আল রশীদ , সাংবাদিক, কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৯:৫৯ এএম, ০১ অক্টোবর ২০১৯

ইলিশ বস্তুত একটি ‘পলিটিক্যাল ফিশ’ বা ‘রাজনৈতিক মাছ’। সাত বছর পরে ভারতে ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছে সরকার। দুর্গাপূজা উপলক্ষে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত ৫০০ মেট্রিক টন ইলিশ পাঠানো যাবে। এটি কলকাতার লোকদের জন্য অবশ্যই ভালো খবর।

যে পাঁচশো মেট্রিক টন ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দেয়া হয়েছে, ধরে নেয়া যায় যে এর একটা বড় অংশই যাবে পশ্চিমবঙ্গে, আরও পরিষ্কার করে বললে কলকাতায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেখানে কতজন মানুষের পাতে এই ইলিশ উঠবে, যেখানে বাংলাদেশের অধিকাংশ লোকই এই মাছ খেতে পারে না এর আকাশছোঁয়া দামের কারণে?

২০১২ সালের পয়লা আগস্ট ইলিশসহ সব ধরনের মাছ রপ্তানি নিষিদ্ধ করে সরকার। পরে ওই বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর ইলিশ ছাড়া অন্য সব মাছ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হলেও ইলিশের ওপর নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকে। তবে গত বছরের জানুয়ারিতে তৎকালীন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, পাচার বন্ধে জাতীয় মাছ ইলিশ রপ্তানির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হবে। তিনি বলেন, যেহেতু উৎপাদন হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদাও আছে, সেজন্য সরকার কিছুটা রপ্তানি করতে চায়। কেননা মন্ত্রীও এটি স্বীকার করেন যে, রপ্তানির অনুমতি না দিলেও ইলিশ মাছ বিভিন্নভাবে চোরাইপথে দেশের বাইরে চলে যায়। ফলে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয় রাষ্ট্র। তাই রপ্তানির সুযোগ দেয়া হলে পাচার বন্ধ হবে।

প্রশ্ন হলো,ভারতে ইলিশ গেলেও সেগুলো কাদের পাতে উঠবে? কলকাতার সাধারণ মানুষ বাংলাদেশিদের তুলনায় এমনিতেই বেশ হিসেবি। বাংলাদেশের মানুষ যেমন হালিদরে ইলিশ কেনে, কলকাতার অধিকাংশ মানুষ সেটি কল্পনাও করে না। কিন্তু এই শহরে গড়ে উঠেছে আহেলী, ভোজ কোম্পানি, ভজহরি মান্নার মতো দামি রেস্টুরেন্ট। সেসব রেস্টুরেন্টের একটা বড় খরিদ্দার বাংলাদেশ থেকে যাওয়া মানুষেরাই। ফলে ধরেই নেয়া যায় যে, এবার পূজা উপলক্ষ্যে বৈধ পথে যে পাঁচশো মেট্রিক টন ইলিশ যাবে, তার একটা অংশ গিয়ে উঠবে এইসব অভিজাত রেস্টুরেন্টের কিচেনে এবং অন্য মাছের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি দামে কিনে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলবেন রসনাবিলাসিরা।

বিষয়টি নিয়ে কথা বলি কলকাতার সাংবাদিক শুভজিৎ পুতোতুন্ডোর সঙ্গে। তার ভাষায়, ৫০০ মেট্রিক টনের খুব সামান্য অংশই সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে আসবে। বাকি সব যাবে নেতাদের বাড়িতে পুজোর উপহার হিসেবে। আর যে সামান্য ইলিশ ভাইফোঁটার আগে কলকাতার বাজারে আসবে, সেগুলো রীতিমতো নিলাম করে বিক্রি হবে। শুভজিত এটিও ইঙ্গিত করলেন যে, প্রতি বছর মমতার বাড়িতেও যে পরিমাণ ইলিশের বাক্স যায়, তাও বিস্ময়কর। শুভজিতের এই কথা শোনার পরে মনে হলো, আমাদের দেশেও নেতা, মন্ত্রী ও এমপিদের বাসায় বাক্সভরে এরকম মাছ যায় নিয়মিত। একাধিক নেতাকে আমরা চিনি যারা নেতা হওয়ার পরে সম্ভবত নিজের পকেটের পয়সায় আর মাছ কেনেননি।

