আমরা কী করছি?
কানাডার সাইমন ফ্রেজার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোলজির প্রফেসর, পাবলিশার এবং আপাদমস্তক একজন পরিবেশবিদ ফাদার কালিগ হেন্সওর্থ। তার নিজের স্ক্রিপ্টে লেখা ও পরিচালিত ফিল্ম “দ্য ফেইস অফ গড” এর নির্মাণ কালে আর্কটিকে অবস্থান কালীন অভিজ্ঞতা তুলে ধরলেন।
‘একদিন দেখি একঝাঁক হরিণ প্রজাতীর প্রাণি ছুটতে ছুটতে এসে আচমকা বরফ জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল । আমি হতভম্ব, স্তম্ভিত। স্থানীয়দের জিজ্ঞেস করতে তারা খুব বিষণ্ণ জবাব দিল, যে, এই ক্যারিবিও হরিণগুলি খাবারের সন্ধানে ঝাঁক বেঁধে ঘুরে। যখন খাবারের অভাব আর পরিবেশ বসবাসের চূড়ান্ত অযোগ্য হয়ে যায় তখন এমন দলবেঁধে আত্মাহুতি দেয়। এবং এটা নির্দেশ করে পৃথিবী দ্রুত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।’
গত ১৯শে সেপ্টেম্বর সারাবিশ্বে ফ্রাইডে ফর ফিউচার ম্যুভমেন্টের আহ্বানে আমাদের আবাসস্থল ,ফুকুওকার ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকা তেনজিনের কেগো পার্কে একাত্মতা ঘোষণার আয়োজন ছিল। ফুকুওয়াকায় স্থানীয়দের পাশে সেদিন ছিলেন প্রফেসর কালিগ হেন্সওর্থ।
আমাদের দেশেও একই দিনে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে আয়োজিত স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সমাবেশে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব থেকে পৃথিবীকে বাঁচানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে বিশ্বনেতাদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়। শুক্রবার সকালে এই সমাবেশ ও শোভাযাত্রার আয়োজন করে সেভ দ্য চিলড্রেন এবং গ্রিন বেভার অ্যাসোসিয়েশন। পরিবেশ রক্ষার পক্ষে বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড হাতে শত শত শিক্ষার্থী অংশ নেয় এই সমাবেশে।
কি এই “ফ্রাইডে ফর ফিউচার?” আগস্ট ২০১৮ তে জলবায়ু সংকট নিয়ে ব্যবস্থা না নেওয়ার প্রতিবাদ জানাতে ১৫ বছর বয়সী গ্রেটা থানবার্গ পরপর তিন সপ্তাহ স্কুল ডে শুক্রবারে সুইডিশ পার্লামেন্টের সামনে বসেছিল। তার ইনস্টাগ্রাম এবং টুইটারের পোস্ট দ্রুতই ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল। গ্রেটা সুইডিশ নীতিগুলি ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের এর অধীনে, অর্থাৎ প্যারিস চুক্তির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নিরাপদ পথের ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত প্রতি শুক্রবার ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অতঃপর ৪ই সেপ্টেম্বর তার দাবি মেনে নেয়া হয়।
