‘তোমাদের ভুল, আমাদের মাশুল’

প্রভাষ আমিন
প্রভাষ আমিন প্রভাষ আমিন , হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ
প্রকাশিত: ০৯:৩৫ এএম, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯

শুক্রবার ছুটির দিনটা আমি প্রকৃতির সাথে কাটানোর চেষ্টা করি। খোলা আকাশ, উন্মুক্ত মাঠ, ঘন সবুজ বা টলটলে পানির নদী- এমন কিছু খুঁজে বেড়াই। পেলে টুপ করে বসে থাকি। যতক্ষণ প্রকৃতির সাথে থাকি, সবুজের দিকে তাকাই; অন্যরকম ভালোলাগায় মন ভরে যায়। কিন্তু আমার চোখের সামনে সবুজ আস্তে আস্তে কমে আসছে। সবুজের খোঁজে এখন আরো বেশি দূরে যেতে হয়। চোখের সামনে জলাশয় ভরাট হয়ে ফ্ল্যাট হয়ে যাচ্ছে, খালি জায়গা দ্রুত আড়াল করে দিচ্ছে সুউচ্চ সব ভবন, কথায় কথায় নির্বিচারে গাছ কাটা হচ্ছে।

এই যে গাছ, নদী, খালি জায়গা উজাড় হচ্ছে; এটা শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বজুড়েই প্রকৃতির বিরুদ্ধে যেন লড়াইয়ে নেমেছে মানুষ। মানুষের ভোগ বিলাসের কারণে বেড়েছে কার্বন নিঃসরণ, বেড়েছে উষ্ণতা, বরফ গলে বাড়ছে সমুদ্রের উচ্চতাও। এভাবেই আমরা আমাদের বাসের পৃথিবীটিকেই বাসের অযোগ্য করে ফেলছি। এটা আত্মহনন প্রবণতা। যে ডালে বসে আছে, সে ডালই কেটে ফেলে বোকারা। মানুষ কি তাহলে বোকাই? কিন্তু দেখে তো মনে হয়, মানুষ বোকা নয়, অতি চালাক বা ধূর্ত। তারা কৌশলে শুধু নিজের কথা ভাবে, পৃথিবীর কথা ভাবে না, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভাবে না। ভাবে যে না সেটা বুঝে ফেলেছে নতুন প্রজন্ম। তারা পূর্বসূরিদের এই অন্যায়ের, নিস্পৃহতায় প্রতিবাদ করছে।

১৬ বছর বয়সী সুইডিশ তরুণী গ্রেটা থুনবার্গ। তার একার প্রতিবাদ আজ ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বিশ্বে। বলছিলাম ছুটির দিনের কথা। গত ২০ সেপ্টেম্বর ছিল শুক্রবার, মানে আমার ছুটির দিন। এই দিনটিতে আমি সবুজের কাছে যেতে পারিনি, সবুজের ডাকে। গ্রিন সেভার্সের আহসান রনির ডাকে গিয়েছিলাম মানিক মিয়া এভিনিউতে। ডাকটা আসলে আহসান রনিরও নয়। এটি সেই সুইডিশ তরুণী গ্রেটা থুনবার্গের ডাক। এই ডাক শুধু সুইডেন বা বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বেই ক্লাইমেট স্ট্রাইকের ডাক দিয়েছিলেন গ্রেটা থুনবার্গ। আমরা অনেক রকম স্ট্রাইকের কথা শুনি, ক্লাইমেট স্ট্রাইক এই প্রথম। বিশ্বের দেড়শটি দেশের ৪০০ শহরে এই স্ট্রাইকে অংশ নিতে রাস্তায় নেমে আসে কোটি শিশু তরুণ। তারা আঙ্গুল তুলেছে সিনিয়রদের দিকে, বিশ্ব নেতাদের দিকে।