ইলিশ যে দুদেশের সম্পর্ক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে তার আরেকটি প্রমাণ, ভারতের যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বাংলাদেশে এলে তাকে আপ্যায়নে আর যাই থাক বা না থাক, ইলিশের একাধিক পদ রাখাই হয় এবং ভারতের লোকেরাও এটা প্রত্যাশা করেন। সবশেষ ২০১৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বাংলাদেশে এলেন, তখন তার সামনেও ইলিশের পাঁচটি আইটেম রাখা হয়েছিল। তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন যে তারা রাজ্যে পর্যাপ্ত ইলিশ পান না। তখন এর জবাবে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, পানি এলে ইলিশও যাবে। তিনি তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যুকে ইঙ্গিত করেছিলেন। চার বছর পরে সম্প্রতি রাজ্য বিধানসভায় মমতা এই কথার জবাব দিয়ে বলেছেন, ‘বাঙালি মাছে-ভাতে থাকতে ভালোবাসে। কিন্তু বাংলাদেশকে আমরা তিস্তার জল দিতে পারিনি। তাই ওরা আমাদের ইলিশ মাছ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।’ ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির আগে-পরেও কূটনৈতিক আলোচনায় ইলিশের প্রসঙ্গ ছিল।

এখন প্রশ্ন হলো, ইলিশ না খেলে কী হয়? আমি ইলিশের দেশের লোক। কিন্তু কোনোকালেই ইলিশের প্রতি খুব বেশি আকর্ষণ বা ফ্যাসিনেশন ছিল না। পেলে খাই, না খেলে নাই- এই তত্ত্ব। এতে লাভ দুটি; ১. উচ্চমূল্যের কারণে ইলিশ কিনতে না পারার আক্ষেপ থাকে না এবং ২. পেলে খাই না পেলে নাই- এই থিওরি সবাই প্রয়োগ করা শুরু করলে বাজারে ইলিশের চাহিদা কমবে এবং সে কারণে দামও মানুষের নাগালে চলে আসবে।

এখন ইলিশের দাম আকাশচুম্বি হওয়ার মূল কারণ এর প্রতি মানুষের মাত্রাতিরিক্ত আকর্ষণ ও মোহ। ব্যবসায়ীরা এই সুযোগটিই নেয় যে, দাম যতই হোক, একটি মাছও অবিক্রিত থাকবে না। এখন কেউ হয়তো পাল্টা প্রশ্ন করবেন যে, যদি বাজারে চাহিদা কমে তারপরও ইলিশের দাম কমবে না। কারণ দেশে পয়সাওয়ালা মানুষের সংখ্যা এত বেশি যে, দাম মোটামুটি কমলে তখন পয়সাওয়ালা মানুষেরা প্রচুর পরিমাণে ইলিশ কিনে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখবেন সারা বছর খাওয়ার জন্য। যেহেতু মুক্তবাজার অর্থনীতি পয়সা থাকলেই সবকিছু কেনার সুযোগ দেয়। ফলে আমরা যখন ইলিশের রাজনীতি ও কূটনীতি নিয়ে কথা বলি, তখন এর বাজারসংস্কৃতি নিয়েও কথা বলা দরকার।

একটা ছোট্ট ঘটনা দিয়ে লেখাটা শেষ করি। ২০১২ সালে লালমনিরহাট শহরের ফুটপাতে কয়েকটি সুন্দর আতা দেখে দাম জিজ্ঞেস করি। বয়স্ক দোকানি বললেন প্রতিটি ১০ টাকা। বললাম সবগুলো দেন। তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি সব নিয়ে গেলে অন্যরা কী খাবে? আপনি দুটি নিতে পারেন।’ মফস্বল শহরের একজন অতি সাধারণ মানুষের এই যে বাজার অর্থনীতির বোধ এবং মানুষের প্রতি মমতা, সেটি এই সাত বছরেও ভুলতে পারিনি। ‘আপনি সব নিয়ে গেলে অন্যরা কী খাবে’- তার এই বাক্যটি এখনও কানে লেগে আছে।’

লেখক : বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।

এইচআর/এমকেএইচ

প্রতি বছর মমতার বাড়িতেও যে পরিমাণ ইলিশের বাক্স যায়, তাও বিস্ময়কর। শুভজিতের এই কথা শোনার পরে মনে হলো, আমাদের দেশেও নেতা, মন্ত্রী ও এমপিদের বাসায় বাক্সভরে এরকম মাছ যায় নিয়মিত। একাধিক নেতাকে আমরা চিনি যারা নেতা হওয়ার পরে সম্ভবত নিজের পকেটের পয়সায় আর মাছ কেনেননি।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।