তার হ্যাশট্যাগগুলি ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেক ছাত্র এবং প্রাপ্তবয়স্করা তাদের সংসদ এবং স্থানীয় শহর হলগুলির বাইরে সারা বিশ্বের প্রতিবাদ শুরু করে। কেন প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাড়াতে হয়? মানুষ প্রবণতাগতভাবে পজিটিভ। তাকে জানতে হয়, উপলব্ধি করতে হয় আমি যা করছি তা গর্হিত, তা প্রাণঘাতী- প্রাণের জন্য ক্ষতিকর এবং এর ব্যাপকতা কতটা ভয়াবহ।
অ্যামাজন জংগলে আগুন লেগে পুড়ে গেল। সবাই শেয়ার করলো। আগুন কারা লাগালো তা কজন শেয়ার করেছে? মেক্সিকান চরম ডান পন্থী সরকারের ভূমিকা এখানে কি ছিল? কোনো দেশে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া কোন অন্যায় চলে না সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়া কোনো অন্যায় থামে না। এইজন্যই প্ল্যাকার্ড নিয়ে নজরে আসার মত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অনড় অবস্থান। বলা বাহুল্য এই প্ল্যাকার্ড হাতে একজন দাঁড়ালে তার প্রতিক্রিয়া হবার না। এই একের পাশে শতেক হয়ে দাবি আমলে আনাতেই দাঁড়াতে হয়। সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতেই জানাতে হয়।
যেমন পরিবেশবাদীদের অন্যদের সবাইকে ভাবাতে হয় যে আজকে আমি, তুমি কি করে পরিবেশকে ধ্বংসের মুখ থেকে বাঁচাতে পারি। যেমন বহুমুখী প্রতিভার আধার প্রফেসর কালিগ সেদিন বললেন, তিনি নিজে কি করেন-
১। না হলেই নয় দূরত্বে ট্রেনে যাই। বাসে যেহেতু জ্যামের হিসেব নেই। তাতে প্লেনে চড়ার ফুয়েল এমিশন কমাতে কন্ট্রিবিউট করলাম।
২। গাড়ি না চালিয়ে পায়ে হেঁটে বা গণপরিবহনে চড়ি।
৩। মোজা, আন্ডারগার্মেন্টস ছাড়া নতুন কাপড় কেনা বছরে ১/২টায় নামিয়ে এনেছি। এতে কাপড় প্রতি প্রডাকশনের ইলেক্ট্রিসিটি এমিশন কমলো।
৪। দাওয়াত আপ্যায়ন পার্টি ছাড়া বা সপ্তাহে ১/২ ছাড়া মাংস মাছ খাই না । স্বাস্থ্যও ভালো থাকলো।
৫। প্রয়োজন ছাড়া বাতি চুলা নিভিয়ে দেই। চার্জিং ছাড়া সকেটে প্লাগ লাগিয়ে রাখি না।
আরেকটা বিষয় বললে হয়তো আমি সমগ্র প্রকাশনা জগতের চক্ষুশূল হবো, তবু বলবো বইয়ের ইলেক্ট্রনিক ভার্সন হোক। ষষ্ঠ বৃহত্তম ভাষাভাষীর বই অ্যামাজনে প্রাপ্য হোক। পাঠক কতগুণ বেড়ে যাবে।
অডিবলে বই শোনার সফটওয়্যারের মত বাংলা বইয়ের প্ল্যাটফর্ম হোক। এতে বই প্রতি এত এত গাছ কাটা পড়বে না। স্থানও বাঁচবে। এক বই একজন পড়বে। এতে বইয়ের ক্রেতাও বাড়বে। পকেটের মোবাইলেই থাকবে অজস্র বই। প্রিন্টারেরা এই কাজে প্রশিক্ষিত হয়ে দ্রুত প্ল্যাটফর্ম দখল করবে। মাত্র ২ ঘন্টার জ্যামে বসেই রোজ ১৫০ পাতা শোনা ,অর্থাৎ , পড়া হয়ে যাবে , তাও চোখ বুজেই বিশ্রাম নিতে নিতেই কিংবা হাঁটা পথকে জোগিং মোডে নিয়ে ( অবশ্যই এক কানে)।