আমরা ঠিকমত আমাদের দায়িত্ব পালন করিনি বলেই তাদের ভুগতে হয়েছে, বিশ্ব আজ ধ্বংস হতে বসেছে। গ্রেটা থুনবার্গের এই আন্দোলন শুরু হয়েছে গত বছর আগস্টে। প্রতি শুক্রবার সে স্কুল ফেলে সুইডিশ পার্লামেন্টের সামনে অবস্থান ধর্মঘট পালন করে। তার দাবি সহজ- পৃথিবীটা নতুন প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য রাখতে, উষ্ণায়ন প্রক্রিয়া রোধ করতে হবে। প্রতি শুক্রবারের এই আন্দোলনের নাম দেয়া হয়েছে ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার। আসলে সময় আসছে, আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য পৃথিবীটা আরো বাসযোগ্য করতে শুধু শুক্রবার নয়, নিত্যদিনের আন্দোলনের। বেঁচেই যদি না থাকি, তাহলে আর এতকিছু করে লাভ কি? গ্রেটার সেই আন্দোলন আজ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে। আসলে এটা গ্রেটার একার আন্দোলন নয়, এটা সবার আন্দোলন।

পৃথিবী যখন ধ্বংস হবে, বাসের অযোগ্য হবে; তখন পুরোটাই হবে, কোনো একটা অংশ তো ভালো থাকবে না। পৃথিবীজুড়ে যখন জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পড়ছে, পৃথিবী আরো উষ্ণ হয়ে যাচ্ছে, মাসের পর মাস আমাদের লোভের আগুনে পুড়ে যাচ্ছে আমাজন। কিন্তু আমরা আসলে কিছুই করছি না। আমরা কিছুই করছি না বলেই শিশু-কিশোররা ক্লাশরুম ফেলে রাজপথে নেমেছে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জলবায়ু পরিবর্তন বা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে বা পরে তিনি নিউইয়র্কের বাড়িতে বসে উষ্ণায়ন নিয়ে মশকরা করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘সবাই বলছে পৃথিবী উষ্ণ হচ্ছে। কিন্তু আমি নিউইয়র্কে বরফেরে জন্য বাসা থেকে বেরুতে পারছি না।’

এরপর এই গাড়লকে নিয়ে আর বলার কিছু থাকে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর এই ডোনাল্ড ট্রাম্প জলবায়ু তহবিল থেকে তার দেশকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। সমস্যাটা এখানেই। আমি আপনি যতই চিৎকার করি লাভ নেই। যারা বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সেই ট্রাম্পদের বুঝতে হবে, বিশ্ব কত ভয়াবহ বিপদে আছে। তারা বোঝেন না বলে, কিছু করেন না বলেই মাঠে নেমেছেন গ্রেটা। এই পিচ্চি মেয়েটি বিশ্ব নেতাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিতে এসেছে। নতুন প্রজন্ম চিৎকার করে বলছে, তোমরা ঠিক করছো না। মুখে বললেও তোমরা কাজের কাজ কিছুই করছো না। তোমাদের ভুলে ভুগতে হচ্ছে আমাদের। ক্লাইমেট স্ট্রাইকের দুদিন বাদেই গ্রেটা থুনবার্গ জাতিসংঘে বিশেষ জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্ব নেতাদের চোখে চোখ রেখে উচ্চারণ করে, ‘হাউ ডেয়ার ইউ। তোমাদের কত বড় সাহস, তোমরা তোমাদের ফাঁকা বুলি দিয়ে আমাদের বোঝাতে চাও।’

শুরুতে গ্রেটার বক্তব্য নিয়ে বিশ্বনেতারা হাসাহাসি করলেও, পরে তার বক্তব্যের ঝাঁজ সবাইকে চমকে দেয়। তার অবয়বে যে ক্ষোভ, কথায় যে তীব্রতা, তা ছুঁয়ে গেছে বিশ্বনেতাদেরও। শুরুতে হাসাহাসি করলেও পরে সবাই বুঝেছেন নিজের ব্যর্থতা আর অক্ষমতা। গ্রেটা রীতিমত হুমকি দিয়েছে বিশ্ব নেতাদের, ‘আমরা কিন্তু আপনাদের দিকে নজর রাখছি।‘গ্রেটার কণ্ঠে আক্ষেপ, ‘সবকিছু ভুল হচ্ছে। আমার এখানে থাকার কথাই নয়। বরং সাগরের ওপারে নিজের স্কুলে থাকা উচিত।‘ গ্রেটা যখন বলে, ‘তোমাদের ফাঁকা বুলি দিয়ে আমাদের শৈশবের সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দাও। মানুষ মারা যাচ্ছে। গোটা পরিবেশ রসাতলে যাচ্ছে। আর তোমরা আশা নিয়ে আমাদের কাছে আসো। হাউ ডেয়ার ইউ।‘সবাই চুপ হয়ে যায়। সবাই বুঝতে পারে এই সেয়েটি নিজের জন্য, লড়ছে এই বিশ্বকে বাঁচানোর জন্য। গ্রেটা রাগে চিৎকার করে, ‘আমরা একটা ব্যাপক ধংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আর তোমরা টাকাপয়সা এবং সুন্দর আর্থিক প্রবৃদ্ধির কথা বলছো। কী সাহস তোমাদের।’

জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে গ্রেটা চূড়ান্ত হুমকি দিয়ে দেয়, ‘তোমরা আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছো। কিন্তু এ বার যুবসমাজ সবটা বুঝতে পারছে। আগামী প্রজন্ম তোমাদের ওপর নজর রাখছে। তোমরা আমাদের হতাশ করলে কথা দিচ্ছি আমরা তোমাদের কাউকে ছাড়বো না।’এবারই প্রথম নয়, গ্রেটা আগেও তার ক্ষোভের আগুনে পোড়াছে চেয়েছে বিশ্বনেতাদের নিষ্পৃহতাকে, ‘আমরা এখনও অনেকদিন বাঁচব। কিন্তু পৃথিবী বাঁচবে কি? দূষণ আর উষ্ণায়নে পৃথিবীর মৃত্যু ডেকে আনছ তোমরা। তোমাদের মতো ‘পলিসি মেকারদের’ জন্যই এই দুর্গতি আমাদের ছোটদের। আমাদের ভোটে দাঁড়ানোর বয়স হয়নি। তোমরা জিতেছ। তাই তোমাদেরই ব্যবস্থা করতে হবে। করতেই হবে।’

২০ সেপ্টেম্বর মানিক মিয়া এভিনিউতে ক্লাইমেট স্ট্রাইকের র্যালিতে অংশ নিয়ে আমার মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। শিশু-কিশোররা পৃথিবী বাঁচাতে পরিবেশ রক্ষায় এগিয়ে এসেছে, এটা দেখে ভালো লেগেছে। আবার এমনও মনে হয়েছে, তাদের এই ক্ষোভের তীর কিছুটা হলেও তো আমাদের দিকে আছে। মূল দায়িত্ব অবশ্যই নেতাদের। কিন্তু আমরাই বা পৃথিবীকে বাঁচাতে কী করেছি? কবি অনেক আগেই ‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য’ করার অঙ্গীকার করেছিলেন। কিন্তু আমরা কতটা রাখতে পেরেছি সে অঙ্গীকার? শিশুরা যখন বলে, ‘তোমাদের ভুল, আমাদের মাশুল’আমার নিজেকেই অপরাধী মনে হয়। আমরা সবাই যদি ভাবি জীবদ্দশায় আমি পৃথিবীর কতটা ক্ষতি করেছি, কতটা গাছ লাগিয়েছি; তাহলেও অনেক সমস্যা মিটে যায়। আমরা যদি শুধু নিজেদের কথা ভাবি, তাহলে সেটা চরম স্বার্থপরতা হবে। আমি মরে গেলেও আমার সন্তান, তার সন্তান, তার সন্তান; এভাবে আমাদের উত্তরাধিকারীরাই তো থাকবে বিশ্বে। তাই নতুন প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যাওয়া আমাদের সবার দায়িত্ব।

গ্রেটা থুনবার্গ যখন জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে বিশ্বনেতাদের চোখে চোখ রেখে বলেন,‘ হাউ ডেয়ার ইউ’। তখন তা কাঁপিয়ে দেয় সবাইকে। গ্রেটা থুনবার্গের বক্তব্য যদি আমাদের, আমাদের নেতাদের চোখ খুলে দেয়; তারা যদি সবাই মিলে পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য সত্যিকার চেষ্টা করেন; তাহলেই বাঁচোয়া। নইলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের কাউকে ক্ষমা করবে না।

এইচআর/পিআর

গ্রেটা থুনবার্গ যখন জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে বিশ্বনেতাদের চোখে চোখ রেখে বলেন,‘ হাউ ডেয়ার ইউ’। তখন তা কাঁপিয়ে দেয় সবাইকে। গ্রেটা থুনবার্গের বক্তব্য যদি আমাদের, আমাদের নেতাদের চোখ খুলে দেয়; তারা যদি সবাই মিলে পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য সত্যিকার চেষ্টা করেন; তাহলেই বাঁচোয়া। নইলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের কাউকে ক্ষমা করবে না

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।