আরো এমন কয়েক শত উদাহরণ দেয়া যায়। কার্বন এমিশন খারাপ, রিনিউয়েবল এনার্জিতে সব চলে যাওয়া উচিৎ বললেই আওয়াজ আসে এই খনির শ্রমিকেরা কোথায় যাবে? শ্রমিক ইউনিয়ন পোষে নেতা ও রাষ্ট্র, আবার এদের তোলা চাঁদায় ভুক্ত হয় সরকার। আবেগের ব্লাকমেইলের নাইট্রোজেন চক্র শুরু হয়, এরা কোথায় যাবে? বাপ দাদার পেশা? এরা তো আর কিছুই পারেনা। এই পারেনা , পারবেন না ট্যাবুটাই তাদের পঙ্গু করে দেয়, অচল করে দেয় অগ্রসরমান জীবনের চাহিদায়।
সরি টু সে, তাহলে আজকে টাইপিস্ট, সনদ লেখক এরা কোথায় গেছেন? কতদিন লেগেছে কম্পিউটার শেখাতে? কতদিন লাগে নতুন কিছু শিখিয়ে নতুন ইন্ডাস্ট্রিতে তাদের কর্মী করে তুলতে? একই কথায় এসে যাচ্ছে, এতেও দরকার সরকারের সদিচ্ছা।
বিদ্যুত চালিত গাড়ি এখন ভুটানের মত ছোট্ট দেশেও ভরে গেছে। পেট্রোল পাম্পে পাম্পে গাড়ি চার্জার। জাপান এগিয়ে গেছে রিনিউয়েবল এনার্জিতে তুমুল গতিতে। অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রি সারা বিশ্বে এখন হাইব্রিড, বিদ্যুতচালিত গাড়ি নির্মাণ বা মেইন্টেনেন্স এ কাজ করবার জন্য ইঞ্জিনিয়ার খুঁজে নিচ্ছে। অন জব ট্রেনিং দিতে রেগুলার রোলে নিয়োগ করছে।
আমাদের দেশেও সরকার প্রশিক্ষণে সদিচ্ছা দেখালে জাপান সরকার এমন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলবে যাতে জাপানে না গিয়েও রিমোটলি ইঞ্জিনিয়ারগণ বিদ্যুত চালিত অটোমেটিক গাড়ির ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে পারবে। এতে করে মেধা শূন্যতার ঢালাও নেতিবাচক রব উঠবে না। দেশেই এমন গাড়ি প্রস্তুত হবার সুযোগ হবে। ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠবে, বিপুল কর্মসংস্থানও হবে।
তাই আমাদের প্রয়োজন প্রবল তাগিদ দেয়া এবং সেই তাগিদ নিজেদের দায়েই সরকারকে জানানো। সবাই রাস্তায় প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়াতে পারেনা বা দাঁড়ানোটা বেছে নেয় না। তারা অন্য কোনওভাবে অন্য কোন প্ল্যাটফর্মে লোককে আহ্বান করে, অনুদান দিয়ে প্রোগ্রাম আয়োজনে সাহায্য করে বা আহ্বানে গিয়ে পাশে দাঁড়াতে পারে এমন কাউকে জানিয়েও পাশে থাকতে পারে।
যেমন পরিবেশ রক্ষার এই আন্দোলনে এটাই শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের নূন্যতম মানবিক দায়, যা না মিটিয়ে আমরা সমগ্র বিশ্বকে সকল প্রাণীর জন্যই বাসের অযোগ্য করে তুলছি। সুন্দরবন আন্দোলনে সেদিন তেল গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটি এমন প্রচণ্ড সাড়া না তুললে সরকারের এই অন্যায় আগ্রাসন চাপের মুখে ফেলা যেত না। এটাই জনগণের ন্যূনতম নাগরিক দায়।
প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি বলেছিলেন, ‘দেশকে প্রশ্ন করোনা দেশ তোমার জন্য কি করতে পারে। নিজেকে প্রশ্ন করো তুমি দেশের জন্য কি করতে পারো।’ আজ বিপন্ন বিশ্ব আপনার কাছে প্রশ্ন করছে, ‘অবাসযোগ্য এই বিশ্বকে বাসযোগ্য করে তুলতে কিংবা অবাসযোগ্য হতে রক্ষা করতে তুমি কি করেছ?’
এইচআর/জেআইএম